বঙ্গবন্ধু ও নজরুল
জুলফিকার নিউটন ||
জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীপ্রায়শ সভা-সমিতিতে একটি কথা বলেন, “বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রায় হাজার বছরের ইতিহাসে দু’জন মাত্র প্রতিভাবান বাঙালি জন্মগ্রহণ করেছেন একজন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, অপরজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কবীর চৌধুরীর ঐ বক্তব্য বেশ কয়েক বছর আগে একটি সভায় প্রথম শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম, কারণ ঐ দু’টি মানুষের জীবন ও কর্মকাণ্ডের মধ্যেই শুধু মিল বা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না, সঙ্গে সঙ্গে একটা কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে বিদ্রোহী কবি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পূর্বসূরী আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিদ্রোহী কবির যথার্থ উত্তরসূরী। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ অপরাহ্নে রমনা রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ বক্তৃতা মঞ্চের সামনে খুব কাছাকাছি থেকে শোনার ও ভাষণরত বঙ্গবন্ধুকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেদিন এবং তারপর যতবার বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ শুনেছি বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে দেখেছি, ততবার আকাশের দিকে বঙ্গবন্ধুর উন্নত শির ও তর্জনীসহ উত্থিত হাতটি আমাকে বারবার বিদ্রোহী কবির বিখ্যাত কবিতার সেই চিরন্তন পঙক্তিগুলিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, বল বীর চির উন্নত মম শির, শির নেহারি আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রির”। বিদ্রোহী কবির চির উন্নত শির-এর জীবন্ত চিত্রকল্প ৭ মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উন্নত শর, উদ্যত হস্ত ও তর্জনী এবং বিদ্রোহীর জীবন্ত প্রতিকল্প সেই সিংহ গর্জন ‘এবারের সংগ্রাম.....। ৭ মার্চ জনসভায় বঙ্গবন্ধু নজরুলের কবিতার মহাবিদ্রোহীর প্রতিমূর্তি। বঙ্গবন্ধুর একাত্তরের সাতই মার্চ অপরাহ্নের উন্নত শির ও বলিষ্ঠ জাগরণ আর কোনো বাঙালি নেতার মধ্যে আগে দেখা গেছে কি? সেদিন বঙ্গবন্ধু নিজেকে বহুদূর ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।
নজরুলের কবিতা তার নির্যাতিত পূর্বপুরুষের গল্পকথা। ঔপনিবেশিক সম্পর্কের ভিতর তার গল্পগুলো যুদ্ধের স্বরূপ, সাধারণ মানুষের শক্তি উন্মোচিত করেছে, এখান থেকে একটা বিকল্প জাতির উত্থানের সম্ভাবনা তিনি ভেবেছেন। বিদ্যমান বাঙালি জাতি ইংরেজি শিক্ষিত ও পাশ্চাত্য প্রভাবিত, বিদ্রোহ করতে ভুলে গেছে। বিপরীতে তিনি কবিতা লিখেছেন ইতিহাসকে সঙ্গী করে, এই বিকল্প জাতি বিদ্রোহপ্রবণ, বিকল্প অর্থ উদ্ভাবনে ক্ষমতাবহ। বিদ্রোহ থেকে প্রেমে, ধর্মজ সঙ্গীত থেকে লোকজপালায় এই বিকল্প প্রবহমান। নজরুল এই বিকল্পের মধ্যে মগ্ন থেকেছেন, বরাবর।
লোকজ বাঙালি বিদ্যমান শিক্ষিত বাঙালি থেকে ভিন্ন, তেমনি ইংরেজ শাসক থেকে ভিন্ন। এই ভিন্নতা ইতিহাসের দিক থেকে, রাজনীতির দিক থেকে, সংস্কৃতির দিক থেকে নির্মিত। এই নির্মিতির ধারণা থেকে তৈরি একটা নতুন সাংস্কৃতিক রাজনীতি। এই রাজনীতি ভিন্নতা অবদমিত করে না, যেমন ভেবেছেন ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালিরা; এই ভিন্নতা শাসকদের সঙ্গে এবং শিক্ষিত বাঙালিদের সঙ্গে নিজেদের স্বাতন্ত্র তৈরি করে রাখে। এই স্বাতন্ত্র্য নজরুলের মধ্যে দীপ্যমান। ভিন্নতার প্রয়োজন থেকেই অটোমাস ব্যক্তিদের উদ্ভব ঘটে, যাদের আছে সমালোচনা মনস্কতা এবং সমাজের ক্ষেত্রে ইতিহাসের দিক থেকে ভূমিকা। অ-ইউরোপীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, উপনিবেশের পরিসরে, নজরুল এই অটোমাস ভূমিকা পালন করেছেন। সেজন্য সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে কারও মেলে না, তাঁর সাংস্কৃতিক রাজনীতি অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র। তার প্রস্তাবিত সাংস্কৃতিক স্বরূপ একই সঙ্গে প্রয়োজন ও কল্পকথা, যেমন হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ : যে লাঠিতে আজ টুটে গম্বুজ, পড়ে মন্দির চূড়া,/সেই লাঠি কালি প্রভাতে করিবে শত্রু-দুর্গ গুড়া।/প্রভাতে হবে না ভায়ে-ভায়ে রণ, চিনিবে শত্রু, চিনিবে স্বজন।/করুক কলহ জেগেছে তো তবু বিজয়-কেতন উড়া।/ল্যাজে তোর যদি লেগেছে আগুন, স্বর্ণলঙ্কা পুড়া।
