গল্পগ্রন্থঃ জবাসংহিতা এর পাঠ প্রতিক্রিয়াবয়ানের শক্তিমত্তায় জীবনের খতিয়ান যেভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয়কাজী মোহাম্মদ আলমগীর ||
জবা সংহিতা
সানাউল্লাহ নূর
কথাশিল্পী
সানাউল্লাহ নূর এর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘জবা সংহিতা’য় মানব জীবনের বিচিত্রতর
ঘটনার উল্লেখ দেখা যায়। অতিপ্রাকৃত ঘটনা, মৃত্যু পরবর্তী জীবনের আগম নিগম
আবর্তন নিবর্তন রোমহর্ষণ, অর্থনৈতিক উল্লম্ফন - কালো সুবিধা ও লুণ্ঠন,
শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকার অদম্য সাহস, লুটেরারোধী নতুন ভাষ্য
উন্মোচন, গর্ভ ভাড়ার বেনিয়াপনা, মহান যুদ্ধের সুবিধাভোগীদের ক্রিড়াকেত্তন
ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলো ফেলেছেন গল্পকার সানাউল্লাহ নূর তার গল্পগ্রন্থ
‘জবাসংহিতা’য়। বয়ানের নিজস্ব ভাষা শৈলীতে তিনি পাঠককে গল্পে মগ্ন রাখতে
পারঙ্গম। গল্প বলার বৈঠকি ঢং তার মজ্জাগত। গল্প প্রকরণে সচেতন সানাউল্লাহ
নূর।
‘জবাসংহিতা’র প্রথম গল্প ‘একটি মৃত্যুকে ঘিরে’।
লেখক যাচ্ছিলেন সাগরদি। সাগরদি কুর্মপৃষ্ঠের মতো ভাসমান দ্বীপ। দ্বীপটি সুন্দর। লেখক বলছেন, ‘যাচ্ছি একা একা।’
এই কথা কেন বলছেন, আমরা মনে রাখতে পারি এই প্রবণতার নযুল খুঁজে দেখার জন্য।
কিছুক্ষণ
পর লেখক আবার বলেন, ‘ আলতাপ দাদা বলতেন, মন্দভাগ্য হলে রাস্তাঘাটও রহস্যময়
আচরণ করে। তখন চেনা পথ অচেনা হয়ে যায়। দূরের পথ কাছে আর কাছের পথ দূরের
হয়ে যায়।’
বগাদিয়া থেকে রিক্সা নেয়ার পর রিক্সার ফর্ক ভেঙে যায়।
লেখক
সূর্য দেখেন, ‘লালবৃত্ত সূর্যের মাথার উপর ভেসে বেড়াচ্ছে একদল ধোঁয়াশা
কালো মেঘ।’ অবশেষে তিনি বলেই ফেলেন- ‘পথে ভয় পাওয়া লোকেদের মতো দ্রুতই
হাঁটছিলাম আমি।’
আর তখনই এক বুড়ির দেখা পেয়ে যান লেখক। বুড়ি যাবে বড়বাড়ি গোরস্তান পর্যন্ত। এ পথের মানচিত্র লেখকের চেয়ে বুড়ি চেনে বেশি।
দ্বৈত
নিরবতার মাঝখান দিয়ে একটা সাদা বিড়াল ডান পাশের ঝোপ থেকে বেড়িয়ে রাস্তা
পার হয়ে যায়। একটি প্রকাণ্ড বটগাছ, লেখকের মনে হয় বট গাছটি কিছুক্ষণ আগে
এখানে গেড়ে বসেছে এবং অদ্ভুতভাবে কথা বলছে। (সাজুয্যঃ তারাশঙ্কর
বন্দোপাধ্যায়ের ‘ডাইনী’ গল্পের বৃক্ষের আচরণ। ডাইনী গল্পের বুড়িও ভিক্ষা
করে। মিলের মধ্যে এইটুকুই। )
সন্ধ্যার অন্ধকার সম্পর্কে লেখকের কথার পিঠে বুড়ি বলে, ‘অন্ধকার তো নামবই, আলো অন্ধকারই-তো জগতের নিয়ম,...।’
এই
বুড়ি তো সাধারণ বুড়ি নয়। দার্শনিক বুড়ি। বুড়ি যাচ্ছে মৃত এক হাফেজার কবর
দেখতে। হাফেজার কী করে মৃত্যু হলো, হওয়ার পর তার লাশ মসজিদের সিঁড়ির পাশে
পরে থাকে,তখন মসজিদ কমিটির লোকজনের কী প্রতিক্রিয়া হয়, হাফেজার
ভিক্ষাবৃত্তির দীনহীন জীবনে পুরুষ মানুষগুলো কী অবস্থার ভেতর তার জৈব
অস্তিত্বকে ভোগে ও ভাগে নিয়েছিল-বুড়ি নির্ভূল বয়ানে লেখককে শোনায়। এর ভেতর
