ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ||
আমরা
যখন মানুষের জীবন সম্পর্কে আলোচনা করি, তখন তার বিভিন্ন ধরনের চাহিদা এবং
এগুলো পূরণ করার বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা করি। এর কারণ, যৌক্তিক চাহিদা
পূরণের ওপরই নির্ভর করে মানুষের পরম আরাধ্য শান্তি। এর পেছনে বড়
চালিকাশক্তি হলো রাষ্ট্র। তাই মানুষের মৌলিক চাহিদা যদি পূরণ না হয়, তাহলে
রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্বই হচ্ছে
মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা। মানুষের নানা ধরনের চাহিদা রয়েছে,
যেমন—বেআইনি চাহিদা মাদকাসক্তি। আবার বিলাসদ্রব্যের চাহিদাও মানুষের রয়েছে,
যা সর্বজনীন নয়। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা এবং মানুষের জীবনধারণের জন্য
অপরিহার্য চাহিদাগুলোকেই মূলত মৌলিক চাহিদা বলে। অনেকের কাছেই মনে হতে
পারে, পুরনো জিনিস নতুন করে বলা দরকার। বাস্তবতা হচ্ছে, এই আলোচনা এখনো
প্রাসঙ্গিক এবং তা জাতীয় ও বৈশ্বিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই।
বেদনার বিষয়
হচ্ছে, আমরা দিন দিন মানুষের মৌলিকত্ব থেকে সরে যাচ্ছি। আমরা নতুন নতুন
ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি আবিষ্কার করছি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এসবের অনেক কিছুই
কাজের বিষয় নয়, সর্বজনীন হয় না। চটকদার বিজ্ঞাপন, বক্তৃতা বা কেস স্টাডি
ইত্যাদির মাধ্যমে এসব তুলে ধরা হয়। প্রকৃতপক্ষে এগুলো ব্যাবসায়িক বা
বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রূপ নিচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে মৌলিক চাহিদা থেকে
মানুষের দৃষ্টি সরে যাচ্ছে।
১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক শ্রম
সংস্থা (আইএলও) মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর তালিকা এবং পূরণ করা যেকোনো
সরকারের দায়িত্ব বলে ঘোষণা করে। তখন মৌলিক চাহিদার তালিকা খুব বেশি ছিল না।
তখন ছিল খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও পানি। পরে মৌলিক চাহিদা সম্পর্কে ধারণা
দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। এখন মৌলিক চাহিদা বলতে আমি মনে করি খাদ্য,
বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি, নির্মল বাতাস ও
জ্বালানিকে বোঝায়। এ কারণে এই মৌলিক চাহিদা নিয়ে নতুন করে বলা, সেটি হচ্ছে
এই চাহিদাগুলো আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্র সবার জন্য নিশ্চিত করতে পারছে কি না।
সার্বিক
দিক দিয়ে বিবেচনা করলে অনেক দেশই এখন পর্যন্ত নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা
নিশ্চিত করতে পারেনি। উন্নয়নশীল দেশ বাদ দিই, উন্নত দেশগুলো সব মানুষের
জন্য বাসস্থানসহ অনেক চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এসব চাহিদা পূরণের
উপায় একটিই, সেটি হচ্ছে ক্রয়ক্ষমতা। দেখা যাচ্ছে, যাদের টাকা-পয়সা আছে,
তারাই শুধু এসব চাহিদা পূরণ করতে পারে। যেমন—বিশুদ্ধ পানি সচ্ছল ব্যক্তিরা
পেতে পারে, যদিও অনেক সময় অর্থ দিয়েও বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই।
যাদের পয়সা আছে, তারাই শুধু বোতলজাত কিংবা যথার্থ মানের ফিল্টারের পানি
ব্যবহার করতে পারে। বিশ্বে এখন বাতাসও কিনতে হয়। আমাদের দেশে বাতাস এখন
আগের চেয়ে দূষিত। কিন্তু খারাপ লাগলে হাসপাতালে গিয়ে বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে
আসতে পারবে, যদি কারো সেই সামর্থ্য থাকে। অর্থ থাকলে বাসাবাড়িতেও
এয়ারপিউরিফায়ার লাগাতে পারে মানুষ। অর্থাৎ অর্থ ব্যয় করেই আপনাকে বিশুদ্ধ
বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে। মোটামুটি এ অবস্থা বিশ্বের অনেক দেশের বেলায়ই
সত্য।
আমরা যদি এই বিষয়গুলো আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দেখি, তাহলে কী