নজরুল সংস্কৃতি ও জাতি নিয়ে কাজ করেছেন এবং দেখেছেন দুইয়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য। তিনি দেখেছেন বিদ্রোহী আইডেনটিটি নির্মাণ করা সম্ভব, কিন্তু এই আইডেনটিটি ঘিরে আছে সমাজের বদলে সাম্প্রদায়িকতা, শ্রেণীর বদলে শিক্ষিত দ্রলোকদের আস্ফালন। তার ফলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঔপনিবেশিকতাবাদবিরোধী বিদ্রোহী সত্তা সাম্প্রদায়িকতার আবর্তে এবং ভদ্রলোকদের আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। বিদ্রোহের রাজনৈতিক অবস্থান কেবল প্রগতিশীল কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল, কেবল বুর্জোয়া কিংবা রেডিক্যাল নয়, এই অবস্থানটি ইতিহাসের অংশ, বৈপরীত্য দীর্ণ, সেজন্য নজরুল সমাজের মধ্যে ভণ্ডামি, হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের মধ্যে শাণিত ছুরি লুকানো দেখতে পান, ব্রিটিশ আইনকানুনের মধ্যে হিংস্র কদর্যতা দেখতে পান। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রতিরোধের ভাব, মুহূর্ত, অবস্থানকে তিনি বড়ো করে তোলেন। তাঁর এই সমালোচনমনস্কতা বায়বীয় আদর্শবাদের বিপরীতে কঠিন বাস্তবতা, এই বাস্তবতা তাঁকে তিক্ত করেছে তেমনি করেছে দূরসন্ধানী। এই সমালোচনমনস্কতা শিক্ষিত ভদ্রলোক হিন্দু ও মুসলিম মধ্যশ্রেণী সহ্য করতে পারেনি। না-পারার দরুন তাঁর সাহিত্যকর্মের নান্দনিকতা জ্বশ্রেণীর নান্দনিকতা থেকে সহস্র মাইল দূর। উপনিবেশবিরোধী ডিসকোর্স থেকে এবং উপনিবেশবিরোধী লড়াই থেকে তিনি কলোনিয়াল বিপ্লবের পোয়েটিক্স ও পলিটিক্স তৈরি করেছেন। এখানেই তাঁর নান্দনিকতার ভিত্তি ও তাঁর সঙ্গে সমসাময়িক অন্যদের তফাৎ। তাঁর সাহিত্যকর্ম থেকে নজরুলের যে-ইমেজ উদ্ভাসিত, সেখানে তিনি এক ট্র্যাজিক ফিগার। তিনি হয়ে ওঠেন বিপ্লবহীন বিপ্লবের কবি। তাঁর কবিতায় উচ্চকিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে পবিত্র ক্রোধ। এভাবে তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে কলোনিয়ালিজমের ওপর পলিটিক্যাল ও এথিক্যাল এক টেস্টামেন্ট। নির্যাতন নামক এক ভুবনের বাসিন্দা, বঞ্চনা নামক এক ধরিত্রীর মানুষজন, অপমানিত হতে হতে লাঞ্ছিত হতে হতে জাতীয় চেতনায় পৌঁছে গিয়ে দেখে সেখানে জাতীয় চেতনার বদলে সাম্প্রদায়িক চেতনা প্রবল, জাতীয় ঐক্যের বদলে সাম্প্রদায়িক ধর্মজ ঐক্য প্রবল, উপনিবেশবাদ বিরোধিতার বদলে পশ্চিমের প্রতি ভক্তি প্রবল। নজরুলের কবিতা এই বৈপরীত্যের সূত্রটাকে আঘাত করেছে থেকে থেকে। নজরুল রাজনৈতিক নির্যাতনের সমান্তরালে সাংস্কৃতিক নির্যাতনকে তুলে ধরেছেন এবং ভেবেছেন জাতীয় মুক্তি সংস্কৃতির একটি প্রয়োজনীয় কাজ।
নজরুল দু’টি সংস্কৃতির মধ্যে কাজ করেছেন। নজরুল হিন্দু সমাজ উৎসারিত সংস্কৃতি এবং মুসলিম সমাজ উৎসারিত সংস্কৃতির মধ্যে কাজ করে পৌছেছেন। মানবিকতাবাদে এবং উন্মোচিত করেছেন মানবিকতাবাদের সমস্যাগুলো। কলোনির বাংলায় মানবিকতাবাদের অভিজ্ঞতা ধরা দিয়েছে বৈদেশী হেজিমনি হিসাবে। ব্রিটিশরা আমাদের ইতিহাস ছেড়ে দিতে বলেছে এবং যুক্ত হতে বলেছে তাদের ইতিহাসে কিংবা ইউরোপীয় আধুনিকতায়। জাতীয় মুক্তির অন্য অর্থ হচ্ছে আমাদের নিজেদের ইতিহাসে ফিরে আসার ইচ্ছাশক্তি। নজরুল এক্ষেত্রেই কাজ করেছেন, প্রথার বিরুদ্ধে যেতে বলেছেন, পুরনো ঐতিহ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার সাহসের কথা বলেছেন এবং ভবিষ্যৎ উদ্ভাবনের সাহসের কথা ভেবেছেন। সাহস না হলে প্রকৃত ইতিহাসে প্রবেশ করা যায় না। নজরুলের এই প্রজেক্টটি রাজনৈতিক, মতাদর্শিক, নান্দনিক। তাঁর সাংস্কৃতিক রাজনীতির এই প্রক্রিয়া বাংলা কবিতাকে ঘিরে ধরেছে। ফণি-মনসা ও সন্ধ্যা বই দুটির এই কাব্য পাঠ বৈধ বলে মনে হয়।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ অপরাহ্নে রমনার মাঠে লক্ষ লক্ষ বাঙালি একটি মানুষের মধ্যে তাদের হাজার বছরের সংগ্রামী ঐতিহ্যের প্রতিফলনে তা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তারা বিষ্ময়ের সঙ্গে তাদের চোখের সামনে কীভাবে একটি সাধারণ মানুষ অসাধারণ হয়ে উঠছিলেন তা প্রত্যক্ষ করেছিল। ৭ মার্চের জনসভায় উপস্থিত আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা ভাষণ দানরত বঙ্গবন্ধুকে আবেগে অভিব্যক্তিতে মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে অতিমানুষে পরিণত হওয়ার অভাবনীয় ঘটনা অবলোকন করে নিজেরাও অতি মানবে পরিণত হয়েছিল।
