দৈহিক গড়ন নিয়ে কটাক্ষের শিকার ৭০ শতাংশ নারী: জরিপ
Published : Sunday, 6 March, 2022 at 12:00 AM
দৈনন্দিন জীবনে ঘরে এবং বাইরে ৭০ শতাংশ নারী তাদের চেহারা, গায়ের রং, উচ্চতাসহ দৈহিক গড়ন নিয়ে নানা ধরনের বিরূপ মন্তব্যের শিকার হচ্ছেন বলে এক জরিপে উঠে এসেছে।
‘তরুণীদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব’ শীর্ষক এক জরিপে এমন তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন।
শনিবার ভার্চুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস সামনে রেখে পরিচালিত এই সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ।
জরিপের তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ৬৯ দশমিক ৯২ শতাংশ তরুণী তাদের শারীরিক অবয়ব নিয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন।
এদের মধ্যে ৩৭ দশমিক ২৪ শতাংশ তরুণী বলছেন, শরীরের আকৃতি ,গঠন এবং অবয়ব নিয়ে আত্মীয়রাই কথায় ও ইঙ্গিতে হেয় প্রতিপন্ন করেন তাদের। এছাড়াও বন্ধুবান্ধবের কাছে বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২ শতাংশ।
আর ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ তরুণী বলেছেন, পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেও এ ধরনের মন্তব্য শুনেছেন তারা।
বিভিন্ন জেলা এবং বিভাগের ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী এক হাজার ১৪ জন শিক্ষিত তরুণী জরিপে অংশ নেন। এদের মধ্যে ৮৮ দশমিক ১৭ শতাংশ অবিবাহিত , ১০ দশমিক ৯৫ শতাংশ বিবাহিত এবং বাকিরা আর সংসার করছেন না।
প্রতিদিনের জীবনে নারীরা কতটা বৈষম্য, লাঞ্ছনা, যৌন হয়রানি, সমাজ ও পরিবারের বাধা এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সম্মুখীন হয়েছেন এবং সেসব ঘটনা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে কেমন প্রভাব ফেলেছে তা এই জরিপে তুলে ধরা হয়।
দেখা গেছে, ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ তরুণীকে পথচারীর কাছে থেকে শারীরিক অবয়ব নিয়ে নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে। ওজন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হন ৩৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ তরুণী।
আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, গায়ের রঙে নিয়েও ৩৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ তরুণী এ ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান। এছাড়া উচ্চতা, মুখাবয়বের গঠন ও দাগ, কণ্ঠস্বর নিয়েও নানা বিরূপ কথা শুনেছেন তরুণীদের অনেকেই।
জরিপে অংশ নেওয়া ২৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ তরুণী মনে করেন, আর্থিক অস্বচ্ছলতা তাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। পাশাপাশি বেকারত্বের কারণে ১৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ তরুণী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন।
সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়ে ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং যৌন নিপীড়নের কারণে ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ তরুণী মানসিকভাবে প্রভাবিত হন।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিনিয়ত হেয় প্রতিপন্ন হলে একজন মানুষের আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং হীনমন্যতা কাজ করে। পরে এসব ঘটনা আত্মহত্যার অনুঘটক হিসেবেও ভূমিকা রাখে।
সমীক্ষা বলছে, পারিবারিক টানাপোড়েন তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যে সবচেয়ে প্রভাব ফেলে; যা ৩১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বাবা-মা অথবা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া ২৭ দশমিক ৩২ শতাংশের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
সংবাদ সম্মেলনে আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, জরিপে অংশ নেওয়া ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ তরুণী নিজেদের সম্মতি না থাকার পরও পরিবার থেকে বিয়ের চাপের সম্মুখীন হন।
