গুলবদিন
নাইবের বলে আফিফ হোসেনের পুল শট আশ্রয় নিল বাউন্ডারিতে। স্টেডিয়ামের ঘড়িতে
তখন সন্ধ্যা ঠিক ৭টা। সপ্তম উইকেট জুটিতে ঠিক ওই সময়টায় আর ওই শটে যেখানে
পৌঁছল বাংলাদেশ, সেই ঠিকানার নাম ‘অবিস্মরণীয়’ বা ‘অভাবনীয়’ অথবা
‘অকল্পনীয়।’ কিংবা সবকিছুই! বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জয়ের অনেক গল্পই তো
রচিত হয়েছে ক্রিকেটে। সেখানেই হয়ে গেল গৌরবময় আরেকটি সংযোজন। পরাজয়ের দুয়ার
থেকে আফিফ হোসেন ও মেহেদী হাসান মিরাজের বীরোচিত পারফরম্যান্স বাংলাদেশকে
এনে দিল ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা জয়গুলির একটি।
৪৫ রানেই বিদায় প্রথম ৬
ব্যাটসম্যানের। ২১৬ রানের লক্ষ্য তখন ধরাছোঁয়ার বাইরে মনে হওয়াই
স্বাভাবিক। আফিফ আর মিরাজ সেই পথই পাড়ি দিলেন চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা, পরিণত
ব্যাটিং, দুর্দান্ত স্কিল আর বুকে সাহস নিয়ে।
দুজনের অসাধারণ জুটিতে আফগানিস্তানকে ৪ উইকেটে হারিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে গেল তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে।
মাত্র
অষ্টম ওয়ানডে খেলতে নামা আফিফ ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে ফিফটিকে রূপ
দিয়েছেন ৯৩ রানের ম্যাচ জেতানো অপরাজিত ইনিংসে। ১১৫ বলের ইনিংসে ১১টি চারের
সঙ্গে ছক্কা একটি। সাতে নেমে বাংলাদেশের হয়ে এত বড় ইনিংস নেই আর কারও।
যার
ব্যাটিং প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ হচ্ছে না বলে দেশের ক্রিকেটে হাহাকার জাগে
প্রায়ই, সেই মিরাজ অপরাজিত ১২০ বলে ৮১ রান করে। আট নম্বরে এটিও বাংলাদেশের
সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের রেকর্ড।
দুজনের অবিচ্ছিন্ন জুটি ১৭৪ রানের। ৫০ রানের মধ্যে ৬ উইকেট হারানোর পর এত বড় জুটি আর নেই ওয়ানডে ক্রিকেটের ৫১ বছরের ইতিহাসে।
অথচ
এই ম্যাচের নায়ক হতে পারতেন ফজলহক ফারুকি। মাত্র দ্বিতীয় ওয়ানডে খেলতে
নামা বাঁহাতি পেসারের বিধ্বংসী প্রথম স্পেল বাংলাদেশকে ঠেলে দিয়েছিল
বিব্রতকর বাস্তবতায়। কদিন আগে বিপিএলে তার বোলিং ছিল একদম সাদামাটা। অথচ এই
ম্যাচে দারুণ সুইং বোলিংয়ে তিনি গুঁড়িয়ে দেন বাংলাদেশের টপ অর্ডার।
তামিম
ইকবালের দুটি বাউন্ডারিতে ফারুকির প্রথম ওভার থেকে ১২ রান নিয়ে শুরু হয়
বাংলাদেশের রান তাড়া। সেই ফারুকি দ্বিতীয় ওভারেই বিদায় করেন বাংলাদেশের দুই
ওপেনারকে। শুরুতে লিটন দাস, এক বল পর তামিম। দুটিতেই আম্পায়ার আউট না
দেওয়ার পর উইকেট আসে রিভিউয়ে।
সেই ধাক্কা সামাল দেওয়ার আগেই আবার ফারুকির জোড়া শিকার। এবার এলবিডব্লিউ মুশফিকুর রহিম, অভিষেকে শূন্য রানে বোল্ড ইয়াসির আলি চৌধুরি।
৫ ওভারে তখন নেই বাংলাদেশের ৪ উইকেট।
ফারুকির
চমকের পর মুজিব উর রহমান ও রশিদ খানের অনুমিত চিত্রনাট্যের দৃশ্যায়ন।
মুজিবের বল স্টাম্পে টেনে আনেন সাকিব, রশিদের শর্ট বলে বাজে শটে স্লিপে ধরা
পড়েন মাহমুদউল্লাহ।
জয় তো ভাবনারও বাইরে, তখন বরং শঙ্কা, ওয়ানডেতে আগের সর্বনিম্ন ৫৮ ছাড়াতে পারবে তো বাংলাদেশ?