দেখতে পাই? আমরা বলছি যে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। এবার
অন্যান্য বিষয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধীরে ধীরে অর্জন করতে যাচ্ছি। কিন্তু
প্রশ্ন হচ্ছে, খাদ্যে কি আমরা আসলেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি? আমরা
গমের চাহিদার বিরাট অংশ আমদানি করি, ভোজ্য তেল আমদানি করে চাহিদা মেটাই।
ডালের বড় অংশ আমদানি করতে হয়। এসব দ্রব্য মৌলিক চাহিদার অংশ। এটি ঠিক যে
মোটাদাগে আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে। যেমন—চাল আগে আমদানি করতে
হতো, এখন করতে হয় না বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া।
একটু গভীরে দৃষ্টি দিলেই
আমরা ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। আমরা যেটিকে সুষম খাদ্য বলি, সেটি কি আমরা
পাচ্ছি? এটি নিশ্চিত করতে পারছি না। আমরা দেখছি কৃষির উৎপাদনশীলতা আমাদের
এখানে বিশ্বের সবচেয়ে কম। ডাল বা অন্যান্য নিত্যপণ্য সেভাবে উৎপাদিত হচ্ছে
না, অথচ আমরা সবজি রপ্তানি করি। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, আমরা উৎপাদনে ভারসাম্য
বজায় রাখছি না, যেখানে চাহিদার অনেক পণ্যই এখানে উৎপাদন করা সম্ভব।
আমরা
বাসস্থানের দিকে তাকালে দেখতে পাব, এখনো বহু মানুষের জন্য আমরা বাসস্থান
নিশ্চিত করতে পারছি না। সরকারিভাবে কিছু ব্যবস্থা হচ্ছে, কিন্তু সেটি খুবই
নগণ্য। বিশুদ্ধ পানি দিন দিন দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে। আর বায়ুর মান নিয়ে
নানা প্রশ্ন রয়েছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চল ও শিল্পঘন জেলাগুলোতে। বায়ুর মান
অবশ্য একটি ব্যাপক জিনিস। এটি বাংলাদেশ বা কোনো দেশ একা কিছু করতে পারবে
না। এটির সঙ্গে অন্যান্য দেশ বা বৈশ্বিক সহযোগিতার ব্যাপার আছে।
জ্বালানি
খাতে আমাদের পেট্রল নেই। আমাদের গ্যাস আছে, কিন্তু গ্যাসফিল্ডগুলো ঠিকমতো
সার্ভিসিং করি না। আবার প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদও ফুরিয়ে আসছে। নতুন গ্যাস
আবিষ্কারের ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। আমরা লড়াই করে
আইনগতভাবে অফশোর ব্লকের অধিকার পেয়েছি, কিন্তু সেখানে এক্সপ্লোরেশন বা
আবিষ্কারের তৎপরতা কম। অথচ ভারত ও মিয়ানমার শুরু করে দিয়েছে। আমরা এলএনজি
আমদানি করে এটির ঘাটতি পূরণ করছি, কিন্তু এলএনজি আমদানি একটি ব্যবসায়ী
উদ্যোগ।
চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আমাদের এখানে যা হচ্ছে তা সবই
অপরিকল্পিতভাবে। এখন যে এসডিজির ১৭ লক্ষ্য পূরণের কথা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে
এসব তৎপরতার কোনো সম্পর্ক নেই। এসডিজির সঙ্গে এসব কাজের কোনো সমন্বয় নেই।
ফলে চাহিদা পূরণের কাজটি পদ্ধতিগতভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না।
আরেকটি বিষয়ে
নজর দেওয়া দরকার। দেশের শোভন সমাজ গঠনের বিষয়ে নজর নেই। একটি টেকসই
রাষ্ট্রের স্তম্ভ হলো তিনটি। একটি হলো সামাজিক ন্যায় বা সোশ্যাল জাস্টিস,
দ্বিতীয়টি হলো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও তৃতীয়টি রাজনৈতিক ব্যবস্থা। আমাদের
দেশে প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দিয়ে অনেক কিছু অর্জন করেছি বটে, কিন্তু সমস্যা
হচ্ছে নজরটা এখানে বেশি দেওয়া হচ্ছে, তবে সুফল সবাই পাচ্ছে না। ফলে আমরা
অর্থনৈতিকভাবে অনেক ভালো করলেও সুফল সবাই পাচ্ছে না। এটিকে একপেশে অর্থনীতি
বা প্রবৃদ্ধিনির্ভর অর্থনীতি বলতে পারি। আর বাকি দুটির দিকে আরো নজর দিতে
হবে।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা দরকার বা কী করলে আমরা এ অবস্থা
কাটিয়ে উঠতে পারব? এ ক্ষেত্রে আমি তিনটি দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চাই। একটি
হলো প্রথমত, আমাদের দেখতে হবে সমস্যার প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য কী। দ্বিতীয়
দিকটি হলো কৌশল এবং তৃতীয়টি হচ্ছে চালিকাশক্তি।
প্রথম দৃষ্টিটি হচ্ছে
