রণবীর ঘোষ কিংকর:
উম্মে
ছালমা আজাদ সুমি। স্বামীর সরকারি চাকুরীর সুবাদে দুই পুত্র সন্তানকে নিয়ে
কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলা সদরে বসবাস শুরু করেন। চান্দিনায় আসার পর সুমি’র
কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান। শখ করে নাম রাখেন ‘সালওয়া সারা
আফরা’।
তিন সন্তানকে নিয়ে সাংসারিক সব কাজ কর্মের মধ্যে দিন পার করতেন
সুমি। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মাঝে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে তার একমাত্র
কন্যা সন্তান ‘আফরা’। মেনেনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছরের ১৫
ফেব্রুয়ারী ৬ মাস বয়সী ওই কন্যার মৃত্যুকে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলনা
সুমি।
মানসিক ভাবে বিপর্যস্থ হয়ে অনেকটাই নিশ্চুপ হয়ে যান তিনি। বেশ
কিছুদিন পর স্ত্রীর একাকিত্ব দূর করতে উদ্যোক্তা হওয়ার পরামর্শ দেন স্বামী
আনোয়ার হোসেন নিপু। স্বামীর কথামত কুমিল্লার ঐতিহ্য খাদি নিয়ে কাজ শুরু
করেন সুমি। খাদি কাপড় কিনে নিজের হাতে বাহারি ব্লক ও নকশী কাজ করে তৈরি
করেন থ্রী-পিছ, শাড়ি, পাঞ্জাবি এবং ফতুয়া পণ্য। মেয়ের নামেই “আফরা ফ্যাশন
হাউজ” নামকরণ করে গড়ে তোলেন একটি ফ্যাশন হাউজ। অনলাইনে চলে ব্যবসা। সারাদিন
ব্যবসা ও সংসারিক কাজে মগ্ন থেকে এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন সুমি।
কাপড়ের
সুতা থেকে শুরু করে পণ্য তৈরীর শেষধাপ পর্যন্ত মানের দিকে অগ্রাধিকার
দিয়েছেন শতভাগ। ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লার খাদি কাপড়ে আধুনিক ডিজাইন এনে দ্রুত
প্রসার ঘটান তার অনলাইন ব্যবসার। যে কারণে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
এখন ঘরে বসেই প্রতিমাসে তার আয় ৩০ হাজার টাকা।
সুমি জানান- ‘কোলের
ফুটফুটে মেয়েকে হারিয়ে নিজেকেও প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। স্বামীর উদ্যোগে
নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করি। কুমিল্লার খাদি বিশ্বজুড়ে
সমাদৃত। তাই শুরুতেই ভেবেছি যেহেতু কুমিল্লায় আছি, সেহেতু খাদি নিয়েই কাজ
করবো। কুমিল্লার খাদি তো চান্দিনা থেকেই শুরু। আর চান্দিনা থেকে খাদি নিয়ে
কাজ শুরু করলে ক্রেতারাও সেটিসফাই হবে। এমনটাই ভেবে পথচলা শুরু করি। খাদি
কাপড় খুবই আরমদায়ক ও উভয় ঋতুতে পরিধানযোগ্য বিধায় ওই কাপড়ে বাহারি ডিজাইনের
ব্লক ও নকশী কাজ করে ভিন্নতা আনায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গ্রাহকও তা
বেশ ভালভাবে গ্রহণ করছে’।
স্বামী পুলিশ সদস্য আনোয়ার হোসেন নিপু জানান,
স্নাতক পাশ উম্মে ছালমা আজাদ সুমি ছাত্রী জীবন থেকেই ছিলেন খুব উদ্যমী এবং
আত্মপ্রত্যয়ী। সব সময় চেষ্টা করেছে নিজে কিছু করে আত্মসম্মানের জায়গাটা
অনেক বড় করতে। মেয়ের মৃত্যুতে যখন অনেকটাই মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে তখন তার
মানসিক মনোবল সৃষ্টি করে উদ্যোক্তা হওয়ার পরামর্শ দেই। খাদি কাপড় ছাড়া এ
ব্যবসা এতো অল্প সময়ে বিস্তার ঘটানো সম্ভব ছিল না। এখন তার সময় কাটার
পাশাপাশি আমার ক্ষুদ্র চাকুরীর স্বল্প আয়ে বড় জোগান দিচ্ছে সুমি।
এদিকে,
‘কঠোর লকডাউনে’ স্বামীর ব্যবসা যখন প্রায় অচল তখন স্বামীর সংসারের হাল
ধরতে খাদি কাপড় নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন নাছরিন আক্তার সাথী। চান্দিনার
উপজেলা সদর ‘ধানসিড়ি’ আবাসিক এলাকার ভাড়া বাসায় অলাইনে খাদি কাপড় বিক্রি
করে সফল ওই উদ্যোক্তা নারী।