মৃত হাফেজাও মসজিদ কমিটির লোকজনের কথা শোনে এবং মন্দ কথার উত্তর দেয়।
আমরা
দেখতে পাই গল্পটি মোট তিনজনে বয়ান করছেন। লেখক, বুড়ি এবং মৃত হাফেজা। এই
নির্মিতি সহজ নয়। লেখক গল্পের সকল সৌষ্ঠবতার মাত্রা ঠিক রেখে এর বয়ন কর্ম
সম্পাদন করেন। জবাসংহিতা জাদুবাস্তবতা বা অতিপ্রাকৃত গল্প কি না প্রশ্ন
অবান্তর। গল্পের শেষ লাইনে বিস্ময় লুকিয়ে থাকে আমাদের জন্য। আমরা সেই
বিস্ময় লেখকের বয়ানে শুনতে পারি।
‘মনাদের বাড়ির সন্নিকটে এসে পড়লাম
আমরা। বুড়ির গল্পও ফুরিয়ে এল। ঠিক তখনি মেঘের বুকচিরে এক বজ্র আলোর
ঝলকানিতে উদ্ভাসিত হলো চারদিক। ক্ষণিকের আলোতে বুড়ির দিকে নজর পড়ল আমার।
দেখলাম অদ্ভুত এক কবন্ধ নারীদেহ লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যাচ্ছে আমার সামনে দিয়ে।
ভীতিকর শব্দে তখন চিৎকার দিয়ে উঠলাম, কে তুমি? ততক্ষণে ধোঁয়াশা আকৃতিতে
রুপান্তরিত অবয়ব থেকে উত্তর এল - আমিই হাফেজা।’
পাঠককে আমরা মনে রাখার
জন্য বলেছিলাম নযুল খুঁজব। লেখক কী পরিবেশন করবেন তা আকারে ইঙ্গিতে
বলছিলেন, একা চলাতে যাওয়া ভয় পাওয়ার গল্প, ভয়ের রোমাঞ্চ - এই হলো নযুল।
এই
গল্পের একটি বিপরীত পাঠ দরকার। বিপরীত পাঠে প্রশ্ন তোলা যায়, এ গল্পটি কি
একবারে নতুন ? আমাদের গ্রাম বাংলার আব্দুল করিম, আব্দুর রহিম, যদুনাথ,
মধুসেনকে জিজ্ঞেস করলে তারা একবিন্দু অবাক হবে না। তারা বলবে, এমন গল্প
প্রতিটি গ্রামে একটি করে আছে। একা চলতে গিয়ে ভয় পাওয়ার গল্প আমরা বহু
শুনেছি। তাহলে প্রচলিত এই গল্পের শংসার কি প্রয়োজন আছে! গ্রামের মানুষ
একবিন্দু অবাক হয় না স্বাভাবিক থাকে, ইহাই স্বাভাবিক। চেনা বর্গ, চেনা
বর্গকে নিয়ে কীভাবে বিস্মিত হবে! ঠিক এই কারনেই বিপরীত পাঠের প্রশ্নের
উত্তরটিও কথাশিল্পী সানাউল্লাহ নূরের পক্ষে যায়। তিনি প্রান্তিক মানুষের
গল্প লিখেছেন। নিম্নবর্গের (সাবলটার্র্ন) মানুষের গল্পই লিখেছেন। তাই এ
গল্প পড়া দরকার, (পাঠকের খুশি পাঠকের মইচ ক্ষেত)।
নিম্নবর্গের মানুষের
প্রতিদিনের সমস্যা এবং সমস্যা উত্তরণের নীতি এবং নীতিরোধী প্যারাডক্স এ
গল্পে বেশ কতেক উল্লেখ করার মতো। আমরা তার বর্ণনায় লক্ষ্য করতে পারি-
‘একখানা
একতলা পাকা মসজিদ দাঁড় করাবার বড় শখ হাজি সাবের। সভাপতি হওয়ার পর প্রথম
জুমায় মুসুল্লিদের সেই আশার কথা জানিয়েছেন তিনি। গরিব এলাকা। দান খয়রাত খুব
কম মিলে। তার ওপরে এর আগেরবারের খতিব ছিল অতিকথার লোক। হালাল-হারাম, ঘুষ-
চোরাচালান, ফটকাবাজি-মজুদদারি এসব বিষয়ে ওয়াজ করে দানবাক্সের বারোটা
বাজিয়েছিল।.. .. জুমা প্রতিতিনশ-চারশ টাকার স্থলে নেমে আসে পঞ্চাশ-ষাট
টাকায়।’
এইসব মানুষের বাঁচামরার প্রণালী নানা যুক্তিতে ঢুক পড়েছে এ
গল্পের ন্যারেটিভে। হাফেজা মরেছে মসজিদের সিঁড়ির পাশে। হাফেজা মরেছে
শুক্রবারে। একজন বলে, হারামজাদির নসিব ভালা। লেখক কী প্রতিশোধ নিচ্ছেন?