এদের মধ্যে ১০৯ জনের পরিবার পরে বিয়ে না হওয়ার ভয় থেকে এমন চাপ সৃষ্টি করেন। ‘কমবয়সী মেয়েদের ভালো বর হয়’ এমন ধারণার কারণে ৮৬ জনের উপর পারিবারিকভাবে বিয়ের চাপ আসে।
জরিপে অংশ নেওয়া ৮৫ জন তরুণীকে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে শিক্ষাবর্ষ দীর্ঘায়িত হওয়ায় বিয়ের চাপ মোকাবেলা করতে হয়েছে।
এছাড়া ২২ দশমিক ২৯ শতাংশ তরুণীর মতামতকে পরিবারে মূল্যায়ন করা হয় না। শুধুমাত্র নারী হবার কারণে মতামত প্রকাশে বাধার মুখে পড়তে হয় ৪৬ দশমিক ২৫ শতাংশকে।
সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ৬৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ তরুণী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ তরুণী বলছেন, তারা বিকৃত যৌন ইচ্ছার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বা কুদৃষ্টির মাধ্যমে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন।
২৯ দশমিক ৬২ শতাংশ তরুণীকে আপত্তিকর স্পর্শের ভুক্তভোগী হতে হয়েছে। আর বিভিন্ন স্থানে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২ দশমিক ২৬ শতাংশ।
সমীক্ষা বলছে, ৪৫ দশমিক ২৭ শতাংশ তরুণী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। গণপরিবহণে আপত্তিকর স্পর্শের শিকার হন ৬৪ দশমিক ৯২ শতাংশ তরুণী। ২০ দশমিক ৪ শতাংশ কুদৃষ্টি এবং অনুসরণের শিকার হয়েছেন।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বাস এবং বাসস্ট্যান্ডে যৌন হয়রানির সম্মুখীন হন ৮৪ দশমিক ১০ শতাংশ তরুণী।
এছাড়া রেল যাত্রায় বা রেল স্টেশনে ৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ তরুণী যৌন হয়রানির শিকার হন।
জরিপে বলা হয়, তরুণীরা সবচেয়ে বেশি আপত্তিকর স্পর্শের শিকার হন একা চলার সময়; যা ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।
তবে ২১ দশমিক ৫৭ শতাংশ জানিয়েছেন, সঙ্গে মা-বোন, বান্ধবী কিংবা অন্য নারী সঙ্গী থাকা অবস্থাতেও তাদের এমন অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়েছে।
২ দশমিক ৮৩ শতাংশ তরুণী এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন যখন সঙ্গে বাবা, স্বামী, ভাই অথববা অন্য পুরুষ সঙ্গী ছিল।
৩৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ তরুণী তাদের শৈশবে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন বলে জরিপে উঠে এসেছে।
এর মধ্যে আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে ৩৫ দশমিক ২৮ শতাংশ, অপরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে ২৮ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রতিবেশীদের কাছে যৌন হয়রানির শিকার হন।
শৈশবের এসব ঘটনা ২৮ দশমিক ৪৩ শতাংশের মনে সবার প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম দেয় এবং ২৮ দশমিক ১৭ শতাংশের ভেতর পুরুষ বিদ্বেষী মনোভাব সৃষ্টি হয়।
জরিপ বলছে, শৈশবের এসব অভিজ্ঞতার জেরে বড় হওয়ার পরও ১৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ তরুণী একা থাকতে ভয় পান।
এছাড়া অনেকেই পরে বিয়ে করতে বা শারীরিক সম্পর্কে জড়াতেও ভয় পান বলে জরিপের তথ্যে বলা হয়।
জরিপে অংশ নেওয়া তরুণীদের ৪৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ অনলাইনে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন বলে জানানো হয়।
এর মধ্যে অবান্তর এবং কুরুচিপূর্ণ মেসেজ পাঠিয়ে এবং মন্তব্য করে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে ৬১ দশমিক ১২ শতাংশ তরুণীকে।
সোশাল মিডিয়ার আইডি হ্যাক হয়েছে ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ তরুণীর। ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল ছবি নিয়ে দুর্ভোগ পোহান। ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ তরুণী জানান, তাদের আইডি স্টক করা হয়।
