একজন সন্তানের কাছে মা হচ্ছে সবচেয়ে আপন ও সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল। শিশুর প্রথম বুলিই মা শব্দটি। পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থাকে মায়ের। যে সবকিছু থেকে সন্তানকে আগলে রাখে তার সন্তানকে। মাকে নিয়ে তাই তো কবি কাদের নেওয়াজ লিখেছিলেন-
“মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু জেনো ভাই,/ইহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই/ সত্য ন্যায়ের ধর্ম থাকুক মাথার’ পরে আজি/ অন্তরে মা থাকুক মম, ঝরুক স্নেহরাজি।”
এছাড়াও সারাবিশ্বের কবি-সাহিত্যিকেরা ছন্দে ছন্দে কিংবা গল্প-উপন্যাসের লাইনে লাইনে প্রকাশ করেছেন যে মায়ের মতো আপন কেউ হতে পারে না। মায়ের আদর-স্নেহ-ভালোবাসা কিংবা সঙ্গ না পেলে শিশুর অস্থিরতা বাড়তে থাকে এবং শিশুর মানসিক ভারসাম্য বিশৃঙ্খলের দিকে এগুতে থাকে। একজন সন্তানের জীবনে মায়ের অবদান কোনো কিছুর বিনিময়ের শোধ করা যাবে না।
বছরের বিশেষ বিশেষ দিনগুলো পালন করা হয় ঘটা করে। সেই বিশেষ দিনে বাদ যায়নি মা-ও। প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় বরিবার সারাবিশ্বে পালিত হয় ‘বিশ্ব মা দিবস’। পুরো বছর মাকে ভালোবাসার কথা জানাতে না পারলেও এই দিনে জানিয়ে দিতে পারেন।
সবার জীবনের বিশেষ এই মানুষটিকে নিয়ে যেভাবে খুশি পালন করতে পারেন বিশেষ দিনটি। এই দিনে মায়ের সঙ্গে ভালোবাসা আরও মজবুত হতে পারে সন্তানের। এ দিবসে মাকে বিশেষভাবে সম্মানিত করতে পারাটা সৌভাগ্যেরই ব্যাপার।
তবে জানেন কি, মা দিবস এলো কীভাবে? অনেকেই এই দিবসের বিরোধিতা করেন। তাদের মতে বছরের প্রতিটি দিনই মাকে ভালোবাসার। একটি দিনে কেন লোক দেখানো ভালোবাসা দেখাতে হবে। তবে মা দিবসের একটি ইতিহাস রয়েছে।
এই দিনটি পালন শুরু হয়েছিল প্রাচীন গ্রীক ও রোমানরা মা দেবী রিয়া ও সাইবেলিকে উৎসব উৎসর্গ করতে। ষোড়শ শতকে এসে এই দিনটি ইংল্যান্ডে মাদারিং সানডে’র উদ্ভব হয়। এ দিবসটি উদযাপন করা হতো লেন্টের (খ্রিস্টানদের ৪০ দিনের পর্ব) চতুর্থ রোববারে।
মাদারিং সানডেতে ছেলেমেয়েরা পারিবারিক চার্চ বা মাদার চার্চের উদ্দেশ্যে পবিত্র যাত্রা শুরু করতো। এ দিবসটি পারিবারিক পুনর্মিলনের সুযোগ করে দিত এবং ঘরের ভৃত্যদের ছুটি দেওয়া হতো। বিশেষ করে মেয়েদেরকে ছুটি দেওয়া হত। যেন তারা মায়েদের সঙ্গে দেখা করতে পারে।
যুক্তরাজ্যে এখনো লেন্টের চতুর্থ রোববারে মাদারিং সানডে উদযাপন করা হয়। যদিও এটি আধুনিক সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ ছুটির দিনে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবসের আধুনিক সংস্করণ করেছিলেন জন্য আনা মারিয়া জার্ভিস নামের এক নারী। যদিও তিনি নিজে কখনো মা হতে পারেননি।
১৯০৭ সালের এক রোববার আনা মারিয়া স্কুলের বক্তব্যে মায়ের জন্য একটি দিবসের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। ১৯০৮ সালে তার নিজের মাকে সম্মান জানাতে অথবা স্মরণ করতে প্রথম মা দিবস উদযাপন করেন আনা। সেদিন ছিল আনার মা আনা রিভিস জার্ভিসের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকি। ওই বছর তিনি তার সান ডে স্কুলে প্রথম এ দিনটি মাতৃদিবস হিসেবে পালন করেন। ১৯১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৮তম প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মা দিবসকে ছুটির দিন ঘোষণা করেন।