১৯২৯ সালে বাঙালি জাতির দেওয়া জাতীয় সংবর্ধনার উত্তরে নজরুল বলেছিলেন, ‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তুর্যবাদকের একজন আমি- এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি জানি, এই পথ-যাত্রার পাকে পাকে বাঁকে বাঁকে কুটিল ফণা ভুজঙ্গ, প্রখর-দর্শন শার্দুল পশুরাজের ভ্রুকুটি! এবং তাদের নখর-দংশনের মত আজো আমার অঙ্গে অঙ্গে। তবু ওই আমার পথ, ওই আমার গতি, এই আমার ধ্রুব। আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা পেয়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তাঁর চোখে জলভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্থানের পথে তাঁকে ক্ষুধা-দীন মূর্তিতে, ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকূপে তাঁকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাঁকে দেখেছি।” বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের অভিযান সেনাদলের তূর্যবাদকরূপে বাঙালি পেয়েছিল নজরুল আর বঙ্গবন্ধুকে। বিদ্রোহী কবির ঐ ভাষণের সঙ্গে তুলনীয় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, “আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলে জানেন এবং বোঝেন, আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ... আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়...। কিন্তু বাংলার মানুষ অধিকার চায়, কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলছি, বাংলার ইতিহাস করুণ... ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস মুমূর্ষ মানুষের করুণ আর্তনাদ-এদেশের করুণ ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্তে রঞ্জিত করার ইতিহাস।...” নজরুল জাতীয় সংবর্ধনার উত্তরে কবি তার ভাষায় যা বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নির্জলা গদ্যে কি একই কথা বলেননি?
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। দেশের অধিকার চাই।... এরপর যদি একটা গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় তোমাদের কাছে আমাদের অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা কিছু আছে সবকিছু আমি হুকুম যদি দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে...।” বস্তুত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বাঙালি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল এবং বিজয়কে ছিনিয়ে এনেছিল। বিদ্রোহী কবি ‘বিদ্রোহী’ কবিতার উপসংহারে লিখেছিলেন।
মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত,
আমি সেই দিন হব শান্ত।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার ঐ স্তবকটি তুলনীয় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের উপসংহারের সঙ্গে, কিন্তু আর তোমরা গুলি করার চেষ্টা করো না। সাতকোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।... আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। কবির স্বপ্ন, কবিতা কীভাবে একটি জাতির জীবনের সত্য হয়ে ওঠে নজরুলের ‘বিদ্রোহী; কবিতা আর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ’ তার উদাহরণ। বস্তুত বিদ্রোহী কবির ‘বিদ্রোহী কবিতায় চিত্রকল্প ৭ মার্চ অপরাহ্নে রমনা জনসমুদ্রে মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত বঙ্গবন্ধুর মধ্যদিয়ে মূর্ত ও জীবন্ত হয়ে উঠেছিল।