প্রান্তিক মানুষের প্রান্ত ধরে টেনে টেনে সব বের করে ফেলছেন; তথাকথিত নগর
সভ্যতার বিপরীত তুমুল-অসৌন্দির্যের জীবন দৃশ্য-ও দর্শন দেখাতে। এসবকে
অসৌন্দির্য বলার অধিকারইবা আমাদের কে দিল? লেখক প্রশ্ন বা উত্তর কোনটাই
গ্রহণ না করে সাবলিল থাকেন অন্য প্রমানে। তিনি প্রান্তিক মানুষের জোড়াতালি
দেয়া জীবন, জীবনের পাপ-পূণ্যবোধ এমনকি নাম ও পেশা নিয়েও সামান্য
বিবমিষাতে ভোগেন না। তিনি তাফসির রাখেন এভাবে, ‘ এরমধ্যে আরো দু-তিনজন
মুসুল্লির আগমন ঘটে। দুজনকে হাফেজা চিনতে পারে। এদের মধ্যে একজন নজির
সারেঙের বড় ছেলে দুলাল,অন্যজন হুদুইন্যা চোরার ভাই শাইম্যা।’
তাফসিরে
ধীরে ধীরে একটি অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের আর কোন রাখঢাক থাকে না। অশরীরি
হাফেজা একটা অঞ্চলের শরীরি উপস্থপন ও বিস্তার ঘটায় সানাউল্লাহ নূরের
ধৈর্য্য ও কৌশল গুণে।
দ্বিতীয় গল্প ‘খোয়াজ খিজিরের সন্ধানে’। বাংলাদেশে
বহুল প্রচলিত ‘খাজা’ শব্দ, ‘খোয়াজ’ শব্দরই ভ্রংশ। আরবি এবং ফারসি জানা লেখক
সানাউল্লাহ নূর তার এ গল্পে খিজির (আঃ) এর মিথটির হাজার ভাগের এক ভাগ
ব্যবহার করেছেন। এই গল্পে আমরা জানতে পারি খিজিরের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে হাড় নেই,
আগ্রহী পাঠক (বিষয়টি অজানা থাকলে) বিস্মিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।
জহির
এবং হাসান দুই বন্ধু। জহির তার বড়লোক হওয়ার গল্পটি বলার জন্য উদ্গ্রীব।
জহিরের অবস্থা ফাটা ডালিম । বড়লোক হওয়ার গল্প বলতে না পারলে তার যেন
ধমবন্ধ হয়ে যাবে। জহির এবং হাসান দুইজনে ক্লাব সদস্য। নগর কেন্দ্রিক
সভ্যতার আড্ডাস্থল ক্লাব। লেখক ধনবানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের বর্ণনা
দিয়েছেন বেশ সময় নিয়ে পাঠকের ধৈর্যচুতি না ঘটিয়ে। ধনাহারী জহির দেশ
স্বাধীনের পর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য হেন কাজ নেই যা তিনি করেন নি। ‘ কামলা,
ভুসিমালের কারবার, মনিহারি দোকান, জুতার ফেরি, ছোটখাটো চাকরি কিন্তু
কিছুতে কিছু হয়নি। তার ভাষায় , ‘.. .. .. অতল অভাবের মধ্যে পড়ে হাবুডুবু
খাচ্ছিলাম। পরনের কাপড়চোপড় পর্যন্ত ছিল না। আমার ছিল একটি মাত্র লুঙ্গি।’
একজন লোক ধনাহারী না হলে এই নিতল অবস্থা থেকে ওঠে কী করে!
