ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
গণটিকায় উৎসবমুখর বাংলাদেশ
Published : Saturday, 5 March, 2022 at 12:00 AM
গণটিকায় উৎসবমুখর বাংলাদেশড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া ||
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ হিসেবে দেশজুড়ে শনিবার হয়ে গেল ‘এক দিনে ১ কোটি ২০ লাখ ডোজ টিকা ক্যাম্পেন। এক কোটি টিকা প্রদানের লক্ষ্য থাকলেও এদিন টিকা দেয়া হয়েছে ১ কোটি ২০ লাখ ডোজ। এর মাধ্যমে এখন পর্যন্ত দেশে প্রায় ২১ কোটি ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। এতে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৩ ভাগ এবং প্রথম ডোজের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। ১ কোটি ডোজের টিকা প্রদানের লক্ষ্য থাকলেও দিন শেষে প্রথম ডোজের টিকা পেয়েছেন ১ কোটি ১১ লাখ মানুষ এবং দ্বিতীয় ডোজের টিকা পেয়েছেন ৯ লাখ মানুষ। যা বিশ্বে নজিরবিহীন ঘটনা। এর আগেও এক দিনে ৮০ লাখ ডোজ টিকা দেয়ার সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এই কার্যক্রমকে সফল করতে ১ লাখেরও বেশি মানুষ কাজ করেছে। বিশ্বের বহু দেশেরই ১ কোটির বেশি মানুষ নেই। সেখানে দিনে ১ কোটি ডোজ টিকা দেয়ার সক্ষমতা আমাদের করোনা মোকাবেলায় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম করেছে এবং বিশ্বের ১০ম পর্যায়ে নিয়ে গেছে। করোনার সময়ে প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য খাতকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যার ফলে করোনা মহামারীকালীন বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সফলভাবে ভূমিকা রাখছে। টিকাদান কর্মসূচী শুরু থেকে একটু সমস্যা হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সঙ্কট কাটিয়ে উঠে চমৎকারভাবে টিকা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে আমাদের টিকা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে যা অত্যন্ত আনন্দের। এখন থেকে দেশে টিকা উৎপাদন হবে। আমাদের দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি এবং গরিব দেশকে বিনামূল্যে টিকা দেয়া সম্ভব হবে। সরকার টিকাদান কর্মসূচীকে জোরেশোরে এগিয়ে নিয়ে চলছে যা ইতিবাচক।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশে ভীতিপ্রদ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল যার ফলে প্রায় প্রত্যেকটি খাতে নেতিবাচক পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছে এবং মানুষের জীবনযাপনের স্বাভাবিকতাও বিঘ্নিত হয়েছে। করোনা মোকাবিলায় যেমন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ সতর্ক থাকা জরুরী, তেমনি টিকার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি দেশ যদি তার জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনতে পারে এবং টিকা নিশ্চিত করতে পারে তবে চলতি বছরের মধ্যে মহামারীর ভয়াবহতা শেষ হবে। তা ছাড়া, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, করোনা মহামারী মোকাবেলায় স্থায়ী সমাধান এনে দিতে অপরিসীম ভূমিকা পালন করতে পারে এই টিকা। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন অভিযানে বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে দেশে প্রথম গণটিকাদান কর্মসূচী শুরু করা হয় গত ৭ আগস্ট। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ওই কর্মসূচীর আওতায় ছয় দিনে দেশে প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছিলেন প্রায় ৫০ লাখ ৭১ হাজার মানুষ। এর পর রাজধানী ঢাকায় এ টিকাদান কর্মসূচীর দ্বিতীয় ডোজ চলে গত ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ঢাকার বাইরে চলে আরও তিন দিনব্যাপী এই কর্মসূচী ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এরপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে গত ২৮ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতর বিশেষ গণটিকাদান কর্মসূচী ঘোষণা করে। সে দিন দেশে ৬৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯২২ ডোজ টিকা প্রয়োগ হয়, যা বাংলাদেশে এক দিনে করোনাভাইরাসের টিকাদানের উল্লেখযোগ্য রেকর্ড তৈরি করেছিল।
বিভিন্ন সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের ভ্যাকসিনের বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও বিপুল সংখ্যক মানুষ টিকাবিহীন অবস্থায় ছিল। ভ্যাকসিন গ্রহণে তাদের ছিল দারুণ অনীহা। ভ্যাকসিন গ্রহণে তাদের এই অনিচ্ছা শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের জন্যই হুমকিস্বরূপ নয় বরং করোনা মহামারীর আক্রমণ শেষ করার জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলের যে সম্মিলিত প্রচেষ্টা সেটিকেও দুর্বল করে দিতে পারে অনেকাংশে। এ সকল পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার বিভিন্ন পরিষেবার জন্য ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করেছে। গণটিকা কর্মসূচী পরিকল্পনা গ্রহণসহ তা বাস্তবায়নে নিয়েছে নানা পদক্ষেপ। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার টার্গেট গ্রহণ করা হয়েছে এবং গত ২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রথম ডোজ গ্রহণের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এভাবে এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত দেশব্যাপী টিকাদান অভিযান পরিচালনার ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়। শুধু তাই নয়, দেশব্যাপী সুষ্ঠুভাবে করোনার টিকা বিতরণ ও প্রয়োগের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর গ্রহণ করেছে প্রয়োজনীয় জাতীয় পরিকল্পনা। টিকাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণ নির্দেশিকাও তৈরি করেছে যা খুবই যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। তা ছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবে ও জেলায় জেলায় স্বাস্থ্য কর্মীদেরও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