কাজী নজরুল বাঙালি জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের মনের শিকল গড়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু বাঙালির হাজার বছরের হাতের শিকল ছিড়েছেন। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী যথার্থই বলেন, “বাঙালি মুসলমান সমাজ হাজার বছরের ইতিহাসে দু’জন শ্রেষ্ঠ বাঙালি সৃষ্টি করতে পেরেছে- কাজী নজরুল ইসলাম ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।”
অর্ধেন্দু শর্মার কবিতাজাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কে নিবেদিত
বর পুত্র
(কাজী নজরুল ইসলাম স্মরণে)
তুমি একটা স্বপ্ন বৃক্ষ
তুমি একটা পাখি
ভোর জেগেছে তোমার গানে
হৃদ কমলে রাখি।
জল ছবিতে স্বপ্ন তুমি
থাকবে তুমি মনে
তুমি আছো তুমি ছিলে
কাঁচা-পাকা সবখানে।
বিস্ময়ে বুক ভরে ওঠে
তোমার কর্ম পাঠে
ঈশ্বরের বর পুত্র তুমি
এমন কীর্তি ঘটে।
সর্বজনীন
(কাজী নজরুল ইসলাম স্মরণে)
মক্কা কিংবা বৃন্দাবনে
সবখানে বিচরণ
গৌতমে আর বাইবেলেতে
তুমি কর অন্বেষণ।
শ্যামা সঙ্গীত হাম-নাতে
মানুষের গান গাও
তোমার মাঝে লেটু গান আর
ভাটিয়ালী নাও বাও।
রণ ঝংকারে বারুদ তুমি
নারদের একতারা
বিরাট শিশু খেলে বিশ্বে
তুমি আত্মহারা।
কোন ধর্মে যায় না বাধা
তুমি সর্বজনীন
মাতৃ দুধে হয় না প্রভেদ
বিভেদ হয় মলিন।
এক পৃথিবী একই রবি
একই চন্দ্রের খেলা
নিন্দুকেরা জাবর কাটে
বন্ধ হবে মেলা।
॥ ঠিকানা ॥
অর্ধেন্দু শর্মা
শতদল পেপার হাউজ
কোর্ট রোড, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩৪০০, বাংলাদেশ
মোবাইল : ০১৭১৭ ৪৬ ১৬ ৭২
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ : বিশ্ববীক্ষার অনন্য পাঠসৌম্য সালেক ||
লর্ড বায়রন তাঁর কবি জীবনের মধ্যপর্বে এসে একদিন বলেছিলেনÑ ‘ও ড়িশব ঁঢ় ড়হব সড়ৎহরহম ধহফ ভড়ঁহফ সুংষবভ ভধসড়ঁং.’ বায়রনের এই উক্তিটি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনে দারুন তাৎপর্যের সাথে ঘটেছে। যদিও ‘বিদ্রোহী’ রচনার আগে নজরুল কয়েকটি ভালো কবিতা লিখেছেন কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ রচনার পর এক সকালে নজরুল সত্যিই কবি হয়ে উঠলেন এবং সেটা প্রপাগাণ্ডা সৃষ্টি করে নয় বরং ‘বিদ্রোহী’র বাণী অশ^বেগে সশব্দে ছুটেছিল দিকবিদিক। কোনও একটি কবিতা প্রকাশের পর দেশব্যাপী এমন আলোড়ন সৃষ্টির ইতিহাস বাংলা সাহিত্যে আর নেই, বিশ্বসাহিত্যেও এমন তোলপাড় সৃষ্টিকারী কোনও কবিতার কথা আমরা শুনতে পাই নি।
কবি’র বন্ধু মুজফ্ফর আহমদ-এর বয়ানে জানতে পাই ‘বিদ্রোহী রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। আমার মনে হয়, নজরুল ইসলাম শেষ রাত্রে ঘুম থেকে উঠে কবিতাটি লিখেছিল। তা না হলে এত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না। এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে নজরুলের কিংবা আমার ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে তার হাত তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেন্সিলে লিখেছিল।’ বিদ্রোহী এক অধিবাস্তব মুহূর্তের স্বত:স্ফূর্ত প্রকাশ। পরিকল্পিতভাবে সাধারণ সৃজন প্রক্রিয়ায় কোনও অভিব্যক্তির এমন দুর্দান্ত প্রকাশ অসম্ভব। এ ব্যাপারে সৈয়দ শামসুল হকের ভাষ্যটি যথার্থ, ‘ শুনেছি, ভূতগ্রস্তের মতো আমরা একে সাধারণ কথায় বলব কবিতায়-পাওয়া, নজরুল সেই রাত্রিঘন আলো-আঁধারিতে একটানা লিখে উঠেছিলেন বিদ্রোহীর ১৪৭টি পঙ্ক্তি।’
বিদ্রোহী প্রথম প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায়, ছাপার পরপরই এটির খ্যাতি দারুণভাবে চারদিক ছড়িয়ে পড়ে, সে সপ্তাহে বিজলী দুইবার ছাপতে হয়েছে, দুইবার সেটি ঊনত্রিশ হাজার কপি ছাপতে হয়েছে, পাঠক চাহিদা মেটানোর জন্যে। মুজফ্ফর আহমদÑ এর ভাষ্য, ‘প্রায় দেড় দু’লক্ষ লোক কবিতাটি তখন পড়েছিলেন, যার ফলে নজরুলের কবিপ্রতিষ্ঠা খুব বেশি-রকমে বেড়ে গেল।’ বিজলীর পরে বিদ্রোহী ছাপা হয় ‘মোসলেম ভারত’Ñ পত্রিকায় এবং সন্নিহিত সময়ে বিদ্রোহীÑ ‘প্রবাসী’,‘ সাধনা’, ‘ধূমকেতু’ এবং ‘দৈনিক বসুমতি’-তে ছাপা হয়।