‘
উপায়ান্তর না দেখে সিদ্বান্ত নিলাম পালিয়ে যাব। ঠিক পালানো নয়, ঠিক অন্য
রকম চিন্তা এল মাথায়। ভাবলাম খোয়াজ খিজিরের সন্ধানে বের হব। .. .. আমার
বিশ^াস ছিল সাগরপারে সমুদ্রের নবীকে খুঁজে পাব। বইয়েও লেখা ছিল সাগরপারে
গিয়ে আমল সম্পন্ন করার কথা।’
জহির খিজিরের সন্ধান পেয়ে ছিলেন। সেই
খিজিরের কারনে তার অবস্থার পরিবর্তন হয়। এই গল্পের আড়ালে ধনি হওয়ার কেরামতি
লুকায়িত ছিল। এই কেরামতি এখন পর্যন্ত বন্ধ হয়নি। রূপ পাল্টাচ্ছে দিন দিন ।
কী সেই কেরামতি? জহির তার বন্ধু হাসানকে বলেন, ‘ .. .. দুনিয়ার সকল
রহস্যের উন্মোচন করা ঠিক না।’
কিন্তু আমাদের রহস্য জানতে হবে। অভিধানে
কয়, ধনাহারী মানে বাটপার। লালসালুর মজিদ মাজার পোজার পথিকৃৎ। বাটপার জহির,
খিজিরকে ব্যবহার করে। একটার পর একটা খিজির পাল্টায়। শেষে আর পাল্টাতে হয়
না। দান-সদকা যারা করে তারা আর জানতে চায় না ভেতরে কোন খিজির আছে কি নেই।
দেশ স্বাধীনের পর থেকে আজ পর্যন্ত খিজির সন্ধানের আবরণে উর্ধ্বমূখী পতন অনুশীলন কোথাও বন্ধ হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
তৃতীয়
গল্প, ‘তাহলে মাছেদের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত’। এই গল্পটি বাংলা ছোট
গল্পে সহোদরহীন। গল্পটি সাহিত্যের কাগজ ঘুংঘুর’এ প্রকাশের পর কোন এক
ভার্চুয়াল সাহিত্য আড্ডায় পশ্চিম বাংলার কথা সাহিত্যিক অমর মিত্র এর ভূয়সী
প্রশংসা করেন। গল্পের লেখক এবং পাঠ প্রতিক্রিয়া জানান দেয়া ব্যক্তি, দুজনের
কেউ অমর মিত্রের উল্লেখিত আলোচনা বা প্রশংসা শোনেননি।
গল্পটির
বিষয়বস্তু অভিনব। মাছেদের মধ্যে একদল মাছ লক্ষ্য করে, আধার বা বড়শির টোপ
গ্রহণ করতে গিয়ে তাদের অনেকে লাপাত্তা হয়ে যায়। কোথায় যেন হারিয়ে যায়। ফিরে
আসে না। এখন থেকে মাছেরা আর বড়শির টোপ গ্রহণ করবে না। কেউ টোপ গ্রহণ করতে
চাইলে বাধা প্রধান করা হবে। কিন্তু বললে তো হবে না। টোপ গ্রহণ করাই তো
মাছেদের ধর্ম। টোপ গ্রহণ করা এবং না করা নিয়ে বাধে বিপত্তি। তরূণ মাছেরা,
ছোট মাছেরা টোপ না গেলার পক্ষে। আর যারা পুরাতন, যে মাছগুলো ভারি বড় তারাই
লোভী এবং প্রাচীণ রীতির পক্ষে। রীতিকে বড়রা ধর্মের মতো মান্য করে। এদের
ভেতর শোক নেই। নিজেকে রক্ষা করার চিন্তা নেই। অপর মাছের জন্য কোন টান নেই
বড় মাছগুলোর। বড়রা ভোগী।
যে মাছ হারিয়ে যায় তার জন্য কে শোক করে! মাছের মায়ের পুত্র শোক দিয়ে ভিন্ন চিন্তার দরজায় মস্ত তালা ঝুলানো আছে।
ক্ষুদ্র
মাছেরা যেন তৃতীয় বিশে^র সিম্বল। আর বড় বা বোয়াল মাছ আগ্রাসনের চিহ্ন।
তারচেয়ে বড় আগ্রাসনকারী জলের উপর থেকে বড়শি দিয়ে যে মাছ নিধন করে সেই
লোকটি। বর্তমান বিশ^ রাজনীতি এই ছোট্ট গল্পে সহজে এঁটে যায়।
শেষ
পর্যন্ত বড় অস্তি¡ত্ব, শক্তিশালী ব্যক্তি টিকে যায় এমন বিশ^াসের বিরুদ্ধে
এই গল্প। এ যেন ডারউইনের ‘যোগ্যতমরা টিকে থাকে’ এই আপ্ত বাক্যের বিরুদ্ধে
