করোনা সংক্রমণ রোধে একমাত্র প্রতিষেধক হিসেবে টিকাদান কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে প্রথম সারির সেবায় নিয়োজিত মানুষজনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ, এমনকি বস্তিবাসীকেও আনা হয়েছে টিকার আওতায়। এরই ফল হিসেবে দেশে টিকাদান কর্মসূচী শুরু হওয়ার মাত্র ১ বছরের মধ্যে প্রথম এবং দ্বিতীয় ডোজ মিলিয়ে ১৬ কোটি ডোজ টিকা প্রদানের মাইলফলকে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে প্রথম ডোজের আওতায় চলে এসেছে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ। আর দুই ডোজ পেয়েছেন অন্তত ৫০ শতাংশ। এভাবে চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই লক্ষ্যপূরণ সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, চলতি ফেব্রুয়ারির মধ্যেই অন্তত ১০ কোটি মানুষকে দুই ডোজ টিকার আওতায় নিয়ে আসা হবে। লক্ষ্যমাত্রার হিসাবে ৭০ শতাংশের বাকি আড়াই কোটি মানুষও দ্রুততম সময়ের মধ্যেই পাবেন টিকা।
শুরুতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিভিন্ন জায়গায় দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে করোনা টিকার আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনার কথা বললেও সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি জানান, টিকা দেয়া হবে মোট জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ মানুষকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ীই এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে তিনি বলেছেন, মোট সাড়ে ১২ কোটি জনগণ মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দুই ডোজ মিলিয়ে টিকার আওতায় এসেছেন ১৬ কোটি ২৫ লাখ ৪৮ হাজার ৩৫২ জন মানুষ। প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৯ কোটি ৮৬ লাখ ৩৪ হাজার ৭৭৫ জন মানুষ। আর প্রথম এবং দ্বিতীয় উভয় ডোজই পেয়েছেন ৬ কোটি ৩৯ লাখ ১৩ হাজার ৫৫৭ জন। এদেরকে দেয়া হয়েছে অক্সফোর্ড এ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড, চীনের তৈরি সিনোফার্ম, ফাইজার এবং মডার্নার টিকা।
গত বছরের ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে দেশে করোনার টিকাদান কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয় ভারত থেকে আসা অক্সফোর্ড এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দিয়ে। কিন্তু ওই সময় দেশেটিতে করোনার ডেল্টা ধরনের মহামারী আকার ধারণ করলে বন্ধ করে টিকা রপ্তানি। ফলে বাংলাদেশেও মুখ থুবড়ে পড়ে টিকাদান কার্যক্রম। কিন্তু সরকারের টিকাপ্রাপ্তিতে সরকারের নানামুখী তৎপরতায় অবশেষে সাফল্য আসে। চীনের তৈরি সিনোফার্মের টিকা দিয়ে আবারও শুরু হয় টিকাদান কার্যক্রম। এরপর ধারাবাহিকভাবে কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় জাপান, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ থেকে আসতে থাকে অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাও। এক সময় যুক্তরাষ্ট্রও পাঠাতে শুরু করে ফাইজারের টিকা। এতে করে টিকাদান কার্যক্রম চলে পূর্ণোদ্যোমে। সাধারণ মানুষদের পাশাপাশি গত বছরের ১ নবেম্বর থেকে দেশজুড়ে শুরু হয় ১২-১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদেরও টিকাদান কর্মসূচী। ১৬ নবেম্বর থেকে রাজধানীর বস্তিগুলোর বাসিন্দাদেরকেও টিকা দেয়া শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় খুব শীঘ্রই প্রায় ২ কোটি ভাসমান জনগোষ্ঠীকেও টিকার আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গত ৩০ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, দেশের ভাসমান জনগোষ্ঠীকে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি জনসন এ্যান্ড জনসনের টিকা দেয়া হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ভাসমান মানুষকে জনসন এ্যান্ড জনসনের টিকা দেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে কোভ্যাক্স থেকে পাওয়া তিন লাখ ৩৬ হাজার টিকা ব্যবহার করা হবে। যেহেতু জনসনের টিকা এক ডোজ দিলেই হয়। তাই ভাসমানদের এই টিকা দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, টিকা প্রাপ্তির সক্ষমতার প্রেক্ষিতে গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর থেকে দেশজুড়ে শুরু হয় করোনার টিকার বুস্টার ডোজ প্রদান। প্রথম দিকে শুধু সম্মুখসারির যোদ্ধারা এ বুস্টার ডোজ পেলেও পরবর্তীতে ৪০ বছর বয়সসীমার সবাইকে এই বুস্টার ডোজের আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