পরম নিখুঁত কিংবা তর্কাতীত বলে কোন শিল্পকর্ম পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করতে পারে নি। যা মনুষ্য সৃজিত কর্মবস্তু তার অবশ্যই সমালোচনা রয়েছে। সমালোচনার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এক ধর্মগ্রন্থের বিষয়ে অন্য ধর্মগ্রন্থের অনুসারীরা সমালোচনা করে থাকে। তাই দেখা গেলো, বিদ্রোহী’র যেমন অসংখ্য গুণগ্রাহী শংসাকারী জুটেছে তেমনি এর সমালোচক বা নিন্দুকের সংখ্যাও কম জোটেনি। বিদ্রোহী সম্পর্কে প্রথম অভিযোগ তুলেছেন মোহিতলাল মজুমদার, তিনি বলতে চেয়েছেন নজরুল তার ‘আমি’ শীর্ষক কথিকার ভাব নিয়ে বিদ্রোহী কবিতা লিখেছেন কিন্তু কোথাও ঋণস্বীকার করেন নি। মোহিতলালের ‘আমি’ কথিকায় আমি’র বিভিন্ন বিশ্লেষণ থাকলেও এটি যে বিদ্রোহীর ‘আমি’র প্রবল আত্মপ্রকাশের অভিজ্ঞা-নন্দনের অনুরূপ ছিল না, তা পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হতো না যদি দুটো লেখা এখানে পুরোপুরি তুলে দেয়া যেতো কিন্তু এ রচনার ভিন্ন অভিপ্রায় সন্ধানার্থে তা পত্রস্থ করার মতো স্থান পাবো না। তারপর সজনীকান্ত ও তার বন্ধু-সহগামী’রা বিদ্রোহী নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা লিখেছেন, অনেক মুসলিম লেখক হিন্দুয়ানি শব্দের-মিথের আধিক্যের কারণে এটির তীব্র নিন্দা করেছেন, কেউ কেউ বর্জনও করেছেন। কিন্তু বিদ্রোহী’র প্রভাব ও জনপ্রিয়তা এতে কিঞ্চিৎও ভাটা পড়েনি। বিশেষত তরুণ ছাত্রসমাজের কন্ঠে তখন বেজে চলত নব-বিদ্রোহের বাণী ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির!’ অনেক তরুণ সেসময় বিদ্রোহী’র ভাষায় উত্তর দিত, কথা সাজাতো, তরুণ ও যুব সমাজের পাশাপাশি সেসময় প্রাজ্ঞ-স্বারস্বত সমাজের অনেক কবি-সাহিত্যিক বিদ্রোহীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল, তাদের অনেকেই বিদ্রোহী সম্পর্কে লিখেছেন, প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে এযাবৎ অসংখ্য রচনা প্রকাশিত হয়েছে এবং আজও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি নজরুল ইন্সটিটিউট বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে লেখা তেইশটি রচনা নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ করেছেÑ ‘নজরুলের বিদ্রোহী’ শিরোনামে। উল্লেখ্য গ্রন্থটি থেকে বিদ্রোহী কবিতার নন্দন-প্রকরণ, সমালোচনা ও সৃষ্টিকাঠামো নিয়ে অনেক মূল্যবান তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। বিদ্রোহী সম্পর্কীত অসংখ্য পাঠ প্রতিক্রিয়ার মধ্য থেকে কেবল বুদ্ধদেব বসুর ভাষ্যটুকু তুলে ধরছি : ‘‘বিদ্রোহী পড়লুম ছাপার অক্ষরে মাসিকপত্রে, মনে হলো এমন কখনো পড়িনি। অসহযোগের অগ্নিদীক্ষার পরে সমস্ত মন-প্রাণ যা কামনা করছিলো, এ যেন তা-ই; দেশব্যাপী উদ্দীপনার এই যেন বাণী।” [কালের পুতুল : বুদ্ধদেব বসু]
বিদ্রোহী কবিতা প্রথমদিকে আত্ম-প্রকাশের বিচিত্র ক্রীড়ায়, উন্মাদনায় উত্তাল; মাঝে বস্তুগত ও রোমেন্টিক এবং শেষ পর্যায়ে নিপীড়িতের উপর জুলুম-পীড়নের বিষয়ে প্রতিবাদী, অধীনতার বিরুদ্ধে শক্তিমত্ত আর খেয়ালী বিধির খামখেয়ালীর বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে চির-বিদ্রোহী বীরের সমুন্নতি প্রকাশে পরিতৃপ্ত। কাজী আবদুল ওদুদ রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ ও ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতার সঙ্গে বিদ্রোহী কবিতার তুলনা করে বিদ্রোহী’তে চেতনার গৌরবোজ্জ্বল আবির্ভাবের কথা বলেছেন। ‘এবার ফিরাও মোরে’Ñ কবিতায় এক কবি-ভাবুকের চিত্র দেখা যায়, যে মাঠে-ঘাটে-নিসর্গে শান্তি খুঁজে পেলেও মানুষের দুঃখ দেখেও সে আবার ব্যথা বোধ করে। সমাজ-সংসারের নানা অসংঙ্গতি তাকে নাড়া দেয় এবং পরিশেষে মানবপ্রেমেÑ ‘জীবনের সর্বপ্রেম তৃষা’-নিবারণের উপলব্ধি ও প্রত্যয়ে কবিতা সমাপ্ত হয়। ‘এবার ফিরাও মোরে’ শিল্পী ও কবিদের ভাবগত ও বস্তুগত দ্বন্দ্বের একটি সারৎসার। ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’Ñ অপরিমেয় পিপাসীর গান। স্বপ্ন ও কল্পনাকে এখানে বিপুল সম্ভাবনাময় করা হয়েছে। এর প্রাণপ্রবাহ সাগর-শিখর-নির্ঝরের সীমানা ছাড়িয়ে। অবাক ব্যাপার হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ এবং নজরুলের ‘বিদ্রোহী’Ñ একই বয়সে লেখা। দুটো রচনার সময়ে লেখকদ্বয়ের বয়স একই ছিল। দুটো কবিতার তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মন্তব্য হচ্ছে, “প্রকাশক্ষমতাকে যদি কবিত্বের প্রাথমিক শর্ত বলে মানতে হয় তবে বিদ্রোহীকে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের তুলনায় অপেক্ষাকৃত শিল্পসফল না বলে উপায় থাকে নাÑ ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে’র অসামান্য তীব্রতা, সংহতি এবং পরিপূর্ণতার কথা স্মরণে রেখেও। বৈচিত্রে, বর্ণাঢ্যতা, আত্মবীক্ষণের বিস্মিত বৈভব, ক্যানভাসের বিশালতা, সাংগীতিক বহুমাত্রিকতা, চিত্রকল্পের সাফল্য, স্ববিরোধিতার সুন্দর সামঞ্জস্য, বলীয়ান জীবনাগ্রহÑ এসব নিয়ে ‘বিদ্রোহী’ বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে অনতিক্রান্ত।”
