মো. হাবিবুর রহমান, মুরাদনগর ||
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, সাবেক গণপরিষদ সদস্য, ২০১১ সালে একুশে পদক প্রাপ্ত বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হাজী আবুল হাশেমের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী আজ (শনিবার)। তিনি ২০২১ সালের ৯ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান।
আজীবন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী হিসাবে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত অবিচল ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের কঠিন দু:সময়ের সময় প্রায় ২২ বছর মুরাদনগর উপজেলা সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হিসাবে তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন।
হাজী আবুল হাশেম ১৯২২ সালের ১১ এপ্রিল জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম বদিউল আলম, মায়ের নাম অজিফা খাতুন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার রাজা চাপিতলা। শৈশবের কিছু অংশ গ্রামের বাড়িতে কাটালেও সপরিবারে তিনি ঢাকায় ছিলেন। ঢাকা নবকুমার ইন্সটিটিউট থেকে ১৯৪৩ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৯৪৬-৪৮সাল পর্যন্ত ৩০ টাকা বেতনে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানায় শিক্ষকতা করেন। ৩০ টাকা বেতনে শিক্ষকতা করাকালে তাঁর প্রায় সমবয়সী মিটফোর্ড হাসপাতালে এল.এম.এফ পড়ুয়া লুৎফুর রহমানের অর্থাভাবে লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে তিনি তাকে তাঁর বেতনের অর্ধেক অর্থাৎ প্রতিমাসে ১৫ টাকা করে দিয়ে তার লেখা পড়া চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেন। এ দানই তার উপার্জিত টাকার প্রথম দান।
১৯৪৮ সালে তিনি ১৫০ টাকা বেতনে যোগদেন আদিল-খলিল অ্যান্ড কোম্পানীতে নৈশকালীন চাকুরী হিসাবে কাজ করতেন। অত্যন্ত পরিশ্রমী আবুল হাশেম দিনের বেলা অবসর থাকতে চাননি। তাই তাঁর বাড়ির আঙ্গিনায় ‘গ্লোব প্রিন্টিং প্রেস’ এর মাধ্যমে তাঁর ব্যবসায়িক জীবনের গোড়াপত্তন করেন। তারপর নিউ ঢাকা ব্রেইড ফ্যাক্টরী ও হারিকেনের ফিতা ও কাইতন তৈরীর ফ্যাক্টরী দেন। রুমি মেডিকেল ষ্টোর নামে ঢাকার নিউ মার্কেটে ওষুধের দোকান দিয়ে ব্যবসা করেন। ১৯৬২ সালে জবা টেক্সটাইল ও করিম ইন্ড্রাষ্ট্রিয়াল কর্পোরেশনের মাধ্যমে শিল্পপতি হিসাবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ইষ্ট পাকিস্তান টেক্সটাইল এসোসিয়েশনের সভাপতি ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭০ সালের গণপরিষদের নির্বাচনে হাজী আবুল হাশেম তৎকালীন মুরাদনগর ও হোমনা থানা হতে নির্বাচন করে নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ হোটেল পূর্বানীতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে এক বৈঠক করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ঐ বৈঠকে আওয়ামী লীগের সকল গণপরিষদ সদস্যকে নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে এলাকাবাসীকে সংগঠিত করার নির্দেশ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর এ নির্দেশ অনুযায়ী গণপরিষদ সদস্য হিসাবে নিজ এলাকা মুরাদনগর ও হোমনাসহ বাঞ্চারামপুর থানার বেশ কিছু গ্রামে গিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। ১৯৭১ সালের ১৮ মে তিনি চলে যান আগরতলার কর্নেল চৌমুহনীতে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্যে তিনি আগতদের স্লিপে স্বাক্ষর দিয়ে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। মুরাদনগর ও হোমনা থানা ছিল ২নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন হায়দারের অধীনে। ভারতের আগরতলায় হাফাইনন্যা, মেলাঘর নামে মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পছিল। হাজী আবুল হাশেম এ ক্যাম্পের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। মুরাদনগর-হোমনা এলাকা শত্রু মুক্ত হয় ১০ ডিসেম্বর এবং দেশ স্বাধীন হয় ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা দেওয়ার আহবান জানালে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অস্ত্র জমা দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মুরাদনগর ও হোমনা এই দুই থানার এডমিনিষ্ট্রেশনের দায়িত্ব পালন করেন।
হাজী আবুল হাশেম কোম্পানীগঞ্জ বদিউল আলম উচ্চ বিদ্যালয়, কোম্পানীগঞ্জ বদিউল আলম কলেজ, চাপিতলা অজিফা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়, মুরাদনগর নুরুন্নাহার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বাখরনগর হাশেমিয়া সিনিয়র মাদরাসা, সল্পা প্রাথমিক বিদ্যালয়, কচুয়ার পাড় প্রাথমিক বিদ্যালয়, হোমনা উপজেলার রামকৃষ্ণপুর কলেজ, কামাল স্মৃতি গার্লস হাই স্কুল, কাশীপুর হাশেমিয়া হাই স্কুল, ফেনী জেলার দক্ষিন রাজেশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঠাকুরগাঁয়ে নূরুন্নাহার প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ সারাদেশে ৬৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন।
শিক্ষা ও সমাজসেবায় তাঁর এ অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ ২০১১ সালে একুশ পদকে হাজী আবুল হাশেমকে সম্মানীত করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর হাতে একুশে পদক তুলে দেন। মুরাদনগর-হোমনা উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন জনপদে জ্ঞানের মশাল হিসাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করায় মানুষের মনে ঠাই করে নিয়েছেন হাজী আবুল হাশেম। তার অসামান্য অবদানের কারনে তিনি চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবেন।