জুলফিকার নিউটন ||
(পূর্বে প্রকাশের পর)
১৬
মানুষের
শৈশবের ইচ্ছা যদি কখনো জীবনে পূর্ণ হয় তখন তার মতো অভাবনীয় আর কিছু থাকে
না। তখন একটি বিপুল বিস্ময়ে এবং প্রশান্তিতে দেহ-মন আপুত হয়। বোধহয়, এ
ক্ষেত্রে ইচ্ছাকে বাঁচিয়ে রাখাটা একটা বড় কথা। আমি আমার ইচ্ছাকে বাঁচিয়ে
রাখবার চেষ্টা করেছি এবং বার বার সে ইচ্ছার কাছে প্রত্যাবর্তন করেছি। তাই
শৈশবের অংকুরকে বৃক্ষপত্রে পরিণত হওয়ার সুযোগ আমি তৈরি করেছিলাম। একটি
বিনীত ইচ্ছা একটি সম্ভাবনার পথ ধরে যখন পূর্ণতর সত্যে প্রকাশিত হয়, তখনই তো
জীবনের আনন্দ এবং জ্ঞানের সৌভাগ্য। এভাবেই জীবন বিনীত মাধুর্যে বিকশিত হয়
এবং প্রলয়ের হতাশ্বাস থেকে মানুষকে রক্ষা করে।
ইতিহাস কাকে বলে বলা
কঠিন। আমরা তো অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে বাস করি, কিন্তু অনেক সময়
বর্তমানেই আমরা হয়তো-সর্বাপেক্ষা মর্যাদা দিয়ে থাকি, কারণ মনে করি যে
বর্তমানের মধ্যে একটি বিশ্বাসযোগ্যতা এবং পরিচিতি আছে।
একজন মুসলমানের
কাছে প্রথম মানুষের জন্মলগ্ন থেকেই ইতিহাসের সূত্রপাত । ক্রমশঃ সভ্যতার
ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে এবং বিবিধ কর্মকাণ্ডের ধারাপ্রবাহ নিয়ে আমরা নিয়তই
ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলি। আদ দোহা সূরায় আল্লাহতায়ালা বলছেন মধ্য দিনের
দোহাই দিয়ে এবং নিশীথের দোহাই দিয়ে যে কর্মবান এবং বিশ্বাসে সঞ্জীবিত
মানুষের জন্য অতীতের চেয়ে ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই ভালো হবে। এভাবে সুনিশ্চয় করে
অতীতের চেয়ে ভবিষ্যৎকে অধিকতর মূল্য দেবার মধ্যে আমরা সভ্যতার ক্রমবিকাশের
ইঙ্গিত পাই। আমি আমার স্কুল জীবনে ইতিহাসের ধারাক্রমকে এভাবেই বিবেচনা করতে
শিখেছিলাম।
বাবার কথায় আবার ফিরে যাই। তিনি সব সময় ইসলামের ইতিহাস
থেকে উদাহরণ এনে আমাদের ন্যায় ও সত্যের কাহিনী শোনাতেন। তিনি বলতেন যে একটি
বিশেষ আদর্শে উজ্জীবিত না হলে মানুষ সফলতা পায় না এবং সমৃদ্ধির সৈকতে
দাঁড়াতে পারে না। আমার মনে হয় বিপুল এবং বিরাট অনন্তের ধারা প্রবাহের মধ্যে
আমি তখনই একজন বলে চিহ্নিত হতে পারবো যখন ইতিহাসের প্রত্যয়কে আপন জীবনে
স্বাক্ষরিত করতে পারবো।।
আমাদের স্কুলে পাঠক্রম বহির্ভুত বিষয় বই পড়ানো
হত। উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করা এবং পৃথিবীর বুকে
পদচরণের উপযুক্ত করা। মনজুর আলী নামে একজন শিক্ষক আমাদের স্কুলে ছিলেন। অতি
উজ্জ্বল তীক্ষ্ণ চেহারা, নাকটি একটু লম্বা। খুব সুন্দর কথা বলতেন এবং মুখে
সব সময় একটি শোভমান হাসি থাকতো। তিনি একদিন আমাদের ডারউইনের বিবর্তনবাদ