যে কবিতাটির সাথে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অধিক মিল রয়েছে বলে গবেষকদের মত সেটি ডধষঃ ডযরঃসধহÑ এর লেখা কবিতা ঝড়হম ড়ভ গুংষবভ. সৈয়দ আলী আহসান ডযরঃসধহÑ এর ‘ও ধস ংধঃরংভধরবফ, ও ংবব, ফধহপব, ষধঁময, ংরহম’ পঙ্ক্তির সাথে নজরুলেরÑ ‘আমি নৃত্য পাগল ছন্দ/ আমি আপনার তালে নেচে যাই/ আমি মুক্ত জীবনানন্দ’ এর সাদৃশ্য দেখিয়েছেন। নজরুল ডযরঃসধহÑ পড়েছেন, তাঁর কবিতার ইন্ধন বিদ্রোহীতে থাকতেও পারে যেমন ঝড়হম ড়ভ গুংষবভÑ এর মধ্যেও বাইবেলের প্রভাব রয়েছে। কোন বিষয়বস্তু বা ভাবের আত্তীকরণের মাধ্যমে নতুন ভাব সৃষ্টি হতে পারে আর সেটি যদি নতুন ভাষাভঙ্গিতে পরিবেশিত হয় সেটা নেতিবাচক নয়। প্রায় সকল মহৎ শিল্পকর্ম বা সাহিত্যকর্মের মধ্যেই পুরনো চিন্তার প্রভাব কিংবা আত্তীকরণের অভিব্যক্তি অন্ত:ধ্বনিরূপে অনুরণিত হয়ে থাকে। দুটো কবিতার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে সৌমিত্র শেখর-এর বিশ্লেষণটুকু তুলে ধরছি, “ডযরঃসধহÑএর ‘ও’ যেখানে পৃথিবীর সব কিছুকে ‘আমি’র মধ্যে নিয়ে এসেছে অর্থাৎ সব কিছুকে ‘আমি’র কেন্দ্রে টেনে আনে, নজরুলের ‘আমি’ সেখানে কেন্দ্র থেকে চতুর্দিকে বিচ্ছুরিত হয় এবং সর্বময় ছড়িয়ে পড়ে।” অর্থাৎ দুই কবির ‘আমি’ সম্পূর্ণ বিপরীত।
ভিক্টোরিয়ান যুগের গীতিকবি সুইনবার্ণ- এর নাটকীয় স্বগোতক্তিতে লেখা বিখ্যাত কবিতা ঐবৎঃযধÑ এর সাথেও বিদ্রোহী কবিতার তুলনা করা হয়েছে। ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায় ‘অগ্নিবীণা সম্বন্ধে অভিমত’ শীর্ষক আলোচনায় বলা হয়: “মোসলেম ভারত’-পত্রে প্রকাশিত কবি নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী অতি উচ্চ শ্রেণীর কবিতা । কবিতাটি পড়িতে পড়িতে পাঠকের বুক ফুলিয়া উঠে মাথা উঁচু হয়। শেষের দিকের কিয়দংশ পড়িতে পড়িতে সুইনবার্ণ রচিত ঐবৎঃযধ মনে পড়ে। কিন্তু ‘হার্থা’ অপেক্ষা বিদ্রোহী অনেক উচ্চে।”
মার্কিন ফোকলোরবিদ ও সাহিত্য-সমালোচক প্রফেসর হেনরি গ্লাসি তাঁর বিবেচনায় দুটো কবিতাকে শ্রেষ্ঠতম বলে প্রকাশ করেছেন একটি ড.ই. ুবধঃং এর ঞযব ঝবপড়হফ ঈড়সরহম এবং অন্যটি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’। ১৯২০ সালে প্রকাশিত কবিতাটিতে প্রচুর ঈযৎরংঃরধহ রসধমবৎু ব্যবহৃত হয়েছে। কবি ইয়েটস শঙ্কিত-উদ্বিগ্ন ভাষায় দি¦তীয়াগমনের জন্য অপেক্ষা করছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী চরম ক্ষয়িঞ্চু বাস্তবতায় বসে। ঈযধড়ং ঊৎধÑতে খৃষ্টের আগমন যেমন শান্তি হয়ে এসেছিল, তিনি এ কবিতায় এমন কোনও শুভাগমনের জন্যই অপেক্ষমান।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা ছাড়াও ১৯২২ সালে বিশ্বসাহিত্য আরও দুটো অসাধারণ সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয়েছে একটি টি. এস. এলিয়েট-এর ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যাণ্ড’, অপরটি জেমস জয়েস এর ‘ইউলিসিস’।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিধ্বস্ত ইউরোপে আধুনিকতার নামে যে স্খলন ও অবক্ষয় নেমেছিল ‘ওয়েস্ট ল্যাণ্ড’ তারই এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি। সে সময়ে বোধ ও চৈতন্যের সংকট থেকে উত্তরণ কামনায় এলিয়েট এই দীর্ঘ কবিতা রচনা করেন। ডধংঃব ষধহফÑ আরম্ভ হয় দুর্দান্ত স্বাগতভাষ্যের মধ্য দিয়ে, যা আধুনিক কবিতায় বহুল চর্চিত ও প্রশংসিত :
দঅঢ়ৎরষ রং ঃযব পৎঁবষষবংঃ সড়হঃয, নৎববফরহম
খরষধপং ড়ঁঃ ড়ভ ঃযব ফবধফ ষধহফ, সরীরহম
গবসড়ৎু ধহফ ফবংরৎব, ংঃরৎৎরহম
উঁষষ ৎড়ড়ঃং রিঃয ঝঢ়ৎরহম ৎধরহ.’