সুষ্ঠুভাবে টিকা বিতরণ ও প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় অতিরিক্ত টিকাদান কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ভ্যাকসিন গ্রহণের জন্য নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক ছিল, তবে যেহেতু এটি একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার তাই এই সময়োপযোগী পদক্ষেপ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই নিয়ম শিথিল করা হয়। ১২ বছর বা তার বেশি বয়সী যে কেউ এখন থেকে দেশব্যাপী যেকোনো কেন্দ্রে কোন রেজিস্ট্রেশন বা নথিপত্র ছাড়াই প্রথম ডোজ করোনা টিকা নিতে পারছেন। দেশজুড়ে সমস্ত টিকা কেন্দ্রের সামনে ভিড় করছে বিভিন্ন বয়সের টিকা প্রার্থীরা। একদিনেই প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ করে প্রথম ডোজের টিকা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও স্বাস্থ্য কর্মীরা তৃণমূল পর্যায়ে তাদের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে গণটিকাদান অভিযানের লক্ষ্য পূরণ করেছেন। এরই সঙ্গে সংক্রমণ সম্পর্কে সাধারণ জনগণের সচেতনতা আরও বাড়াতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৭৩ শতাংশকে একটি কোভিড ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছে, যা ৭০ শতাংশ জনসংখ্যাকে ভ্যাকসিনের কমপক্ষে দুটি ডোজ প্রদানের প্রথম পদক্ষেপটি পূরণ করেছে। টিকা প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে সারা দেশে প্রায় ২১ কোটি ডোজ কোভিড ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ১২ কোটিরও বেশি লোক প্রথম ডোজ, প্রায় ৮.৩ কোটি লোক দ্বিতীয় ডোজ এবং ৩৬.৩ লাখেরও বেশি লোক তৃতীয় ডোজ পেয়েছে যা গণটিকা কর্মসূচী পরিকল্পনার ফলস্বরূপ। করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে কমপক্ষে ৭০ শতাংশই টিকা দেয়ার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অবশ্যই স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে টিকাকেন্দ্রে উপস্থিত হওয়া হাজার হাজার মানুষের মধ্যে যাতে তারা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখে এবং অবশ্যই মাস্ক পরিধান করে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সচেতন হতে হবে যাতে অস্থায়ীভাবে নির্বাচিত টিকা বুথে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। একই দিনে বিপুল সংখ্যক লোককে টিকাদানের পরিবর্তে ধাপে ধাপে নির্দিষ্ট সংখ্যক টিকা প্রদান করা যেতে পারে।
আগে দেশে মাত্র ১৮ হাজার চিকিৎসক ছিল। কিন্তু গত ৫ বছরে সরকার নতুন করে ১৫ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছেন। আগে দেশে নার্স ছিল মাত্র ২০ হাজার। গত ৫ বছরেই আরও নতুন করে ২০ হাজার নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং আরও অনেক নার্স, চিকিৎসক ও টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেয়া হবে। এর সঙ্গে মৌলিক বিষয়ের চিকিৎসকও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তবে, সব কিছুর লক্ষ্য হচ্ছে ভাল মানের চিকিৎসাসেবা দেয়া। সেই ভাল মানের চিকিৎসা দিতেই সরকার স্বাস্থ্য খাতে জনবল নিয়োগ দিল। দেশের ইতিহাসে এত সংখ্যক নিয়োগ আর কখনও হয়নি। নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে অনেক দরিদ্র মানুষের ঘামে ভেজা উপার্জন তাদের পেছনে রয়েছে। চিকিৎসক হিসেবে একেকজন একেকটি প্রতিষ্ঠান এবং স্বাস্থ্য বিভাগের একেকজন এ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করবেন। এমনভাবে জনগণকে সেবা দিতে হবে, যেন চিকিৎসার পর কোন রোগীর মৃত্যু হলেও যেন রোগীর স্বজনরা চিকিৎসকের প্রশংসা করেন।
সকলের জন্য টিকা নিশ্চিত করার এই উচ্চাকাক্সক্ষা পূরণে বিশেষ গণটিকাদান অভিযান অবশ্যই একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সম্ভাব্য সকল উৎস থেকে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সংগ্রহ করার জন্য এবং সর্বস্তরের জনসাধারণের জন্য টিকার পর্যাপ্ত ডোজ সংগ্রহ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের কৃতিত্ব বিরাট। একটি সঙ্কল্পিত এবং সুসংগঠিত উপায়ে গণ টিকাদান অভিযান সফলভাবে পরিচালনা করার জন্য সরকার নিঃসন্দেহে প্রশংসারযোগ্য। আশা করি আমরা খুব শীঘ্রই কোভিড-১৯ মহামারীর সমাপ্তির পর্যায় দেখতে পাব, যা গত দুই বছরে পুরো বিশ্বকে একটি কঠিন এবং দুঃস্বপ্নের মতো উপস্থাপন করেছে।
করোনা নামক এই বৈশ্বিক মহামারী শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্বে ভয়াবহ ক্ষতিসাধন করেছে যা আসলে সহসাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। কিন্তু ক্ষতি যতটা সম্ভব পুষিয়ে নিয়ে যাতে আবারও পুরো উদ্যমে উজ্জীবিত হয়ে ওঠা যায় সে চেষ্টা সম্মিলিতভাবে করতে হবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনা করে এগিয়ে যেতে হবে যাতে করে বেকার সমস্যা দূরীভূত হওয়ার পাশাপাশি একটি প্রজন্ম শিক্ষার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে বঞ্চিত না হয়। মনে রাখতে হবে শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। অন্যথায় রাষ্ট্র এক গভীর সঙ্কটের দিকে ধাবিত হবে।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম এ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়