লেখা, চিন্তা। সকল আধিপাত্যের বিরুদ্ধে এ গল্প।
প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা। প্রয়োজন নিম্নবর্গের প্রত্যেকের দায়িত্বটি সূচারূপে পালন করা।
আমরা এ ক্ষেত্রে স্মরণ করতে পারি নিরীক্ষাধর্মী নাট্যকার সাঈদ আহমদ এর নাটক ‘তৃষ্ণায়’ , ‘দ্যা সার্ভাইভেল’।
চতুর্থ
গল্পঃ ‘জবাসংহিতা’। সময়ের গোলক ধাঁ ধাঁ। গোলক ধাঁধাঁর দুই প্রান্তে জবা
এবং রাহেদ রিন্টু। রাহেদ রিন্টু দীর্ঘ সময় এ গল্পে ‘আমি’ নামে রচিত হতে
থাকে। গল্পের প্রায় শেষ পর্যায়ে জানা যায় আমি চরিত্রটিই রাহেদ রিন্টু। এ
গল্পে জবার বিভিন্ন সময়ের উপস্থিতি বেশ রহস্যজনক। জবার সঙ্গে রাহেদ রিন্টুর
দূরবর্তী প্রেমের সমম্পর্ক ছিল। কিন্তু এ গল্পে প্রেমের চেয়ে বড় হয়ে দেখা
দেয় জবার রহস্যজনক আগম নিগম।
অতৃপ্ত আত্মার গল্প জবাসংহিতা। রাহাদ
রিন্টুর জবানিতে আমরা শুনি, ‘আমি এখন জেলে। এখানে বসেই জানতে পারি .. ..
জবার আত্মহত্যার কথা। শোভন প্রতারণা করেছে তার সঙ্গে। গর্ভের সন্তানকে শুধু
অস্বীকার করেনি,আঙুল তুলেছে অন্য কারোর দিকে সেটা সহ্য করতে পারেনি জবা।
মুক্তি (!) পেতে বেছে নিয়েছে আত্মহত্যার পথ। এমরানই খবরটা দিয়েছে আমাকে।
আমি এমরানকে তখন জিজ্ঞেস করি, কখন কিভাবে আত্মহত্যা করেছে সে?’
তারপর
শুরু সময়ভঙের সন্তরণ। একটি সময় আরেকটি সময়ের ভেতর ঢুকে যায়। সময় ভেঙে খন্ড
খন্ড হয়ে যায়। সময়ের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে অন্য প্রন্তকে চেনা যায় না। সময়ের
হেয়ালির কারনে ব্যক্তির আচরণ উদ্ভট ঠেকে। সৃষ্টি হয় ছোট ছোট গল্প ঘূর্ণন। এ
ঘূর্ণনে ব্যক্তির নিকট বাস্তবতা সত্যমিথ্যা দুই হয়ে হাজির হয়। ব্যক্তির
চিন্তার অতলান্ত ভেঙে সত্যমিথ্যাকেও পাড় করে। হয়তো এর নাম তৃতীয় বা চতুর্থ
মাত্রা।
আমরা গল্পের শেষ অংশ দেখতে পারি, রাহেদ রিন্টু বলছেন, ‘সেদিন
অনুমান রাতের মধ্যপ্রহরে ঘুম ভেঙে গেলে একট অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে আমার
সঙ্গে। দেখি, ডেপুটি জেলার জামসেদ বিল্লাহ চাবি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন মেঝেতে।
আমি হুড়মুড় করে উঠে চোখ কচলাতে থাকি তখন। দারোগা বিল্লাহ বলেন, কি বুঝলেন
রিন্টু সাহেব, উইটা পড়েন। আমি জিগ্যেস করি কোথায়? বিল্লাহ বলেন, জেলখানার
বাইরে, মুক্ত দুনিয়ায়। কী বুঝে জানি না, সুড়সুড় করে তাকে অনুসরণ করতে থাকি।
বেশ কিচুক্ষণ হাঁটার পর নিজেকে আবিস্কার করি এক কর্দমাক্ত নোংরা গর্তের
মধ্যে। গর্ত থেকে উঠার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু উঠতে পারি
না। বানরের বাঁশে উঠার মতো কতটুকু উঠেই আবার পড়ে যাই। তখন গর্তের আরো
গভীরে তলিয়ে যেতে থাকি। এমন সময় বাইরে কারো পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। গর্তের
ভেতর থেকে মুক্তির নিঃশ^াস টেনে জিগ্যেস করি, কে? কে ওখানে?