ইউলিসিস আধুনিক কথাসাহিত্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। জেমস জয়েস এ উপন্যাসে ঝঃৎবধস-ড়ভ-পড়হংপরড়ঁংহবংংÑ এর একাধিক টেকনিক নিপুণভাবে প্রয়োগ করেছেন। এই প্রবণতার মধ্যে ঘটনা ও কালের বাস্তব ধারাবাহিকতা ও পারম্পর্য রক্ষিত হয় না, যৌক্তিকতা বা অযৌক্তিকতার বিষয় এখানে মুখ্য নয় বরং চেতনার অন্তঃশীল প্রবাহে ঠিক যেমনটি ধরা পড়ে সেটিই গতিশীলভাবে ফুটে উঠে। বিদ্রোহী কবিতার মধ্যে কয়েকটি জায়গায় আমরা ঝঃৎবধস-ড়ভ-পড়হংপরড়ঁংহবংংÑ এর দারুণ প্রকাশ লক্ষ্য করি। এখানে সামান্য পাঠ তুলে ধরছি:
‘আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল
আমি উজ্জ্বলÑ আমি প্রোজ্জ্বল
আমি উচ্ছল জল-ছলÑছল, চল-উর্মির হিন্দোল-দোল্।’
নজরুলের উপর প্রভাব রয়েছে মনসুর হাল্লাজ এর ‘আনাল হক’ উপলব্ধির, সুুফিদের ‘হামাউস্ত’ তথা সর্বেশ^রবাদের। তিনি পছন্দ করতেন পারস্যের কবি রুমি, হাফিজ, খৈয়াম-এর কাব্যিক বিভোরতা; বিদ্রোহীর ক্ষ্যাপা-ভাবনার মধ্যে এই কবিদের বিদীর্ণ বাকপ্রবাহও টের পাওয়া যায়।
বিদ্রোহী কবিতার ক্ষেত্রে কিছু পাঠান্তর ঘটেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আমি চিনেছি আমারে আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!’ এরপর পাঁচটি পঙ্ক্তি। এই পঙক্তিগুলো ‘অগ্নি-বীণা’ দ্বিতীয় সংস্করণেও ছিল কিন্তু ‘সঞ্চিতা’Ñ সংকলনে এসে বাদ পড়ে যদিও পঙ্ক্তিগুলো বিদ্রোহী কবিতার গতি ও ধারাবাহিকতার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে বোধ হয় নি। প্রসঙ্গ বিবেচনায় বাদ পড়া পঙ্ক্তিগুলো এখানে উপস্থাপন করছি :
‘আমি উত্তাল, আমি তুঙ্গ, ভয়াল, মহাকাল
আমি বিবসন, আজ ধরাতল নভঃ ছেয়েছে আমারি জটাজাল!
আমি ধন্য! আমি ধন্য!
আমি মুক্ত, আমি সত্য, আমি বীর-বিদ্রোহী সৈন্য
আমি ধন্য! আমি ধন্য!
প্রতিটি মহৎ শিল্পকর্মের একটির সাথে অন্যটির কোনও না কোনভাবে সাদৃশ্য পাওয়া যায়, বস্তুগত অন্বেষণে সেটি না ঘটলেও অন্তত শিল্পসিদ্ধির নৈপুণ্যের দিক থেকে একটি অন্যটির নিকটবর্তী। সেভাবে বিদ্রোহী স্বতন্ত্র ও অভিনব হয়েও অপরাপর মহৎ সাহিত্যের সাথে যেমন তুলনীয় তেমনি নন্দন ও চেতনাপ্রবাহের দিকে সহগামী। বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে দীর্ঘ পর্যালোচনা-পরিবীক্ষণের পর বিশিষ্ট লেখক ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায় যে অভিমত প্রকাশ করেছেন তার কিছু অংশ তুলে ধরছি : ‘বিদ্রোহীর কথক ব্যক্তিমানুষটিও শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি মানুষ নয়Ñ বিশ্বমানবের প্রতিভূ। বিদ্রোহী কবিতা হয়ে উঠেছে লেখক নির্দেশিত সমস্ত অসংগতি, স্ববিরোধ ও ঘোষণার একটি আশ্চর্য, দৈব, অপ্রতিরোধ্য, ব্যাখ্যাতীত আবেগজটিল কেলাসনে। বিদ্রোহী শুধু আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সম্পদ নয়, বিংশ শতাব্দীর সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতার অন্যতম।’
(দুই)
আমিত্বের জাগরণের পাশাপাশি বিদ্রোহী কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে মানববোধ, এর মর্মে রয়েছে বিশ্ববীক্ষা, চরম নির্ঘোষে উচ্চারিত হয়েছে মানবমুক্তির বার্তা। বিশ্ববীক্ষা, সমষ্টি বোধ, সৌন্দর্য চেতনা ও মানবমন্ত্র ধ্বনিত হয়েছে এমন কিছু পঙ্ক্তি তুলে ধরছি :
ক) বল বীর/ বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
খ) আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর
গ) মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য।
ঘ) আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস হা-হুতাশ আমি হুতাশীর/ আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের/ আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষজ্বালা, প্রিয়-লাঞ্চিত বুকে গতি ফের।
ঙ) আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।
চ) আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব-সৃষ্টির মহানন্দে।
ছ) যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না/ বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত!
জ) আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!
