
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে, হে মঙ্গলময়,
দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয়
লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় আর ।
যে কথা বলতে ভালো লাগে, শুনতে ভালো লাগে, যে কথা বার বার বলেছি, শুনেছি-তারপরও ক্লান্তিবোধ করিনি, করব না। একথাই এবার কাগজ-কালিতে ভরিয়ে দিতে মন চাইছে। কথাটির মূল তাৎপর্য হলো অর্জন। ব্যক্তিগত অর্জন সীমানার পরিধিতে আবদ্ধ না থেকে তা হয়ে উঠেছে সার্বজনীন এবং সমষ্টিগত অর্জন। ব্যক্তিগত অর্জনের কথা বলতে বলতে এক সময় সমষ্টিগত অর্জনের সীমানায় নিজে বিলীন হয়ে যাব, এ প্রত্যাশায় এ লেখার অভিযাত্রা। জনান্তিকে বলে রাখা ভালো- এ অর্জনের কথা ইতিহাস নয়, স্মৃতিকথা। স্মৃতিকথা অনেকটাই আবেগ নির্ভর হয়ে থাকে; যথাসাধ্য চেষ্টা করা হবে নির্মোহভাবে নিজেকে তুলে ধরা । তাতে অবশ্যই আত্মতৃপ্তি থাকবে, কিন্তু আত্মশ্লাঘায় বেপথো হওয়ার সুযোগ থাকবে না।
ব্রিটিশ ভারতে আমার জন্ম। ১৯৪৩ সালের ১৫ আগস্ট (১৩৫০ সালের ২৯ শ্রাবণ), রবিবার। চার বছর পর ইংরেজ শাসনমুক্ত পূর্ব পাকিস্তানে আমার জন্মস্থান কুমিল্লা জেলার (তখন ত্রিপুরা জেলা) দাউদকান্দি থানা (উপজেলা) অন্তর্গত মোহাম্মদপুর গ্রাম। তবে আমার জন্মস্থান মাতুলালয় নোয়ান্দা গ্রামে। এ দু'গ্রামেই আমার শৈশব কেটেছে। ছয় বছর বয়সে লেখাপড়া শুরু করি। প্রথমে গৃহশিক্ষক স্বর্গীয় সুরেশ চন্দ্র আচার্য মহোদয়ের কাছে। তিনিই আমাকে অক্ষরজ্ঞান দান করেছিলেন। তা প্রায় একবছর সময়। তারপর বাবার হাত ধরে স্কুলে যাতায়াত শুরু করি। বাবা বরকোটা স্কুলের সহকারী শিক্ষক ছিলেন, তিনি আমাকে 'ছোট ওয়ান'-এ বসিয়ে দিলেন। ভর্তিহীন প্রথম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করার পর দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেন। তখন ভাষা আন্দোলনের ঢেউ এসে গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছে গেছে। স্কুলের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীরা 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' শ্লোগানে মুখর, আমরা সহযাত্রী এবং উপলব্ধিতে উজ্জীবিত কীনা জানিনা, তবে প্রত্যয়ী উত্তেজনায় আপ্লুত হয়ে শ্লোগান-চিৎকার দিয়েছি তারস্বরে সমবেতভাবে। নিচু ক্লাসে উর্দুপড়া শুরু হয়ে গিয়েছিল, মৌখিকভাবে অক্ষরজ্ঞান দান তখন হয়ে উঠেছিল মহাসমারোহে, দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক নিষ্ঠার সঙ্গে বিষয়টি অনুধাবণ করেছিলেন রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের প্রতি আন্তরিকতায়। ছোট বয়সে নতুন ভাষার অক্ষরজ্ঞান লাভে অনীহাবোধ ছিল না। আমার ভালো লাগত। ভাষা আন্দোলনের উষ্ণতায় উর্দু পড়া নিঃশেষ হয়ে যায়। পরবর্তীতে সুদূরপ্রসারী কুট ইচ্ছার তাগিদে উর্দু চাপানোর ব্যাপারটি জানতে পেরে স্বস্তিবোধ করেছি। এ ভাষা-আন্দোলন যে বাঙালি সত্তার শিকড় তা বুঝেছি অনেক পরে, অনেক চড়াইউৎরাই ঘটনা প্রবাহের ফলে। তবে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ায় যে তার প্রথম প্রতিবাদ তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন ছিল নানা কারণে ভীতিপ্রদ। একদিকে পূর্ববঙ্গবাসী, বাঙালি, অপরদিকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য, হিন্দু। তখন থেকে মানুষের মানসিকতায় চরম পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। সংখ্যালঘুরা যে পাকিস্তানের নাগরিক এ কথাটা সংখ্যাগুরুরা কিছুতেই বুঝতে চাইত না, এমন কী এদেশের নাগরিক বা অধিবাসী হয়ে বসবাস করি, তা কোনো অবস্থায় মানতে চাইত না। যারা ছিল প্রতিবেশী, সুজন-সজ্জন তারা আস্তে আস্তে অপরিচিত হয়ে উঠতে লাগল, নিজ জন্মভূমিতে পরবাসী হয়ে যেতে লাগলাম। মানসিক স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলার উপক্রম হলো, যাঁদের সুযোগ ছিল, আত্মমর্যাদাবোধ ছিল তাঁরা দেশত্যাগী হলেন অনেকটা নিঃস্ব অবস্থায়। এ অবস্থায় ১৯৬১ সালে মেট্রিক পাশ করি। কলেজে ভর্তি হই, ১৯৬৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করি। