এবিএম আতিকুর রহমান বাশার ||
কুমিল্লার দেবীদ্বার পৌর এলাকায় আবেদনের ৫ বছর পরও বিদ্যুৎ সংযোগ পায়নি ৪ পরিবার। ফলে ‘কুপি বাতি’ ‘হারিকেন’ ও মোম বাতিই তাদের একমাত্র ভরসা। পৌরসভার পোনরা (উত্তর পাড়া) এলাকায় বাস করা ওই ৪ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১৭ জন। এরমধ্যে ৮ সদস্য স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। ওই বাড়ির চারপাশের লোকজন যখন বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত- তখন ‘অন্ধকারে প্রহর কাটছে’ তাদের। যদিও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্তারা বলছেন, দুই বছর আগেই দেবীদ্বার পৌরসভাকে শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আনা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালী এক প্রতিবেশেীর কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ মিলছে না তাদের।
ভোক্তভুগী ওই এলাকার বাবরি মিয়া জানান, ‘প্রায় ৩০ বছর পূর্বে আবাসন পরিবর্তন করে এ এলাকায় ৩০ শতাংশ জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করি। স্ত্রী ও তিন পুত্র নিয়ে এ বাড়িতে বসবাস করে আসছি। এরই মধ্যে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ১৭ জন। তিন ছেলেই আলাদা থাকেন। আমিও আমার স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা থাকি। প্রায় ১০ বছর পূর্বে প্রতিবেশীরা বিদ্যুতায়নের অন্তর্ভূক্ত হলেও আর্থিক অসচ্ছ্বলতার কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে পারি নাই।
বাবরি মিয়ার বড় ছেলে নাছির উদ্দিন জানান, তাদের বাড়ির ১১ পরিবার গত ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর বিদ্যুৎসংযোগ পেতে স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে আবেদন করেন। বিদ্যুৎ অফিস থেকে ১১টি বৈদ্যুতিক মিটার অনুমোদন পেলেও প্রতিবেশী হুমায়ুন কবির ও তার পরিবারের প্রতিরোধে তাদের চার পরিবার বিদ্যুৎ সংযোগ পাননি।
এ বিষয়ে হুমায়ুন কবিরের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আমার ৩শতক জমি বাবরি মিয়ার দখলে, ওই জমি যতক্ষণ না ফেরত দেবে- ততক্ষণ বিদ্যুৎ সংযোগ পাবে না।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (কুমিল্লা) চান্দিনা-১ এর দেবীদ্বার জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী শ্রী দিপক কুমার সিংহ বলেন, প্রায় দু’বছর পূর্বে দেবীদ্বারকে শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আনা হয়। তবে বাবরি মিয়ার বাড়ির ৪ পরিবার এখনো বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে বঞ্চিত রয়েছে। প্রায় চার দফা এজিএম, ঠিকাদার, পুলিশ ও আমিসহ বিপুল জনবল নিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে গিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। ওই বাড়ির প্রায় ৩০/৪০জন মহিলা এসে অকথ্য ভাষায় গালমন্দই নয়, কাজ করতে গেলে বৈদ্যুতিক খুটি জড়িয়ে ধরে রাখে। কর্তব্যকাজে বাঁধাদানের অভিযোগে আমি নিজে বাদী হয়ে হুমায়ুন কবির সহ কয়েকজনকে অভিযুক্ত করে থানায় মামলা করেছি। বিদ্যুৎ সংযোগ নিরাপদ করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জিএমসহ উর্ধতন কর্মকর্তাদের লিখিত অভিযোগে অবহিত করেছি। এ ঘটনায় স্থানীয় সাংসদের পিতা সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা এএফএম ফখরুল ইসলাম মূন্সী, আবুল কাসেম চেয়ারম্যানসহ এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিগণ সালিসেও তার সমাধান দিতে পারেননি বলেও শোনেছি।
দেবীদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আশিক-উন-নবী তালুকদার জানান, পল্লীবিদ্যুতের লোকজন যখন বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে যাবে তখন সমন্বয় করে যেতে হবে। নির্বাহী ম্যাজিেেষ্ট্রট, পুলিশ, পল্লীবিদ্যুতের লোকজন একসাথে টাস্কফোর্স গঠন করে গেলে সমস্যা থাকার কথা নয়। আমাকে কখনো ওভাবে বলা হয়নি। বিষয়টি আমি দেখছি।
গত রোববার রাতে দেবীদ্বার পৌর এলাকার পোনরা গ্রামের বাবরি মিয়ার বাড়ি দেখতে সরেজমিনে যেয়ে দেখা যায়, বাড়িটি একটি ‘ভুতুরে বাড়ি’। বাঁশঝার আর গাছ গাছালিতে ভরপুর অন্ধকার বাড়িতে পা রাখতেই গা ছম ছম করছে। একটু ভেতরে ঢুকেই শোনা যায় কুপি বাতি, হারিকেন, মোমবাতির নিভু নিভু আলোয় ছোট ছোট ঘরে শিক্ষার্থীদের পড়ার শব্দ।
ঘরে ঢুকে দেখা যায়, গৃহিনী হোসনেয়ারা বেগম চৌকিতে মোমবাতি জ¦ালিয়ে তার পুত্র প্রথম শ্রেণীর ছাত্র ইয়াছিনকে পড়াচ্ছেন। ইয়াছিন বারুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ে। হোসনেয়ারা বলেন, গরমে সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি, হাতে হাতপাখা নিয়েও সন্তানকে বাতাস দিতে পারছি না, মোমবাতি নিভে যাবে। পাশের টেবিলে কুপি বাতির আলোতে পড়ছেন জুয়েল রানা, সে এলাহাবাদ মহা বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। জুয়েল জানায় তাদের অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হয়। টেবিলের অভাবে তার একমাত্র বোন পাপিয়া আক্তার দাদার ঘরে পড়ছে। পাপিয়া বারুর আলী হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী।
আর একটু ভেতরে নির্জন ঘরে প্রবেশ করে দেখা যায়, সিএনজি চালক বাছির উদ্দিনের দুই ছেলে শাহাদাত হোসেন ও সায়মন হোসেন একটি ছোট টেবিলে বসে কেরোসিনের কুপি বাতির আলোতে লেখাপড়া করছে। শাহাদাত বারুর আলী হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীতে এবং সায়মন বারুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। পাশের কক্ষে মাশিকাড়া মাদ্রাসায় মিজান শ্রেণীতে পড়ুয়া সাবিবা কুপি বাতির আলোতে পড়ছেন।