উল্লিখিত পঙ্ক্তিগুলোতে কবির বিশ্ববোধ প্রকাশিত হয়েছে। চরম আত্মজাগরণের ফলে কবি নিজের পরিচয় তথা মানুষের সর্বোচ্চ অবস্থান এবং সেখানে যে সব মানুষের সমান ও সমুন্নত-মার্গ রয়েছে সে সম্পর্কে সচেতনতা লাভ করেছেন। আর কোন অপশক্তি মানুষের অধিকার খর্ব করতে পারবে না। তাই সব উৎপীড়কের অবসানের আগ পর্যন্ত এই সংগ্রাম চলছে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই চির-বিদ্রোহী শান্ত হবেন। কারো দ্বিমত নেই যে, ইংরেজ শাসনের অধীন ভারতের নিপীড়িত মানুষের অন্তর্জাত বিপ্লবের ফল ‘বিদ্রোহী’। আত্মজাগরণের আদি সূত্র-সন্ধানের অবকাশ থাকলেও এখানে বীর-ব্যক্তিত্বের যে চরম ক্ষীপ্ততা প্রকাশিত হয়েছে আপাত দৃষ্টিতে একে নৈরাজ্যমূলক মনে হলেও প্রকৃতপ্রস্তাবে তা অধীনতা থেকে মুক্তির উদ্দীপনা-মন্ত্র। এটি যেমন অধীন ভারতের সে সময়ের কাক্সিক্ষত অভিব্যক্তি তেমনি সর্বকালের নিপীড়িত মানুষের সপক্ষে উদ্দীপনার এক অনন্য দিকদর্শন। এ কবিতায় সকল প্রকার বিভেদের উর্ধ্বে থেকে মানুষের সুউচ্চ অবস্থান নির্দেশ করা হয়েছে। কবিতার ‘আমি’Ñ সর্বমানবের প্রতিনিধি, তার অবস্থানের উচ্চতা মানুষের পরিবর্তনের আশাবাদকে জাগিয়ে রেখেছে। এখানে কবির বিশ্ববীক্ষা ও মনুষ্যবোধ মানবতাবাদের স্বপক্ষে শক্তি সঞ্চারি দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
মানুষের মধ্যে চিন্তা ও সক্ষমতা এই দ্বৈত-শক্তির অবস্থান রয়েছে। এই শক্তি সম্পর্কে যাদের অবহিতি রয়েছে তাদের কোনও মার নেই, তাদের কোনও বাধা আটকাতে পারে না। কবি ‘আমি চিনেছি আমারে’ বলে যে আত্ম-অবহিতির কথা বলেছেন তা যেমন দর্শনগতভাবে মানুষের প্রতিষ্ঠার পথদর্শন তেমনি তার বস্তুগত অর্জন, অধিকার সচেতনতা এবং অগ্রগামীতারও নিয়ামক। এই আত্মসজ্ঞানতাই মানুষের আত্মিক ও পরিসম্পদগত আকাক্সক্ষা পূরণের অন্যতম দর্শন।
বিদ্রোহী কবিতা ষান্মাত্রিক ছন্দে রচিত হলেও চরণের শুরুতে অতিরিক্ত পর্ব এবং চরণের শেষে খণ্ড পর্ব লক্ষণীয়। উপমা-উৎপ্রেক্ষা প্রতীকের যথার্থ প্রয়োগে এতে যে প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে বাংলা কবিতায় বীর রসের এমন ‘ঝড়ের মতন করতালি’Ñ দেয়া বাক্প্রবাহ আর চোখে পড়ে না। বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ, মত, মিথ, কৃষ্টি, পুরাণ ও ইতিহাস ঐতিহ্যগত অনুষঙ্গের যে অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছে এখানে তা সর্বমানবের প্রতি, তাদের সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন যা কবির বিশ্ববোধের আত্মিক শক্তিকে স্পষ্ট করে তোলে।
‘বিদ্রোহী’Ñ কবিতা একবারই লেখা হয়েছে, কাজী নজরুলের দ্বারাও এর সমুতুল্য কোনও কবিতা আর রচিত হয়নি। এটি নজরুলের কবিতাসমগ্রের যেমন শ্রেষ্ঠতম এবং অনিবার্য পাঠ তেমনি বাংলা কবিতা ভাণ্ডারেরও এক অতুল্য ঐশ্বর্য। মহৎ কবিতা সম্পর্কে ইংরেজ কবি পার্সি বিসি শেলি তাঁর ‘কবিতার পক্ষে’Ñ রচনায় বলেছেনÑ ‘একটি মহৎ কবিতা এক বিরহপ্রবাহমান ঝরণার উৎসধারা যেন, জ্ঞান ও আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে চলে, যুগের পর যুগে এক একজন মহৎ কবি ও তার সঙ্গীরা এর উৎসারিত সৌন্দযের্র ব্যাখ্যা ও সমালোচনা করে চলেন; নবতর সম্পর্কধারীরা অধরা, অদৃশ্যপূর্ব, অশ্রুতপূর্ব আনন্দের খোঁজেÑ অনুসন্ধান করে চলে।’
বিদ্রোহী কবিতা নজরুলের এমনই এক অসাধারণ সৃষ্টি যার সৌন্দর্য ও সুলুক-সন্ধান আজও অব্যাহত রয়েছে; এখানে এমন তত্ত্ব ও শিল্পসুধা রয়েছে যা আজও উদ্ভাবিত হয়নি, অনাগতকালের কোন শিল্পরসিক হয়ত সেই শিল্পরসের সন্ধান আমাদের দেবেন। এ বছর (২০২২সাল) সাড়ম্বরে কবিতাটির শতবর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হলেও এর বিভিন্ন টার্মস, দৃশ্যকল্প ও অনুষঙ্গ নিয়ে কিংবা এর আঙ্গিকগত অভিনবত্ব নিয়ে গবেষণা হতে পারে। বিশদ গবেষণা হতে পারে বিদ্রোহীর ভাষা, বহুমুখী বৈপরীত্য নিয়েও। আগামীতে আমরা হয়ত তা দেখবো। এ কবিতা অনুদিত হলেও তা কতটা যথার্থরূপে হয়েছে সে প্রশ্ন থেকে যায় কিংবা যেসব অনুবাদ হয়েছে তা বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনে প্রকাশ ও প্রচারে আমরা কতটা ভূমিকা রেখেছি তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। চাই, বিদ্রোহী যে কাব্যিক-আবহ নিয়