টিকা কার্যক্রমের সফলতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতার অন্যতম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের এখনও ৯ কোটি টিকা স্টকে আছে। ইতোমধ্যে সোয়া ১৬ কোটি ডোজ দিয়ে ফেলেছি। অর্থাৎ প্রায় ২৬ কোটি ডোজ টিকা আমরা হাতে পেয়েছি। আরও পাঁচ কোটি আসবে। এই মুহূর্তে বাড়তি টিকার প্রয়োজন নেই। চীনের সিনোফার্মের সঙ্গেও আমাদের একটি বেসরকারী কোম্পানির টিকা তৈরির চুক্তি রয়েছে। আমরা সেই অনুযায়ী প্রস্তুত আছি। যখনই বলব টিকা লাগবে, তখনই তারা কার্যক্রম শুরু করতে পারবে। তবে আমাদের এই মুহূর্তে টিকার প্রয়োজন নেই বলে সেদিকে জোর দিচ্ছি না। সরকারীভাবে টিকা তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে পৌণে ১০ কোটি প্রথম ডোজ এবং সোয়া ৬ কোটি দুই ডোজ টিকা দেয়া হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরাও টিকা পেয়েছে। এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ২ কোটি ৫৫ লাখ ৮ হাজার ৮৪৭ ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। জানুয়ারি মাসে সর্বোচ্চ ৩ কোটি ৪০ লাখ টিকা টিকা দিয়েছি। আশা করছি, ফেব্রুয়ারির মধ্যে ১০ কোটি মানুষ টিকার আওতায় আসবে। প্রথম ডোজ এবং দ্বিতীয় ডোজ একই হারে বাড়তে থাকবে দাবি করে মন্ত্রী বলেন, সাড়ে ১২ কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে আমাদের। ১০ কোটি মানুষকে টিকা দেয়া হয়ে গেলে আড়াই কোটি বাকি থাকবে। তাদেরও দ্রুততম সময়ের মধ্যে টিকার আওতায় নিয়ে আসা হবে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে টিকাদান কর্মসূচীতে কিছুটা ঢিমেতালে ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকেই টিকাকেন্দ্রে আসছেন না টিকা নিতে। এমন অবস্থায় লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে কিছুটা বেগ পেতে হবে বলে জানিয়ে টিকাদান কর্মসূচীর সমন্বয়ক স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক শামসুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, মানুষ টিকা নিতে কম আসছে- এটা সত্যি। তবে আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ওয়ার্ড পর্যায় থেকে শুরু করে সব জায়গায় টিকা দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এর আগে কয়েকটি টিকাদান ক্যাম্পেইন চালানো হলেও আপাতত এ রকম কোন পরিকল্পনা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন আমরা বিভিন্ন সমিতি যেমন- বাস মালিক সমিতি, দোকান মালিক সমিতি, রেস্তোরাঁ মালিক সামিতি, তাদেরকে চিঠি দিয়েছি যেন তাদের সদস্যরা টিকা নেন বাধ্যতামূলকভাবে। একই চিঠি দেয়া হবে বিভিন্ন চেম্বারগুলোকেও। এভাবে আমাদের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। ভাসমান মানুষদের টিকাদান কর্মসূচী কবে নাগাদ শুরু হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, জনসনের টিকা আসতে শুরু করেছে। আমরাও এ বিষয়ে কাজ করছি। শীঘ্রই আপনাদের জানানো হবে।
এদিকে, রাজধানীর কয়েকটি টিকাদান কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেলেও টিকাগ্রহিতাদের ভিড় তেমন একটা নেই। রাজধানীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালে বুস্টার ডোজের টিকা নিতে আসা ৫০ উর্ধ আক্কাস মাহমুদ বলেন, প্রথম এবং দ্বিতীয় ডোজের টিকা নেয়ার ৬ মাস পার হয়ে গেছে। আজ তাই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বুস্টার ডোজ নিতে এসেছি। এখানকার পরিবেশ চমৎকার। মানুষেরও কম উপস্থিতি থাকায় নিরাপদ মনে করছি। হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক ডাঃ আয়েশা আক্তার জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে টিকাদান কর্মসূচী শুরু হওয়ার পর থেকেই আমরা মানুষজনকে টিকা দিয়ে আসছি। এখন বুস্টার ডোজের পাশাপাশি অন্যান্য ডোজের টিকাও দেয়া হচ্ছে আমাদের এখানে। সবাই অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গেই টিকা নিচ্ছেন।
এদিকে, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার জন্য দেশজুড়ে চলছে বিধিনিষেধ, যা গত বুধবার আবারও বাড়ানো হয়। মন্ত্রিপরিষদ থেকে জারি হওয়া প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসায় আবারও বাড়ানো হলো চলমান বিধিনিষেধ। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি (সোমবার) রাত ১২টা পর্যন্ত বিধিনিষেধের মেয়াদ বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ভাইরাসটির নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ রোধে দুটি শর্ত সংশোধন করে প্রজ্ঞাপনে এ সময়টায় বাড়তি সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।