তবে একটা সময় আনা জার্ভিস নিজেই মা দিবসের প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়েন। তিনি যে লক্ষ্যে মা দিবস পালন শুরু করেছিলেন তা এখনকার মা দিবসের সঙ্গে কোনো মিল নেই। তিনি বুঝতে পারছিলেন এই দিনটি কেবল একটি ছুটির দিন, শুভেচ্ছা কার্ড, চকলেট ও ফুল সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে আছে।
যা দেখে তিনি খুবই বিরক্ত হতে থাকেন। তিনি এ ধরনের উদযাপনের প্রতিবাদ করেন এবং এ দিনটিকে যেন চ্যারিটির জন্য অর্থসংগ্রহে ব্যবহার করা হয় তার প্রচেষ্টা চালান। তিনি মা দিবসের বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে ১৯৪৪ সালের মধ্যে ৩৩টি মামলায় জড়িয়ে পড়েন।
তারপরও তার এ প্রতিবাদ থেমে থাকেনি। তিনি তার পুরো জীবন ও সঞ্চয় এ ছুটির দিনের বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্যয় করেছেন। তিনি তার শেষ জীবনের কিছু বছর কাটান স্যানিটারিয়াম বা স্বাস্থ্যনিবাসে এবং ১৯৪৮ সালে কপর্দকহীন অবস্থায় মারা যান।
তাকে ফিলাডেলফিয়ার ওয়েস্ট লরেল হিল কবরস্থানে তার মায়ের পাশে সমাহিত করা হয়। তার দাফনের আনার সম্মানে দিন পশ্চিম ভার্জিনিয়ার গ্রাফটনের অ্যান্ড্রুস চার্চের ঘণ্টা ৮৪ বার বেজেছিল। আনার লড়াই তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়েছে। এখনো প্রতি বছর এই দিনটি পালিত হয় বিশ্ব মা দিবস হিসেবে।
তবে একেক দেশে মা দিবস পালন করা হয় একেকভাবে। চলুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে কোন দেশে পালিত হয় মা দিবস-
এ দিবসে মেক্সিকান মায়েরা খাবার, ফুল ও সংগীত দ্বারা সম্মানিত হন। মেক্সিকান ছেলেমেয়েরা মায়েদের উদ্দেশ্যে লাস মানানিতাসের মতো জনপ্রিয় গান গাওয়ার জন্য মেক্সিকোর মারিয়াচি ব্যান্ডে যোগ দিয়ে থাকে।
ইথিওপিয়াতে বর্ষাকালের শেষে মায়েদের সম্মানার্থে তিন দিনব্যাপী অ্যাট্রোস্থ উৎসব উদযাপন করা হয়- ইথিওপিয়ান পরিবার মায়েদের জন্য মিট হ্যাশ তৈরি করে, এটির জন্য কন্যারা শাকসবজি ও পনির আনে এবং পুত্রেরা আনে মাংস।
যুগোস্লাভিয়ায় মা দিবস উদযাপন করা হয় ডিসেম্বরে। এছাড়া দিবসটি উদযাপনও হয় ভিন্নভাবে। শিশুরা এদিন খুব ভোরে বিছানায় উঠে মাকে বেঁধে ফেলে শক্ত করে। সন্তানকে উপহার না দেওয়া পর্যন্ত এই বাঁধন থেকে মায়ের মুক্তি মেলে না।
ফ্রান্সে ঐতিহ্যবাহী গিফট হলো ফুলাকৃতির কেক। সেদেশে ১৯২০ সালে সেসব মায়েদেরকে পদকে ভূষিত করা হয় যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবার বড় করে দেশের জনসংখ্যা বাড়াতে অবদান রেখেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবস বিশেষ একটি দিন। বছরের এই দিনে তারা পরিবার এবং মায়েদের সঙ্গে দেখা করতে আসে এবং মায়ের পছন্দের ফুল উপহার দেয়।
সুইডেনে মে মাসের শেষ রোববার মা দিবস পালিত হয়। মা দিবস উপলক্ষে শিশুরা প্লাস্টিকের ফুল বিক্রি করে। ফুল বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যায়, তা দিয়ে মাকে নিয়ে পার্কে এবং প্রিয় রেস্তোরাঁয় খাবার খেতে যায়। তারা মায়েদের হাতে ফুলও তুলে দেয় শুভেচ্ছাস্বরূপ।
তাইওয়ানে মা দিবসের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কারণ এ দেশে মা দিবস পালিত হয় গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন অনুসারে। এ কারণে দেশটিতে মা দিবস অত্যন্ত পবিত্র উৎসব হিসেবে পালিত হয়। নানা উৎসাহ উদ্দীপনায় দিনটি পালিত হয়।
জাপানে হাহা-নো-হি নামে পরিচিত এই দিনটি। দিনটিতে ছেলে-মেয়েরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ভালোবাসাময় বার্তার মাধ্যমে মাকে শুভেচ্ছা জানায়। প্রত্যেকে মাকে পছন্দের ফুল উপহার দেয়।
সূত্র: এনডিটিভি