নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতীয় সংসদ ভবনে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করতে গিয়ে শেখ হাসিনা এক ‘ফিনিক্স পাখির গল্প কথা শোনালেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৃহস্পতিবার বিকালে জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ সালের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপনের শুরতেই এ গল্প শোনান অর্থমন্ত্রী। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হয়।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ১৯৪৭ সাল। সময়টা তখন শরৎকাল। রূপময় বাংলার প্রকৃতিতে আদিগন্ত সবুজের সমারোহ। শিউলি ঝরা সকাল, ভোরের দূর্বাঘাসে মুক্তদানা শিশির, নদীতীরে বনের প্রান্তে কাশফুলের সাদা কালো কেশের দোলা, আকাশের নরম নীল ছুয়ে ভাসা শুভ্র মেঘের দল, নৌকার পালে বিলাসী হাওয়া। ভেসে বেড়ানো মেঘের প্রান্ত ছুঁয়ে উড়ে চলা পাখ-পাখালির ঝাঁক। বাঁশবনে ডাহুকের ডাকাডাকি, বিল্ডিং এর ডুবোডুবো জলে জড়িয়ে থাকা শালুক পাতা, আঁধারে বুক চিরে জোনাকি রুপালি সেলাই, ঘোরলাগা চাঁদের আলো-সব মিলিয়ে প্রকৃতিতে এক অনিন্দ্য সৌন্দর্যের আরম্ভ। অপরদিকে বাংলার রাজনীতিতে তখন ভারতবর্ষের সদ্য অনাকাঙ্খিত বিভক্তির টানাপোড়েন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন ছাত্রনেতা। কলকাতায় দেশ ভাগের সূত্র ধরে ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রশমনে ব্যস্ত। পাশাপাশি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন কলকাতার পাঠ চুকিয়ে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসার। ঠিক এমনই একটি ক্ষণে ২৮ সেপ্টম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন তাদের প্রথম সন্তান শেখ হাসিনা। ছোটবেলায় সবার প্রিয় হাসু নামেই পরিচিত ছিলেন।
মুস্তফা কামাল বলেন, শেখ হাসিনার শৈশব কেটেছে মধুমতির শাখা বাইগার নদী বিধৌত গ্রামের গৃহস্থ পরিবারে। তিনি টুঙ্গিপাড়ায় বাল্য শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে পরিবার ঢাকায় চলে আসে। শেখ হাসিনা প্রথমে লক্ষ্মীবাজারে নারী শিক্ষা মন্দিরে পড়ালেখা করলেও পরবর্তী সময়ে আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৬৭ সালের গভর্ণমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন এবং ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হতে ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি এই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরের বছর সভাপতি ছিলেন। শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের একজন সদস্য এবং ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বন্দি তখন রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও নীতি নির্ধারণী বিষয়ের পাশাপাশি শেখ হাসিনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা পালন করেন। ওই সময় সংগঠিত আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে বাবা পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি, দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধে এবং মা ও ছোট ভাই রাসেল ও বোন রেহানা তারই মত একটি বাড়িতে অন্তরীণ। অন্তরীণ অবস্থায় ১৯৭১ সালের মে মাসে জন্ম হয় ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি হয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন শুরু করেন। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীরা ৭৫’র ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় শেখ হাসিনা দুই সন্তান ও ছোট বোন শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগ ধুকে ধুকে টিকে থাকে। দলকে পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে ফেব্রুয়ারি ১৯৮১-এর কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি দেশের মাটিতে পা রাখেন। সেদিন ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে জনসমুদ্রের মঞ্চে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদলেন শেখ হাসিনা। সেইসঙ্গে জনসমুদ্র হু হু করে কেঁদে উঠেছিলো।
অর্থমন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনার তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০-এর ডিসেম্বরের স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটে। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯৬-২০০১ এই সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার উন্নত হয় ৬.২ শতাংশে। মূল্যস্ফীতির হার নেমে আসে ১.৫৯ শতাংশে। তিনি এই সময়ের মধ্যে যমুনা নদীর উপর ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতু যানচলাচলের জন্য উন্মুক্ত করেন। ৪ জুলাই ২০০১ মাওয়ায় পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু ২০০১ সালে উন্নয়নের ধারা আবার বাধাগ্রস্ত হয়।
তিনি বলেন, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুরহমানকে সপরিবারে হত্যা করেও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ক্ষান্ত হয়নি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এ্যভিনিউয়ে শেখ হাসিনাকে মারার জন্য গ্রেনেড হামালা চালানো হয়। ১৯৮৮ সালের ৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে, একই বছরের ১৫ আগস্ট ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট ফ্রিডম পার্টির কর্মীরা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বাসভবনে গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডি গ্রীন রোডে ভোটকেন্দ্রে পরিদর্শনকালে গুলিবর্ষণ, ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পাবনার ঈশ্বরদীতে ট্রেনে গুলিবর্ষণ, ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর রাসেল স্কয়ারে জনসভায় বোমা হামলা, ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় গুলিবর্ষণ, ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় জনসভার কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা, ২০০১ সালের ২৯ মে খুলনা রুপসা সেতু এলাকায় শক্তিশালী বোমা পুঁতে রাখা, ২০০২ সালের ৭ মার্চ নওগাঁ বিএমসি সরকারি মহিলা কলেজের সামনে গাড়িতে হামলাসহ তাকে প্রায় ২০ বার হত্যার চেষ্টা চালায়।
তিনি আরও বলেন, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভের পর টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকারে রয়েছে দলটি। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় অর্ধশতাধিক পদক ও ডিগ্রিতে ভূষিত হয়েছেন। বিশ্বের প্রভাবশালী ৫০ নারীর তালিকায় অন্যতম অবস্থানে রয়েছেন তিনি। তার নেতৃত্বে অর্থনৈতিক বিকাশ অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বিশ্বের প্রথম অর্থনৈতিক দেশ হবে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা এক ফিনিক্স পাখি। বাবা মা ভাই শহর আপনার থেকে হারিয়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসে তিনি তার জীবনকে উৎসর্গ করেছেন বাংলার মানুষের কল্যাণে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়-'আলোর নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছেন আকাশ পানে চেয়ে'।