উত্তর আসে, আমি জবা।
পুনঃ জিগ্যেস করি, কোন জবা?
খিলখিল করে হেসে বলে , আমি রক্তজবা।
গর্তের ভেতর তলিয়ে যেতে যেতে আমার মনে হয়, রক্তজবা নয়, কথা বলছে রক্তাক্তজবা।’
তারপর
গল্পটি সকল প্রকার সম্ভাব্যতা ছাড়িয়ে আরও অন্য এক সম্ভাবনাকে হাজির করে-
হতভ্রুণ তো রক্তাক্তজবাই। একের ভেতর দুই বিগত প্রাণ, কী করে সহ্য করে, কী
করে মানতে পারে, রিন্টু নামক আমি’র জীবন যাপন, হোক তা জগতে বা পরাজগতে। তাই
জবা সংহিতা এই গ্রন্থের অনন্য গল্প।
সর্বশেষ গল্প বিষয়ে কথা বলার পূর্বে কথাশিল্পী সানাউল্লাহ নূরের গল্পপ্রবনতায় আমরা ক্ষাণিকটা আলো ফেলতে পারি Ñ
১.কথা শিল্পী সানাউল্লাহ নূর তার গল্পবয়ানকে বিশ^াসযোগ্য করে তুলতে পারেন।
২. প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গে যেতে মধ্যবর্তী শূন্যতা ভরাটে তিনি পাঠকের মনোযোগে ছেদ ঘটান না।
৩.
একেই সঙ্গে তিনি গ্রাম-জীবনের পুরান ও পরাণ কথা এবং শহর জীবনের অম্লমধুর
কথা ও কুটভাষ চয়নে দক্ষ। (গল্পঃ সোনাবরু। গর্ভ ভাড়া এবং অতঃপর।)
৪. তার
গল্পে রূপকের অভ্যন্তরে আরও রূপক অবস্থান করে পাঠকের ভাবনার পথকে বহুমূখী
করে। (গল্পঃ তাহলে মাছেদের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো)
৫. আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে তিনি নিঃশঙ্কোচিত্ত। (গল্পঃ সূত্র সন্ধান )
৬. মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্পে, সুবিধাভোগীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশে তিনি প্রায় উত্তঙ্গমাত্রার। (গল্পঃ স্্েরফ পাগলামী নয়)
৭. ইসলামী মিথ এবং হিন্দু মিথ, দুই মিথই তিনি ব্যবহার করেন।( গল্পঃ খোয়াজ খিজিরের সন্ধানে। সূত্রসন্ধান।)
৮. কখনো কখনো অধিক চরিত্র সমন্বয়ে রচিত তার গল্পের খেই ধরতে পাঠকের পক্ষে শ্রমসাধ্য হয়ে পড়ে। ( গল্পঃ সূত্রসন্ধান )
জবাসংহিতা
গল্প গ্রন্থের সর্বশেষ গল্প ‘সূত্রসন্ধান’। প্রায় ২২টি চরিত্রের সমন্বয়ে
সূত্রসন্ধান। যতন এবং মুশো প্রধান চরিত্র। মুশোর জন্ম বিত্তান্ত বেশ জটিল।
এক কথায় জানে না সে কার সন্তান, বাপের পরিচয় নেই। জারুয়া বিষয়ে যতন মুশোকে
প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে। কিন্তু মুশো বিরক্ত না হয়ে একের পর এক কথা বলতে
থাকে। কেন বলতে থাকে? পাঠক ধাঁধাঁয় পতিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। মুশোর মা
মনোজা- মনু। মনোজাও নির্ণয় করতে পারে না মুশো কার সন্তান। হাছনালি না