মাত্র ২ হাজার টাকার পূঁজি নিয়ে ছয় মাসেই
তার বিক্রি সাড়ে ৪ লাখ টাকা। চান্দিনা ও পাশ্ববর্তী বরকামতা গ্রাম থেকে
খাদি কাপড় কিনে নিজের পছন্দমত নকশা করে থ্রি-পিছ, শাড়ি, পাঞ্জাবী এমকি
গামছা পর্যন্ত বিক্রি করছেন এই সাথী। বর্তমানে ওই ব্যবসার ব্যাপক প্রসার
ঘটেছে।
তিনি জানান- আমার বাড়ি চান্দিনার বিশ্বাস গ্রামে। ঢাকায় অনার্সে
অধ্যয়নরত অবস্থায় বিয়ে করি। স্বামীর বাড়িও চান্দিনার পৌরসভাধীন বেলাশহর
কচুয়ারপাড় এলাকায়। ঢাকায় অধ্যয়নরত অবস্থায় মা বিলকিছ আক্তার থেকে ২ হাজার
টাকা নিয়ে প্রথমে অনলাইনে নারীদের কসমেটিক্স ব্যবসা শুরু করি। কিন্তু
করোনাকালিন সময়ে ওই ব্যবসাও বেশিদূর এগুতে পারিনি। বাধ্য হয়ে চান্দিনায় চলে
আসি। যেহেতু আমি চান্দিনার মেয়ে আর চান্দিনার খাদি নিয়ে অন্যরা বেশ
এগুচ্ছে তখন আমিও খাদি নিয়ে কাজ শুরু করি। গড়ে তুলি ‘লেডিস কেয়ার’ নামের
একটি প্রতিষ্ঠান। মাত্র ৬ মাসের মধ্যে আমার ব্যবসার ব্যপক প্রসার ঘটে।
অপরদিকে,
পুলিশ অফিসারের স্ত্রী মীরা মজুমদার খাদিকে ভালবেসে শখের বসে গড়ে তুলেন
‘ঈদিকা ফ্যাশন হাউজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। নিজ বাসায় চরকায় সুতা কাটা,
কাপড় কাটা, নিজ হাতে পোশাক তৈরি, ব্লক ও নকশায় আধুনিক ডিজাইনে তৈরি করছেন
খাদির বিভিন্ন পন্য। ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন কাপল ড্রেস, ফ্যামেলি ড্রেসে। তার
তৈরি খাদি পোশাক দেশের গন্ডি পেরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায়
বসবাসরত বাঙ্গালী গ্রাহকরাও।
মীরা মজুমদার জানান, আমি ২০১৯ সালে উই
নামক একটি প্লাটফর্মে অ্যাড হই। তখন উই প্লাটফর্ম সম্পর্কে আমার কোন ধারণা
ছিল না। সময় কাটানোর জন্য উইতে সবার পোস্ট পড়তাম। অনেক নারীদের উদ্যোক্তা
হওয়ার গল্প পড়ে খুব ভালো লাগতো।
আমি তখন অনার্স শেষ করে বসে ছিলাম, এর
মধ্যেই করোনা মহামারি শুরু হয়ে গেল। চারদিকে হতাশা আর হতাশা। আমি সবসময়
নিজেকে নিয়ে খুব হতাশায় ভুগতাম। আমি ভাবতাম যে আমার দ্বারা কিছুই হবে না।
সাহস জোগায় আমার স্বামী। ২০২০ সালের ৪ এপ্রিল আমার উদ্যোক্তা জীবনের পথ চলা
শুরু। প্রথমত আমার বিনিয়োগ ছিল মাত্র ৬ হাজার টাকা। টাঙ্গাইলের কয়েকটি
শাড়ি দিয়ে শুরু করেছিলাম আমার উদ্যোক্তা জীবন। তাতে তেমন সাড়া না পেয়ে
আবারও হতাশ হই।
তখন গুগলে সার্চ দিয়ে চান্দিনার খাদি সম্পর্কে জানতে
শুরু করলাম। খাদি কাপড় সম্পর্কে আমার কোন প্রকার ধারণা ছিল না। কাজেই কোথায়
তৈরি করা হয় তাও জানতাম না। তারপর একদিন বের হলাম খাদি সম্পর্কে জানার
জন্য কয়েকজন থেকে ধারণা নিয়ে ছুটে যাই খাদি পল্লীতে। গ্রামীণ খাদি থেকে
প্রথম খাদি কাপড় কিনেছি। পাঞ্জাবি শাড়ি ও ওড়না। খাদি কাপড় নিয়ে হেন্ড
পেইন্টিং করে যেদিন পোস্ট করি ওই দিনই খাদি পাঞ্জাবির কাস্টমার পেলাম।
চেষ্টা
করেছি ঐতিহ্যবাহী খাদি কাপড় কিনে নিজ হাতে ব্লক, চরকায় সুতা কেটে ওই সুতায়
নকশা করে নতুন মাত্রা যোগ করতে। ক্রেতাদের সাড়াও পাচ্ছি ব্যাপক। খাদি পণ্য
নিয়ে আরো প্রচার করলে এর চাহিদা দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছি।
প্রসঙ্গত,
কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। কালের বিবর্তনে প্রায়
ধ্বংসের পথে ওই খাদি শিল্প। নতুন প্রজন্মের তরুণ উদ্যোক্তাদের অনলাইন
ব্যবসায় খাদি কাপড়ে আধুনিকতা যোগ হওয়ায় খাদি কাপড়ে তৈরি পোশাকের চাহিদাও
বেড়েছে বেশ। এমন উদ্যোক্তাদের কল্যাণে ফিরে আসবে খাদির ঐতিহ্য এমনটাই মনে
করছেন এই শিল্পের সাথে জড়িত নারী উদ্যোক্তরা।