বুঝাচ্ছিলেন। বলছিলেন, সংগ্রাম করে যে বেঁচে থাকতে পারে সেই বেঁচে থাকতে
পারে, যে পরাজিত হয় সে হারিয়ে যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই-যে
শক্তিমান সে টিকে থাকছে কিন্তু যে অশক্ত সে পরাজিত হয়ে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। বড়
মাছ ছোট মাছ খেয়ে ফেলে এই তো আমরা জানি, তেমনি শক্তিমান পুরুষ দুর্বলকে
হারিয়ে দেয়। এভাবে যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম চলছে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন
শক্তির জাগরণ ঘটছে। সৃষ্টির আদিতে প্রাণসঞ্চার উদ্ভব হয়েছিল পরে তা বিভিন্ন
রূপে প্রকাশিত হয়ে অবশেষে এক পর্যায়ে বানরে রূপান্তরিত হল এবং বানর থেকে
অবশেষে মানুষে।' তিনি আরো অনেক কথা বলেছিলেন। আমি এখানে সংক্ষেপে তার
বক্তব্যের সারাংশ উপস্থিত করলাম।
আমাদের সঙ্গে পড়তোআজিজ নামে একটি
ছেলে। আসল নাম আমি ভুলে গিয়েছি। তার মাথায় নানাবিধ দুষ্ট বুদ্ধি খেলতে এবং
তার চোখে সব সময় তীক্ষ্ণ কৌতুক দেখা দিত। মনজুর আলীর কথা শুনে আজিজ উঠে
দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যার সকলেই কি বানর থেকে হয়েছে? কেউ কেউ তো ঘোড়ার
থেকে হয়েছে মনে হয়। মনজুর আলী অবাক হয়ে বললন, তার মানে?’ আজিজ বলল, স্যার
কারো কারোর চেহারা ঘোড়ার মতো হয়। মনজুর আলীআজিজকে ধমক দিয়ে বসিয়ে দিলেন।
এরপর কয়েকদিন পর্যন্ত এই বিবর্তনবাদের ভূত আমাদের ঘাড়ে চেপে বসলো। আমরা
কাউকে ঘোড়া বানাতে লাগলাম, কাউকে ছাগল, কাউকে বেড়াল ইত্যাদি। এর মধ্যে আবার
পাগলা বিশ^জিৎও যোগ দিল। সে বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল, “আমি আমার বাবার
মুখে শুনেছি, মানুষ মরলে পর কেউ আবার ইদুর হয়ে জন্মায়, কেউ ছাগল হয়ে
জন্মায়। বাবা বলেন যার যে রকম কর্মফল সে সে রকম হয়ে জন্মায়।
তখন আমাদের
এলাকায় ডেভিড হাবার্ট বলে এক পাদ্রী সাহেব ছিলেন। সমগ্র অঞ্চলে তিনি একজন
পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন এবং বিভিন্ন স্থানে যীশুর
বাণী প্রচার করতেন। আমাদের স্কুলে প্রায়ই আসতেন এবং যীশুর জন্মকথা বলতেন,
বেথেলহেমের ছবি দেখাতেন এবং আমরা তা শুনতে না চাইলে আমাদের লজেন্স দিয়ে
বশীভূত করতেন। স্কুলে যখন আমরা বিবর্তনবাদ নিয়ে খুবই ব্যতিব্যস্ত তখন একদিন
বিকেলবেলা আমাদের খেলার সময় ডেভিড হাবার্টের সুপরিচিত চেহারা দেখা গেল।
মাঠের মধ্যে ডেভিড হাবার্টকে ঘিরে আমরা বসলাম। ডেভিড হাবার্ট লজেন্স বিতরণ
করলেন। তিনি যীশু খৃষ্টের কথা আরম্ভ করবেন এমন সময় আমরা বানর এবং মানুষের