হাছনালির বন্ধুর। যদিও মনোজা আজ বেঁচে নেই, তার দুই জৈবসহযোগীর একজন মৃত।
তবু তার ছেলে মুশোকে ‘জারুয়া’ গালিটি জবান খুলতে বাধ্য করে। এখানে
নিম্নবর্গের মানুষের বেঁচে থাকায় নীতিনৈতিকতা একবারে ঠুনকো। তারা এ নিয়ে
ভাবিত নয়। তারা প্রচুর কথা বলে কিন্তু কারো মধ্যবিত্তীয় নাক আছে বলে মনে হয়
না। মুশো সংবাদ পায়, তার মায়ের সর্বশেষ পুরুষ যে এখনো বেঁচে আছে, যতনের
কোম্পানির এমডি, তারও পিতৃপরিচয় নেই। কেন নেই? দেশ স্বাধীনের পর
সুবিধাভোগী এক শ্রেনির দালাল, যারা অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে কোন যোগ্যতা
ছাড়াই, তাদরকে মুশো জারুয়া বলে। তাই গল্পের শুরুতে আমরা দেখি জারুয়ার পোলা
জারুয়া বাক্যটি। সমাজের চিহ্নিত এই অবস্থাকে একেই পৃষ্ঠতলে নিয়ে আনার
চেষ্টা, নিরব ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে গল্পে।
এই গল্পটিকে আরও অন্য মাত্রা
দিতে লেখক একটি পুকুর দ্বিখন্ডনের সংবাদ দেন হারান কর্তার মাধ্যমে। লেখক এ
গল্পেও খিজিরের মিথ ব্যবহার করেন এবং একই সঙ্গে মনি আমাবস্যা বা মৌনব্রত
পালনের কথা, হারান কর্তার ভাই মিরন কর্তাকে দিয়ে বয়ান করান। গল্পটিতে
গ্রাম এবং শহর একই সঙ্গে বিধৃত হয়েছে। ছিঁচকে চোর থেকে শুরু করে জবরদস্ত
এমডি চরিত্র রয়েছে এতে। এমন একটি গল্পকে নিয়ন্ত্রণ করা, গল্প চিন্তার পূর্ব
নির্ধারণ না থাকলে সম্ভব না।
ফলগ্রন্থির অপারেশন, অপারগতা, গর্ভ ভাড়া
এবং অতঃপর Ñ গল্প সমূহে বিজ্ঞান মনস্কতা, পারিবারিক জটিলতা, বিশ^সভ্যতার
ভঙ্গুরোত্তর আবহাওয়া আমাদের সমাজ বাস্তবতাকে বদলে দিচ্ছে অন্তর্বয়নে। গল্প
মানুষকে শিক্ষা দেয় না। গল্প শিক্ষকের হাতের বেত না। গল্প আমাদের ভাবতে
শিখায়। হাসান আজিজুল হকের ভাষায় যে কোন পাঠ মানুষের ব্যক্তিত্ব ঘটনে সহায়ক।
মোট
তেরোটি গল্পে লেখক তাঁর লেখনি শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। লেখক সত্তায় তিনি
রাজনীতি সচেতন এবং ধর্ম সচেতন। ধর্মের অপব্যবহারের বিপক্ষে, অন্যায্য
সম্পদের বিপক্ষে-চেতনে অবচেতনে লিখন প্রক্রিয়াতে জারি ছিলেন তিনি।
আরও নতুন গল্প কথাশিল্পী সানাউল্লাহ নূরের নিকট আমরা প্রত্যাশা করি। তিনি আরও গল্প লিখবেন। আমরা তার গল্পের প্রতীক্ষায় রইলাম।
প্রথম গল্পগ্রন্থঃ জবাসংহিতা
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ২০২২ বইমেলা
প্রকাশকঃ ওসমান গণি, আগামী প্রকাশনী
৩৬ বাংলা বাজার, ঢাকা-১১০০
প্রচ্ছদঃ ধ্রুব এষ
মূল্যঃ ৪০০ টাকা
পৃষ্ঠঃ ১৬৬