আবুল কাশেম হৃদয় ||
(পূর্বে প্রকাশের পর)
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে এ কনভয় যাওয়ার খবর আগেই সুয়াগাজী ও পিপুলিয়া আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছে। পিপুলিয়ায় এ দিন একটি জনসভায় হয়। সেখানে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। জনসভা থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের নির্দেশে সুয়াগাজী রাস্তার পাশে গাছ কেটে ফেলে বাঁধা সৃষ্টি করা হয়। পরে লালবাগ ও শামুকসারের কাছে ব্রিজের উপর ব্যারিকেড সৃষ্টির সময় পাক কনভয় এগিয়ে আসে। এসময় ব্যারিকেড সৃষ্টিকারীরা ব্রিজের নিচে আত্মগোপন করে আত্মরক্ষা করে। এ ব্যারিকেড পাক কনভয়কে রুখতে পারেনি তবে সামান্যতম বিঘ্ন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়।
রাজপথ রক্তে রঞ্জিত
২৫ মার্চ গভীর রাতে এবং ২৬ মার্চ প্রত্যুষে কুমিল্লার বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন পেশার অসংখ্য লোককে ধরে নিয়ে হত্যা করলেও রাজপথে বর্বর বাহিনীর অত্যাচার শুরু হয় ২৬ মার্চ সকালে। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের সামনে থেকে পাক বাহিনীর জীপে স্থাপন করা ষ্টেনগান গর্জে ওঠে তখন। ঘাতকের বুলেটে অবস্থা দেখতে আসা উৎসাহী যুবক আবুল হোসেনের বুক ঝাঁজরা হয়ে যায়। আবুলের বুকের তাজা রক্তে প্রথম রঞ্জিত হয় কুমিল্লার রাজপথ। সে সময় গুলিবিদ্ধ আবুলের গগণবিধারী আর্ত চিৎকারে মর্মস্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় আবুলের সঙ্গে ছিল কামাল, খোকন ও জাহাঙ্গীর নামে তিন যুবক। তারা প্রাণে বেঁচে যান। তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মো: ওমর ফারুক আবুলকে ডাক্তারের কাছে নেয়ার পথে সে শহীদ হয়।
প্রথম পাকসেনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানিরা এ দেশে নিরস্ত্র বাঙালির উপর যে তাণ্ডবলীলা চালায় তার প্রথম প্রতিরোধ হয় এই কুমিল্লায়। সংগ্রামী ঐতিহ্যের গর্বিত উত্তরাধিকার নিরস্ত্র কুমিল্লাবাসী সর্বাঙ্গে দেশে পাক সৈন্যদের নির্মম অত্যাচারের প্রতিরোধ করে।
’৭১ এর মার্চ দ্বিপ্রহরে দেবিদ্বার থানার জাফরগঞ্জ বাজার ও তৎসংলগ্ন এলাকার জনগণ হঠাৎ গুলির শব্দে চমকে ওঠে, কিছুক্ষণের মধ্যেই জানতে পারে আখাউড়া থেকে এসে সাতজন পাকসেনা জাফরগঞ্জ বাজারের মসজিদে আশ্রয় নিয়েছে। জাফরগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজন বিভিন্ন অস্ত্র, মরিচের গুড়া, বালু ইত্যাদি নিয়ে মসজিদটি ঘিরে ফেলে। মসজিদে অবস্থানরত পাকসেনারা তখন জনতার উপর গুলি ছুঁড়তে থাকে। নিরস্ত্র জনসাধারণের প্রতিরোধের সংবাদ বুড়িচং থানায় পৌঁছলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বার্তা বাহকের কাছে ৯০টি রাইফেলের গুলি দিয়ে দেয়।
পূর্বাহ্নে তবদল হোসেন অসম্ভব সাহসিকতায় সঙ্গে মসজিদের জানালা দিয়ে পাকসেনাদের দুটি রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে আসে এবং পরক্ষণে আরো একটি রাইফেল হস্তগত করার জন্য এগিয়ে গেলে পাকসেনাদের গুলিতে তিনি শহীদ হন। তবদল হোসেন কর্তৃক ছিনিয়ে আনা রাইফেলে ওসির দেয়া গুলি কাজে লাগানো হয়। এসময় বুড়িচং থানা থেকে পুলিশ কনষ্টেবল মোল্লা ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রতিরোধ আক্রমণে সুষ্ঠু নেতৃত্ব দেন এবং জনগণকে অহেতুক গুলিবিদ্ধ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেন। কনষ্টেবল মোল্লার সময়োচিত নেতৃত্বে এলাকাবাসী মসজিদে অবস্থানরত ৭জন পাকসেনার মধ্যে তিনজনকে মসজিদের জানালা দিয়ে হত্যা করতে সমর্থ হয়। এ সময় কংশনগরের আলতাফ আলী, আবদুল সাত্তার (আনছার) সহ আরো কয়েকজন মসজিদের পিছন দিয়ে ছাদ ছিদ্র করে কাপড়ের মধ্য মরিচের গুড়া দিয়ে আগুন লাগিয়ে মসজিদের ভিতরে ফেলে দেয়। এতে বাকি চারজন মসজিদের বাইরে আসতে বাধ্য হয়। উপস্থিত জনতা প্রচণ্ড আক্রোশে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এই প্রতিশোধ আক্রমণে কংশনগরের ফজর আলী, তবদল হোসেন, বাদশা মিয়া, চান্দিপুরের এক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক লোক, মনোহরপুরের একজন, বারা গ্রামের চারজন, গুড়ার চরের একজন শহীদ হন। জাফরগঞ্জ মসজিদ সংলগ্ন এলাকা আসার পথে এই পাকসেনারা অন্তত ৩২ জনকে হত্যা করে।