কথা তুললাম। বললাম যে আমরা শুনেছি মানুষ নাকি প্রথমে বানর ছিল। সাহেব
উত্তরে, ইহা অতীব সর্বনাশের কথা। ইহাতে কদাচ কর্ণপাত করিবে না। প্রভূ বা গত
প্রথমে আদমকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন এবং সেই আদম হইতে মানুষ হইয়াছে। ডেভিড
হাবার্ট বাইবেল থেকে মানব জন্মের কাহিনী এবং ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির কাহিনী
আমাদের শোনালেন।
আমার মনে আছে আমি এ সময় একবার বাবাকে ডারউইনের
বিবর্তনবাদের কথা বলেছিলাম। বাবা বলেছিলেন, দেখ, এই পর্যন্ত পৃথিবীতে যে
সমস্ত প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে তাতে দেখা যায় যে লক্ষ কোটি বছর আগেও মানুষ
মানুষই ছিল। যে সমস্ত কংকাল বা মাথার খুলি অথবা শরীরের বিভিন্ন হাড় মাটির
তলায় পাওয়া গিয়েছে সেগুলো মানুষের আকৃতির। বানরের কংকাল এক রকম, মানুষের
কংকাল এক রকম। এভাবে প্রত্যক্ষ প্রমাণের সাহায্যে আমরা বলতে পারি মানুষ
মানুষ হিসেবেই জন্মগ্রহণ করেছিল এবং বানর, বানর হিসেবেই। বানর থেকে মানুষ
হত তাহলে কংকালগুলোর মধ্যে একটি সংযোগ খুঁজে পাওয়া যেত অর্থাৎ বানরের কংকাল
ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে অবশেষে মানুষের কংকালে তা প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু
এই হারানো সংযোগটি কোথাও নেই। একে ইংরেজিতে বলে মিসিং লিংক। এটা কোনো
যুক্তি নয় এটা একটা কল্পনা বা ধারণা। আমরা এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রমাণের
সাহায্যে এটাই বলবো যে মানুষ মানুষ হিসেবেই জন্মগ্রহণ করেছিল, বানর হিসেবে
নয়। তাছাড়া আর একটা জিনিস লক্ষ্য করবে, বানর শিখতে পারে কিন্তু শেখাতে পারে
না। একটি শিম্পাঞ্জীকে যদি আমরা গাড়ি চালাইতে শিখাই তাহলে সে একাই সেটা
শিখবে। অন্য একটি শিম্পাঞ্জীকে শেখানোর ইচ্ছা তার হবে না এবং অন্যান্য
শিম্পাঞ্জীরও শিখবার জন্য কোনো কৌতূহল হবে না। মানুষ কিন্তু যা শিখে তা
অন্যকে শিখাতে পারে এবং মানুষের মধ্যে জানবার কৌতূহল আছে। এভাবে অন্যকে
শিখানোর ইচ্ছা ও স্বভাব এবং শিখবার একটি স্বাভাবিক আগ্রহ থেকেই ক্রমান্বয়ে
মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছে। মানুষের মতো স্মৃতিগত বোধ অন্য কোনো প্রাণীর নেই।
বানর শুধু অনুকরণ করতে পারে, শিখালেও শিখতে পারে কিন্তু যা শিখে সেই শিখাটা
বানরে জাতিগত স্বভাবে পরিণত হয় না। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি বানর মানুষ
থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রবৃত্তির এবং ভিন্ন প্রকৃতির প্রাণী।
বাবার কথায়
আমি অভিভূত হয়েছিলাম। তিনি ধীরে ধীরে কথা বলতেন এবং একটি বিচার বিবেচনার