কিন্তু
আফিফ ও মিরাজ ছাড়িয়ে যান ভাবনার সীমানা। বয়স আর অভিজ্ঞতাকে হার মানানো
পরিণত ব্যাটিংয়ে দুজন এগিয়ে নেন দলকে। দুর্দান্ত রানিং বিটুইন দা উইকেট,
বাজে বলের উপযুক্ত পরিণতি, চাপ সামলে পরিস্থিতির দাবি মেটানো, আদর্শ
ব্যাটিংয়ের প্রতিচ্ছবি ছিল যেন দুজনের ব্যাটিং। আফগানদের শক্তিশালী বোলিং
আক্রমণকেও কোনো সুযোগ দেননি দুজন।
খাদের কিনারা থেকে দলকে শুধু টেনে তুলেই কাজ শেষ মনে করেননি তারা, দলকে জিতিয়ে তবেই মাঠ ছেড়েছেন হাসিমুখে।
ম্যাচের
শেষে যেমন, তেমনি প্রথম ইনিংস শেষেও বাংলাদেশ মাঠ ছাড়ে হাসিমুখেই।
চট্টগ্রামের ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা আফগানদের ২১৫
রানে আটকে রাখা তো দারুণ পারফরম্যান্সই বলা যায়।
বোলারদের সম্মিলিত
প্রচেষ্টাই বারবার থমকে দেয় আফগানদের জুটি গড়ার চেষ্টা। টপ ও মিডল অর্ডারে
পাঁচ ব্যাটসম্যান উইকেটে থিতু হতে পারলেও ফিফটি ছুঁতে পারেন কেবল
নাজিবউল্লাহ জাদরান। চার নম্বরে নেমে প্রায় শেষ পর্যন্ত উইকেটে থেকে এই
বাঁহাতি করেন ৬৭ রান।
আফগানদের ইনিংসে ফিফটি জুটিও স্রেফ একটি। বেশ
কয়েকটি জুটি জমে ওঠার পরও ভেঙে যায় বড় হওয়ার আগেই। বাংলাদেশের বোলাররা
ক্রমাগত চাপ ধরে রেখে আদায় করে নেন উইকেট। ছয় বোলার বল হাতে নিয়ে উইকেটের
দেখা পান পাঁচজনই। যিনি উইকেট পাননি, সেই মিরাজ ১০ ওভারের টানা স্পেলে রান
দেন স্রেফ ২৮।
আলাদা করে বলতে হবে তামিম ইকবালের নেতৃত্বের কথাও।
বাংলাদেশ অধিনায়কের বোলিং পরিবর্তনগুলো এ দিন কাজে লেগে যায় দারুণভাবে।
দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তার মাঠ সাজানোও ছিল প্রায় নিখুঁত। সব মিলিয়েই
আফগানরা পারেনি ইনিংসকে গতি দিতে।
আফগানিস্তানের ইনিংস শুরু হয়
মুস্তাফিজুর রহমানের বলে রহমানউল্লাহ গুরবাজের নান্দনিক এক স্ট্রেট
ড্রাইভের বাউন্ডারিতে। তবে আগ্রাসী এই ব্যাটসম্যানকে ঝড় তুলতে দেননি
মুস্তাফিজ-তাসকিন। অতি দুঃসাহসী হতে গিয়ে তৃতীয় ওভারেই মুস্তাফিজের বল
আকাশে তুলে বিদায় নেন তিনি ১৪ বলে ৭ করে।
মুস্তাফিজ-তাসকিন প্রথম ৫
ওভারে দেন কেবল ১৫ রান। তিন রানে জীবন পান ইব্রাহিম জাদরান। তাসকিনের বলে
স্কয়ার লেগে সহজ ক্যাচ নিতে ব্যর্থ হন মাহমুদউল্লাহ।
তাসকিনের পরের
ওভারেই চার-ছক্কা মেরে ইব্রাহিম হাত সাফাইয়ের ইঙ্গিত দেন। তবে তাকে জীবন
দেওয়ার বড় মূল্য চুকাতে হয়নি শেষ পর্যন্ত। শরিফুল ইসলামের বলে ড্রাইভ করার
চেষ্টায় ধরা পড়েন তিনি স্লিপে। কোনোরকমে বল হাতে জমান অভিষিক্ত ইয়াসির আলি
চৌধুরি।
ক্যাচ দিয়ে বেঁচে যান তিনে নামা রহমত শাহও। শরিফুলের ওভারে ঠিকমতো বলের নিচে যেতে পারেননি সাকিব।
ইব্রাহিমের