নারীদের নিয়ে এই জরিপের ফলাফল প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে গুরুত্ব দেন।
তিনি বলেন, “সচেতনতার পাশাপাশি তাদের পর্যাপ্ত মানসিক সমর্থন করতে হবে এবং বোঝাতে হবে যে জীবন এতো মূল্যহীন নয়। আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
“সেই সাথে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও সকলকে সচেতন করতে হবে। সর্বোপরি নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে নয় বরং মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহীন মোল্লা বলেন, “মেয়েদের আন্তঃব্যক্তিগত যোগাযোগের ক্ষেত্রে অ্যাসারেটিভ হতে হবে। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে নিজের মনোভাব সরাসরি বলতে হবে।
“মেয়েরা কোনো সমস্যায় পড়লে বসে না থেকে তাদের বন্ধু, রাষ্ট্র, মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ থেকে সাহায্য নিতে পারে। কোথাও না কোথাও তাদের সকল সমস্যার সমাধান আছে।”
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সিআইডি এবং সাইবার ক্রাইম ইউনিটে এসব সমস্যা নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “তাদেরকে হিউম্যান সাইকোলোজির বিভিন্ন ট্রেইনিংয়ের আওতায় আনতে হবে। কারণ সমস্যা সমাধান শেষ নয়, সমস্যাগুলো গোড়া থেকে রুখে দিতে হবে আমাদের।”
আলোচনায় অংশ নিয়ে সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের সহকারী পুলিশ কমিশনার সুরঞ্জনা সাহা বলেন, “বাংলাদেশে ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি আস্থার প্রতীক হলেও সামাজিক অশুভ প্রয়োগ ও ব্যক্তিগত দায়িত্বহীনতার দরুণ অনেক নারীর কাছে তা এক আতংকের নাম।
“সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে সাইবার জগতকে নারীদের জন্য নিরাপদ রাখা জরুরি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার বিধি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান, ব্যক্তিগত সচেতনতা ও পারিবারিক শিক্ষাই পারে সাইবার দুনিয়াকে সুরক্ষিত রাখতে।”
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রজেক্ট লিড মো. রিফাত হাসান তরফদার বলেন, “রাস্তায়, গণপরিবহনে, এমনকি উন্মুক্ত স্থানেও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে অহরহ। পরিবারের মাঝেও নিরাপদ নয় নারী।
“নারীদের বিচরণের প্রতিটি মাধ্যম হতে হবে স্বচ্ছ ও নিরাপদ। তবেই আমরা নারী জাগরণ, নারী মুক্তি নিয়ে কথা বলতে পারব। তা নাহলে এই ব্যর্থতা আমাদের পরিবারের, আমাদের সমাজের, আমাদের সকলের।”
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, “একুশ শতাব্দীতে এসে নারীরা যখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছেন তখনও আমাদের দেশের নারীদের নানাবিধ কারণে থমকে দাঁড়াতে হয়।
“আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এবং পরিবার প্রতিষ্ঠিত নারীদের সাথে মানিয়ে নিতে এখনও যথাযথভাবে প্রস্তুত নয়। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাদেরকে স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।”
মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও আত্মহত্যার ঝুঁকি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে আঁচল ফাউন্ডেশন ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে।
নারীর সুরক্ষায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর উপর মনিটরিং জোরদার করা, বাস-রেল ও রাইড শেয়ারিং অর্থাৎ সব ধরনের গণপরিবহন ও তার স্টপেজে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, নারীর চলাচলক্ষেত্রে তার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকে আইনি বাধ্যবাধকতার আওতায় নিয়ে আসা, শৈশবকালীন যৌন হেনস্তা ও বডি শেমিং থেকে রক্ষা করতে পরিবারগুলোকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি সব নারী শিক্ষার্থীকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আত্মরক্ষামূলক ট্রেইনিং দেওয়ার কথা নিজেদের প্রস্তাবনায় তুলে ধরেছে এই সংগঠন।