মাধ্যমে তার বক্তব্যকে আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য করতেন। বাবা ইচ্ছে করলে
আমাদের ধর্মের কথা বলতে পারতেন এখানে, আদমের সৃষ্টির কথা বলতে পারতেন এবং
ক্রোধ প্রকাশ করে ধর্মবিরুদ্ধ কথা শোনা যে অন্যায় এমন কথাও বলতে পারতেন।
কিন্তু তিনি তা না করে একটি যুক্তির সাহায্যে আমার জন্য গ্রহণযোগ্যতা
নির্মাণ করলেন। মা অবশ্য একটা গল্পে বলেছিলেন যে এক সময় আল্লাহর হুকুম পালন
করেনি বলে কিছু সংখ্যক মানুষ বানরে রূপান্তরিত হয়েছিল। যারা আল্লাহকে
অগ্রাহ্য করে এবং পাপের পথে যায় আল্লাহ তাদের প্রথমে ভালো হবার অনেক সুযোগ
দিয়ে থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন পাপী মানুষগুলো তাদের অন্যায় আচরণে
সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন তিনি তাদের শাস্তি দিয়ে থাকেন। মা'র এই কথা আমি
বিশ্বাস করতাম, এখনো বিশ্বাস করি কিন্তু স্থুল অর্থে নয়। আমি বিশ্বাস করি
যে মানুষ অন্যায় কাজ করলে প্রকৃতির মধ্যে এবং সৃষ্টির চৈতন্যের একটি
বিরুদ্ধতার সৃষ্টি হয় এবং সেই বিরুদ্ধতাই অবশেষে তাকে গ্রাস করে। আমরা
দেখি, সাধু সন্যাসীরা দীর্ঘজীবী হয়, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়, তার কারণ
তারা পরিচ্ছন্ন, সাত্ত্বিক জীবন যাপন করে এবং পরিমিত আহার এবং একটি সুশৃংখল
জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে কাল কাটায়। এদের অধিকাংশই দিব্যকান্তির হয়ে থাকে।
সুষম জীবন যাপনের ফলে তারা শারীরিক গ্লানি থেকে মুক্ত থাকে। ঠিক একইভাবে
যারা ন্যায় পথে চলে, মানুষের কল্যাণের জন্য নিজেদের নিযুক্ত করে এবং
সর্বপ্রকার অপলাপ থেকে দূরত্বে থাকে তারা শান্তি এবং স্বস্তিতে থাকে।
নিম্নশ্রেণীতে শেখ ফজলুল করিমের ‘স্বর্গনরক কবিতাটি পড়েছিলাম। উক্ত
কবিতাটিতে তিনি মানুষের স্বর্গের অনুভূতি এবং নরকের অনুভূতি যে পার্থিব
জীবনেই হয় এ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে পার্থিব জীবনেই আমরা আমাদের
কর্মের ফলস্বরূপ কখনো স্বর্গীয় সুষমা পাই, কখনো নরকের মালিন্য পাই।
মানুষের
অন্য প্রাণীতে রূপান্তরের কথা অনেক গল্পে তখন পড়তাম। এই রূপান্তর আসলে
কিন্তু আদর্শের বা স্বভাবের রূপান্তর। অর্থাৎ মানুষ একটি বিশেষ প্রাণীতে
রূপান্তরিত হচ্ছে এর অর্থ হচ্ছে সে একটি বিশেষ প্রাণীর স্বভাবকে গ্রহণ
করছে। রূপান্তরিত হওয়া গল্পের মধ্যে এভাবে স্বভাবের বিবর্তনের ইঙ্গিতই
দেওয়া হয়েছে। আমরা চিরকাল আমাদের কর্মকাত্রে ইতিহাসে বিভিন্ন স্বভাবকে
আয়ত্ব করি, সে স্বভাব কখনো শোভন কখনো বা অশোভন।
(চলবে...)