৩১ মার্চের এই প্রতিরোধ সংঘর্ষ ছিল পাকসেনাদের সঙ্গে দেশের নিরস্ত্র জনসাধারণের প্রথম সংঘর্ষ। এর পূর্বে চট্টগ্রামের বেঙ্গল রেজিমেন্টের বঙ্গ শার্দুলের সঙ্গে পাকসেনাদের সংঘর্ষ হয় যা ছিল সামরিক অস্ত্রে সজ্জিত ও সুপরিকল্পিত যুদ্ধ।
কুমিল্লার প্রথম রণাঙ্গন
২৫ মার্চ সিলেটের জকিগঞ্জে পাকবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের সুবেদার আবদুল জলিল সরকার দায়িত্ব পালন কালে বিশেষ বার্তা পেয়ে কুমিল্লা আসেন। রেললাইন এলাকায় পৌঁছার পর পাকবাহিনীর তাণ্ডবলীলা সম্পর্কে অবগত হয়ে ক্যান্টমেন্ট না গিয়ে জাঙ্গালিয়া পাওয়ার স্টেশনের যাওয়ার মনস্থ করেন। সেখানে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪নং ব্যাটালিয়ানের একটি প্লাটুন ছিল। সেই প্লাটুনের কমাণ্ডার ছিলেন তাঁরই ছাত্র নায়েব সুবেদার আবদুল জলিল। তিনি যখন জাঙ্গালিয়া আসছিলেন তখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের (ডিগ্রী শাখা) কাছে একটি জীপ গাড়ি থেকে কতিপয় সামরিক লোক খেলাচ্ছলে তিনজন বাঙালি লোককে গুলি করে হত্যা করে। সুবেদার জলিল কোন রকমে জাঙ্গালিয়া পৌঁছান এবং প্লাটুনে ৩০জন সিপাই, এনসিওর জন্য একমাসের রশদ, ৬টি হালকা মেশিনগান, দুটি ষ্টেনগান, চাইনিজ রাইফেল ও গোলাবারুদ রয়েছে। সুবেদার জলিল প্লাটুনের দুজন হাবিলদার ও অন্যান্যদের সঙ্গে আলাপ করে পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। সুবেদার জলিল পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সক্রিয় সংগ্রামের পরিকল্পনা করেন এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাঁর ছাত্র নায়েব সুবেদার জলিলের উপর দায়িত্ব দিয়ে লাকসাম চলে আসেন।
২৭ মার্চ সকালে লাকসামে এসে আবদুল আউয়াল এমপি এ, জালাল আহাম্মদ এমপিএ প্রমুখ নেতৃবৃন্দকে তাঁর পরিকল্পনা অবগত করেন। নেতৃবৃন্দ সুবেদার জলিলকে সাহায্য করার আশ্বাস দেন কিন্তু পাকবাহিনীর তৎপরতা লক্ষ্য করে পরিকল্পনা বাতিল করেন। ২৮ মার্চ সন্ধ্যায় পুরো প্লাটুন নিয়ে লাকসামের মনু মিঞার বাড়িতে যান এবং সেখান থেকে বাগমারা হাই স্কুলে ফিরে এসে চাঁদপুর সড়কের পাশে প্রতিরোধ লাইন গড়ে তোলেন। আবদুল আউয়াল এমপিএ এবং জালাল আহাম্মদ এমপিএ সুবেদার জলিলের প্লাটুনের যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সুরুজ মিয়া সর্বাত্মক সাহায্য করেন এবং কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। এরপরই শুরু হয় সক্রিয় সংগ্রাম।
৩১ মার্চ বেলা তিনটায় নায়েব সুবেদার জলিল তিনজন সিপাই নিয়ে কুমিল্লা বিমান ঘাটির দক্ষিণ প্রান্তের একটি ধান ক্ষেত থেকে হালকা মেশিনগানের সাহায্যে পাকবাহিনীর মালবাহী কালা রঙের বৃহদাকার বিমানকে আক্রমণ করে। বিমানটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত না হলেও কুমিল্লা বিমান বন্দরে দু’দিন মেরামত কাজ চালাতে হয়।
২ এপ্রিল ঐ এলাকার চাঁদপুর গ্রামে প্লাটুনের চারজন সিপাই সাতজন পাকসেনা-কর্তৃক আক্রান্ত হলে কয়েকজন পাকসেনাকে হত্যা করে। ঐ সংঘর্ষে সুবেদার প্লাটুনের দুজন শহীদ হয়।
* অনুরূপ অসংখ্য কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়, তার তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
* নাটকটির নাম, রচয়িতার নাম, শিল্পীদের নাম জানা যায়নি। (সমাপ্ত)
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক কুমিল্লার কাগজ।