মতো জীবন কাজে লাগাতে পারেননি রহমতও। বড় ইনিংস খেলার জন্য আফগানরা তাকিয়ে
থাকে মূলত রহমত ও শাহিদির ব্যাটে। উইকেটে বেশ কিছুটা সময় কাটানও তারা।
কিন্তু কাউকেই লম্বা সময় টিকতে দেয়নি বাংলাদেশ।
রহমতকে ৩৪ রানে থামান
তাসকিন। প্রথম স্পেলে আউট সুইংয়ের চেষ্টায় বেশ কয়েকটি ওয়াইড দেওয়া ফাস্ট
বোলার দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে দেখা পান উইকেটের। লেংথ থেকে লাফিয়ে ওঠা
ডেলিভারিতে উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন রহমত।
শাহিদির সঙ্গে যোগ দেন তখন
নাজিবউল্লাহ। দুই বাঁহাতি দেখে মাহমুদউল্লাহকে আক্রমণে আনেন তামিম। কাজেও
লেগে যায় তাৎক্ষনিক। শাহিদির ইনিংস থামে ২৮ রানে।
২৮ ওভারে আফগানিস্তানের রান তখন ৪ উইকেটে ১০২।
ইনিংসের
একমাত্র পঞ্চাশ ছোঁয়া জুটি পায় তারা এরপরই। নবি নিজেকে সংযত রেখে সঙ্গ
দিয়ে যান নাজিবউল্লাহকে। তাতে গড়ে ওঠে জুটি, বাড়ে রানের গতিও।
তবে
বিপজ্জনক হয়ে ওঠার আগেই নবিকে থামান তাসকিন। একই চিত্র গুলবদিন নাইবেরও।
তাসকিনকে বিশাল একটি ছক্কা মারলেও ঝড় ওঠেনি তার ব্যাটে। প্রথম ৮ ওভারে
উইকেটশূন্য সাকিব এক ওভারেই ফেরান নাইব ও রশিদ খানকে।
নাজিবউল্লাহ এক প্রান্ত আগলে রেখে ফিফটি করেন ৭০ বলে। কিন্তু শেষ দিকে দাঁড়াতে পারেননি কোনো ব্যাটসম্যান।
নাজিবউল্লাহ
নিজেও আউট হয়ে যান শেষের আগের ওভারে। মুস্তাফিজ-সাকিব-শরিফুলের ত্রিমুখী
আক্রমণে ২১ রানেই শেষ ৫ উইকেট হারায় আফগানিস্তান।
তখনও ভাবা যায়নি,
ম্যাচে কত নাটক বাকি আছে! রোমাঞ্চের নানা গলি পেরিয়ে উচ্ছ্বাসের ঠিকানায়
আশ্রয় পাওয়া গেল বলেই জয়টি শেষ পর্যন্ত হয়ে রইল স্মরণীয়। আফিফ ও মিরাজের
গলাগলি ধরে হাসিমুখে মাঠ ছাড়ার দৃশ্য হয়ে রইল বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের
স্মরণীয় এক ফ্রেম।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
আফগানিস্তান: ৪৯.১ ওভারে ২১৫
(গুরবাজ ৭, ইব্রাহিম ১৯, রহমত ৩৪, শাহিদি ২৮, নাজিবউল্লাহ ৬৭, নবি ২০, নাইব
১৭, রশিদ ০, মুজিব ০, আহমাদজাই ৫, ফারুকি ০*; মুস্তাফিজ ৯.১-০-৩৫-৩,
তাসকিন ১০-০-৫৫-২, সাকিব ৯-১-৫০-২, শরিফুল ১০-১-৩৮-২, মিরাজ ১০-৩-২৮-০,
মাহমুদউল্লাহ ১-০-৪-১)।
বাংলাদেশ: ৪৮.৫ ওভারে ২১৯/৬ (তামিম ৮, লিটন ১,
সাকিব ১০, মুশফিক ৩, ইয়াসির ০, মাহমুদউল্লাহ ৮, আফিফ ৯৩*, মিরাজ ৮১*;
ফারুকি ১০-১-৫৪-৪, মুজিব ১০-০-৩২-১, আহমাদজাই ৫-০-৩৫-০, রশিদ ১০-১-৩০-১,
নবি ১০-১-৩২-০, নাইব ৩.৫-০-২৫-০)।
ফল: বাংলাদেশ ৪ উইকেটে জয়ী
সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ১-০তে এগিয়ে
ম্যান অব দা ম্যাচ: মেহেদী হাসান মিরাজ