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যখন সংখ্যালঘু হিন্দুরা বিপর্যস্ত, আমি বি এ অনার্স ক্লাশের ছাত্র, আমার পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। দেশে থাকব, না ভারতে চলে যাব। পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন পিতা-পিতামহ। সবদিক দিয়েই এক অজানা আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা, ভবিষ্যৎ বলে কোনো ইঙ্গিত অনুপস্থিত। শুধুই হতাশা এবং আভ্যন্তরীণ মৃত্যু যন্ত্রণা। প্রায় এক বছর কাটল এভাবে, আসল ১৯৬৫ সাল। পাক-ভারত যুদ্ধ, ১৯৬৬ সাল রাজনীতির নতুন মেরুকরণ- ৬ দফা পেশ হলো। ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারলাভ ঘটল। পূর্বপাকিস্তানকে শোষণের যাঁতাকলে নিশ্চিষ্ট করার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়ার অভিপ্রায়ে জেগে ওঠা অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার জন্য মামলা-হামলা এবং শেষ পর্যন্ত আগরতলা ষড়যন্ত্রের ঐতিহাসিক মামলা রুজু করা হলো। এই অস্থির সময়ের মধ্যে ১৯৬৬ সালে অনার্স ও ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করি। এবং ১৯৬৮ সালের মে মাস থেকে চট্টগ্রাম রাঙ্গুনীয়া কলেজে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে চাকুরি শুরু করি। এ সকল কথা বলছি এজন্য যে আমার গোটা ছাত্রজীবন ভাষা আন্দোলন থেকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পর্যন্ত কেটেছে। সবকিছুই প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি, অনুধাবন করেছি। যাপিত বিশ্বাস-আদর্শ লালন করেছি। কিন্তু প্রকাশ্যে সংশ্লিষ্টতা থেকে দূরে থেকেছি। কারণ, এক অজানা ভীতি দেশটা পাকিস্তান, ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু, ভারত হলো হিন্দুস্থান সুতরাং জন্মগতভাবে দেশীয় নাগরিক হওয়া যেন প্রশ্নবিদ্ধ। সংশ্লিষ্টতা ছিল জাতশত্রুর অভিজ্ঞান। অবস্থানগত স্থিতি বলতে যা বুঝায় তা ছিল অলীক। তাই আদর্শগত চিন্তা-চেতনা ও মানসিকতা ছিল সুপ্ত ও পলায়নমুখী। এ অবস্থায় ৬৯-এর আন্দোলন বা গণজাগরণ অথবা বাঙালি চৈতন্যের অভ্যুত্থান আত্মপ্রত্যয়ী হবার একটা সুযোগ এসে যায় এবং শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের সামনে নিজেকে তুলে ধরার প্রয়াস পাই। কারণ, তখন পূর্বপাকিস্তানবাসী তথা বাঙালি আপন ঠিকানা খুঁজে পেতে থাকে। শত্রুমিত্র চিহ্নিত করার প্রয়াস পায় এবং এতদিন যাদের আপন বৈঠকখানায় আদরযত্ন করেছে তারা যে অন্দরমহলে অনুপ্রবেশের অনুপযোগী তা টের পেয়ে যায়। বাঙালি আস্তে আস্তে অসাম্প্রদায়িক হতে থাকে, আত্ম অধিকার লাভে জাতিসত্তার নতুন ব্যাখ্যা আবিষ্কার করে এবং সগোত্রিয় ভাবনায় নিজেদের পরিচিতি মন্ডলকে সার্বজনীন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে থাকে। তার প্রত্যক্ষ ফসল হলো ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং জাতিসত্তার 'নবজাগরণ, চৈতন্যের জয়গাথা এবং বাঙালির বিজয়। এ বিজয় কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, অপরিকল্পিত হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কারিশমাও নয়। আমি বলব স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা, তাই তা অপ্রতিরুদ্ধ, আপসহীন। 'বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই ।' -তাই তো ১৯৭১ সাল- মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতাযুদ্ধ। এই যুদ্ধকালীন আমার ঠিকানা কোথায় ছিল, কীভাবে নয়টি মাস কাটিয়েছি। কী কাজ করেছি তা বলার জন্যই এই ভূমিকা বা প্রাক-কথন ।
(ক্রমশঃ)
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