ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
আশায় বুক বাঁধছেন বাঁশি কারিগররা
বৈশাখি মেলাকে সামনে রেখে হোমনার শ্রীমদ্দির বাঁশি গ্রামে ব্যস্ততা
Published : Sunday, 3 April, 2022 at 12:00 AM, Update: 03.04.2022 12:10:28 AM
আশায় বুক বাঁধছেন বাঁশি কারিগররাতানভীর দিপু:
জনসমাগম নিষিদ্ধ থাকায় হয় নি মেলা, করোনা মহামারিতে বৈশাখি মেলার গত তিন মৌসুমই প্রায় ঘরে বসে থেকেছেন বাঁশি কারিগর ও ব্যবসায়িরা। মেলার অন্যতম উপকরণ বাঁশি বানিয়েও অনেকে বেঁচতে পারেন নি  মেলায়, হাটে কিংবা দোকানে। লোকসান-অনটনে অনেকে বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিয়েছেন বাঁশি বানানো। রঙমিস্ত্রী, কাঠ মিস্ত্রী কিংবা দিনমজুরের কাজ নিয়েছেন এই শিল্পের কারিগররা। প্রায় অর্ধেক লোক তাদের বাঁশির ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন গত তিন বছরে। এমনই দশা কুমিল্লার হোমনা পৌরসভার ঐতিহ্যবাহী শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশি ব্যবসায়ি এবং কারিগরদের। অথচ শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশের বাঁিশর সুখ্যাতি দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও- গ্রামটিকে এক নামে অনেকেই চিনে ‘বাঁশির গ্রাম’ হিসেবে।
তবে প্রায় তিন বছরের করোনাকাল পেরিয়ে আবারো আশায় বুক বেঁধেছেন শ্রীমদ্দির বাঁশি কারিগর ও ব্যবসায়িরা। সামনের বৈশাখি মেলায় বাঁশি বিক্রি করে আবারো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় দিন-রাত ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। এবার বৈশাখি মেলা জমলেই, আবারো জমে যাবে ব্যবসা।
শ্রীমদ্দির প্রবীণ বাঁশি কারিগর আবুল কাশেম জানান, শ্রীমদ্দি গ্রাম থেকে ১৬ ধরনের বাঁিশ সারাদেশে যায়। খেলনা বাঁশি কিংবা পেশাদার যন্ত্রশিল্পীদের জন্য তৈরী করা বাঁশি-সবই বানানো হয় এই শ্রীমদ্দিতে। বংশপরম্পরায় প্রায় আড়াইশ বছরের বাঁশি শিল্পের ঐতিহ্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই বহন করছেন উত্তরসূরিরা। বাপ-দাদার কাছ থেকে শিখে বাঁশি বানানোতে তারা যেমন পারদর্শী, তেমনি বাঁশি বাজানোতেও দুর্দান্ত এই কারিগররা। শ্রীমদ্দির বাঁশির যে সুনাম- সে জন্য এখান থেকে দেশের খ্যাতিমান শিল্পীরা যেমন বাঁশি তৈরী করেন, তেমনি বিদেশেও নিয়ে যান অনেকে।  
বৈশাখি মেলাকে সামনে রেখে চৈত্রের শুরু থেকেই শ্রীমদ্দি গ্রামে বাঁশি বানানোর উৎসব শুরু হয়। ঘরে ঘরে বাঁশ কাটার শব্দ ও আগুণে পোড়ার ধোঁয়ার গন্ধ আর বাঁশির সুরের সহজেই বুঝা যায় এই গ্রামেই তৈরী হচ্ছে হাজার হাজার বাঁশি। পরিবারের নারী পুরুষ সকলে মিলে তৈরী করছেন বাঁশের বাঁশি। কেউ বাঁধছেন বাঁশির মুখ, কেউ করছেন রঙ। কেউ বা আবার বাঁশির শরীরে কাদা মাটি লাগিয়ে পুড়ছেন আগুনে। মেলার কয়েক দিন আগে থেকেই সারাদেশ থেকে পাইকাররা এসে কারিগর ও ব্যবসায়িদের কাছ থেকে বাঁশি কিনে নিয়ে যান। দেশের অন্যান্য জায়গায় বাঁশি তৈরী হলেও শ্রীমদ্দির বাঁশির প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ অন্যরকম।
কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে আসা বাঁশি ক্রেতা আমিনুল ইসলাম বলেন, সব সময় শ্রীমদ্দি থেকেই আমরা বাঁশি নিয়ে মেলায় বিক্রি করি। এই বেচা-কেনাও শত বছরের ঐতিহ্য। শ্রীমদ্দির বাইরে আমরা কোথাও থেকে বাঁশি কিনি না। উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণ বঙ্গ সব জায়গা থেকেই আসেন ক্রেতারা।
চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়ি এলাকা থেকে সংগ্রহ করা বাঁশ দিয়ে সঠিক মাপে বানানো হয় এসব বাঁশি। সম্প্রতি বাঁশের দাম এবং পরিবহন খরচ বেড়ে গেলেও বাড়েনি বাঁশির দাম, তাই একেবারে কম লাভেই বিক্রি করে কোন রকম টিকে থাকা হচ্ছে বলে জানালেন ব্যবসায়ি যতীন্দ্র বিশ^াস। তিনি জানান, করোনাকালীন লোকসান পুষিয়ে নেবার লক্ষ্যে আবারো শ্রীমদ্দির কারিগররা বাঁশি নিয়ে মেতেছেন। আশা করছি কিছুটা গতি আসবে ব্যবসায়। তবে ক্ষুদ্র কুটির শিল্প হিসেবে বাঁশি কারিগররা কেউ কোন সরকারি সহযোগিতা পায় নি। জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে বার বার আশ^াস পেলেও পরে এগিয়ে আসেনি কেউ।
বাঁশির কারিগর রানী বিশ^াস বলেন, বাঁশি শিল্প কুমিল্লার ঐতিহ্য। সরকারি কিংবা বেসরকারি কোন উদ্যোক্তা এগিয়ে না আসলে এই ঐতিহ্য বিলীন হতে সময় লাগবে না।
বাঁশি কারিগর আবুল কাশেম আরো জানান, শ্রীমদ্দির বাঁশি নিয়ে অনেক বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীরাও জানতে আসে। বিদেশী অনেক শিল্পীও এখান থেকে বাঁশি নেয়। কিন্তু আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে করতে কেউ সুনজরে তাকায় না।
হোমনা পৌরসভার মেয়র নজরুল ইসলাম জানান, বাঁশি কারিগরদের গুচ্ছ ঋণ দেয়া হচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা কেউ তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে কি না তা-ও খুঁজে দেখা হচ্ছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং জেলা প্রশাসনের সাথে এই ব্যাপারে কথা হয়েছে। হোমনার বাঁশি টিকিয়ে রাখতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।