সমস্যার বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করা, যেমন—দারিদ্র্য এখন বাড়ছে। এর চেয়ে বড় কথা
হলো, দারিদ্র্য এখন বহুমাত্রিক হচ্ছে। সহজেই এটি দেখা যাবে, যেমন—খাদ্য
সুলভ মূল্যে পাওয়া, পানীয়র সংস্থান সবার জন্য, বাসস্থানের ব্যবস্থা করা,
জ্বালানির সাশ্রয়ী সরবরাহ, গুণগত শিক্ষার প্রসার এবং সহজলভ্য স্বাস্থ্য। এই
বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে কারা এসব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেখতে
হবে কাদের অবস্থান কতটুকু উন্নত হলো, কতটুকু অবনতি হলো। কোন কোন এলাকায়
এগুলোর অভাব বেশি। কিংবা কর্মসংস্থান কোথায় বেশি হচ্ছে, কোথায় কম হচ্ছে।
ব্যাংকঋণ পুঞ্জীভূত হচ্ছে, এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন পুঞ্জীভূত হচ্ছে। এটি শোভন
সমাজের লক্ষণ নয়।
এরপর হলো কৌশল। কৌশলের সংজ্ঞা হলো, যেসব মানুষের কাছে
সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার কথা, কিভাবে ঠিকমতো পৌঁছে দেওয়া যায়। দরিদ্র ও
প্রান্তিক মানুষকে ঠিকমতো অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে কি না, সেটি দেখতে হবে।
যে নীতিগুলো প্রণয়ন করা হয়, কর্মসূচি নেওয়া হয়, সেগুলো টার্গেট গ্রুপের
কাছে পৌঁছতে হবে। দেখতে হবে সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন হচ্ছে কি না,
আঞ্চলিক বৈষম্য দূর হচ্ছে কি না।
তৃতীয় হলো চালিকাশক্তি। উন্নয়ন হবে
মানুষের জন্য, সব মানুষের জন্য। তাই দেখতে হবে উন্নয়নকাজে মানুষের অংশগ্রহণ
কতটুকু। দেখতে হবে মানুষ তার চাহিদা প্রকাশ করতে পারছে কি না এবং সেগুলো
আমলে নেওয়া হচ্ছে কি না। যে সুস্থ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় মানুষের কথা এমপি,
চেয়ারম্যান, মেম্বার, মেয়র, কাউন্সিরলরদের বলার কথা; সেটি কি ঠিকমতো হচ্ছে?
এটি ঠিক করা হয় আইভরি টাওয়ার বা ওপরের দিক থেকে। একেবারে ওপরের দিক থেকে
ঠিক করে দেওয়া হয় যে নিজের লোকজন কী সুবিধা পাবে। মানুষের সক্ষমতা তৈরি
করতে হবে আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তির দিক দিয়ে। ব্যাংকঋণ, সরকারি প্রণোদনা এবং
শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া মহিলাদের ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়।
কিন্তু আমরা যে নারীর ক্ষমতায়ন দেখতে পাচ্ছি শহরের এবং কিছুটা গ্রামের
নারীদের মধ্যে, সেটি ক্ষমতায়নের একটি ঝলক মাত্র। কিছু কেস স্টাডি শুধু
প্রচার করা হচ্ছে। এর বিপরীতে সরকারি কাঠামোটা দেখুন। সব কিছু কেন্দ্রীভূত।
প্রশাসন কেন্দ্রীভূত, উন্নয়ন কেন্দ্রীভূত, প্রশাসনিক যন্ত্র—সব কিছু
কেন্দ্রীভূত। যেমন—স্থানীয় সরকার স্থানীয় প্রশাসনের কাছে কোনো মূল্যই নেই।
অথচ সংবিধানে এটি বলা আছে।
চালিকাশক্তির আবহটা বিবেচনা করা প্রয়োজন,
যেমন—বিনিয়োগের অবস্থা, মানুষের কথা বলার আবহ, মতামত প্রদানের আবহ নিশ্চিত
করতে হবে। এগুলো যদি নিশ্চিত না করতে পারি, তাহলে পরিকল্পনা বই-পুস্তকে পড়ে
থাকলে লাভ হবে না। তাই এখন সময় এসেছে এসডিজিতে যে ১৭টি লক্ষ্যের কথা বলছি,
মোটামুটি কয়েকটি লক্ষ্যে আমরা এগিয়েও গেছি। আমরা হয়তো ১৭টি লক্ষ্যকে
সমানভাবে গুরুত্ব দিতে পারব না, কিন্তু আমাদের মৌলিক চাহিদার সঙ্গে সম্পর্ক
রেখে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাহিদার ভিত্তিতে লক্ষ্যগুলোর মধ্যে
প্রাধান্য নির্ণয় করতে হবে। এটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের জন্য।
আমি
মনে করি, সামনে এগিয়ে যাওয়ার যে প্রস্তুতি, শুধু এসডিজির জন্য নয়, শুধু
নিম্ন-মধ্যম থেকে উচ্চ আয়ের দেশে যাওয়াই নয়, উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত
দেশের দিকে যাত্রা করা নয়, আমাদের রাষ্ট্রকে সবার জন্য একটি কল্যাণকামী
রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে, সবাইকে পদক্ষেপ নিতে
হবে।
লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়