বাজেট :প্রয়োজনের দিকেই যথাসম্ভব চোখ ফেরানো দরকার
Published : Sunday, 12 June, 2022 at 12:00 AM
মামুন রশীদ ।।
আর্থিক
দুর্দিন, শব্দটি গত কয়েক বছরে ঘুরেফিরে এসেছে। অতিমারী করোনাকালে যেমন,
তেমনি এই সংকট কাটিয়ে ওঠার পরও শব্দটিকে ঝেড়ে ফেলা যায়নি। আর্থিক দুর্দিন
যেন দীর্ঘমেয়াদি না হয়, তা যেন চেপে বসতে না পারে সেদিকেই সদাসতর্ক দৃষ্টি
অর্থনীতির। কিন্তু বিশ্ব তাকে খুব বেশি এড়াতে পারেনি। বরং কোথাও কোথাও তা
ভয়ঙ্করভাবে জেঁকে বসেছে। আর সেই তালিকাকে এখন আরও দীর্ঘ করে তুলছে
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। সর্বশেষ সার্ক পরিবারের সদস্য শ্রীলংকার দুর্গতি
অন্যদের দুরবস্থাকেও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এখানে এসব নিয়ে তর্ক
বেশিদূর না এগিয়ে, বরং আমাদের হিসাবের খাতায় চোখ রাখা যেতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে, আমাদের খাদ্যমূল্য এবং অন্যান্য দ্রব্যমূল্য অত্যন্ত
বেড়েছে। হিসাব মেলাতে হিমশিম খাওয়ার দশা প্রায় প্রতিটি মধ্যবিত্তের।
চিন্তায় জর্জরিত মানুষের জন্য স্বস্তির খবর নেই, উদ্দীপনার খবর নেই।
ব্যক্তিমনের এমন অস্থির সময়ে, নির্ধারিত সময়ে, নিয়ম মেনে জাতীয় সংসদে
উত্থাপিত হয়েছে আমাদের ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট।
এবারের
(২০২২-২৩ অর্থবছরে) প্রস্তাবিত বাজেট ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার। আমাদের
আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় বরাবরের মতোই এবারও ঘাটতি বাজেট। একটি সংসারের
যেমন আয়-ব্যয়ের হিসাব থাকে, ছোট পরিসরে। তেমনি সরকারেরও হিসাব থাকে, হিসাব
করতে হয়। তবে সাধারণের হিসাবের সঙ্গে সরকারের হিসাবের পার্থক্য আকাশ-পাতাল
বললেও কম বলা হয়। সরকারের বাজেটে প্রস্তাব করা টাকা কোথায় কীভাবে খরচ হবে
তা যেমন বাজেট ঘোষণায় বলা থাকে, তেমনি এই টাকার জোগান কোথা থেকে কতটা আসবে
তাও বলা আছে। ঘাটতি মেটাতে ঋণ নেওয়ার কথাও বলা থাকে। বাজেট নিয়ে সাধারণের
মতো আমারও আগ্রহ এটুকুই। সাধারণের দৃষ্টি থাকে বাজেটের পর কোন জিনিসের দাম
বাড়বে আর কোনটার দম কমবে সেদিকে? এর বাইরে ঘুরে আসার সাধ্য আমাদের নেই।
সাধারণত সে প্রয়োজনও হয় না। কারণ আমাদের দৌড় নির্ধারিত জায়গা পর্যন্তই
সীমাবদ্ধ।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা বাজেট ঘোষণার পর বাজেটের নানা দিক
নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। বাজেটের ভালো-মন্দ দিক নিয়েও কথা বলেন। তাদের
সেই আলোচনা এবং সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, প্রস্তাবিত বাজেটে ‘শিক্ষা ও
প্রযুক্তি’ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৪.৭ শতাংশ। এ খাতে গত অর্থবছরে বরাদ্দ
ছিল ১৫.৭ শতাংশ। খোলা চোখে দেখা যাচ্ছে এ খাতে বরাদ্দ কমানোর প্রস্তাব করা
হয়েছে। একইভাবে আরও একটি খাতে বরাদ্দও নজর কেড়েছে। সে হলো স্বাস্থ্য খাত।
এবারের স্বাস্থ্য খাতে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা
হয়েছে। বিগত অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। তার মানে এ
খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গত দুবছর অতিমারী করোনা পৃথিবীকে
যে ধাক্কা দিয়েছে, তাতে স্বাস্থ্য খাতকে আলাদা নজরে দেখার প্রয়োজনীয়তার
কথা জোরেশোরেই আলোচিত। আমরা খালি চোখে এ খাতে এবার বরাদ্দ বেশি দেখলেও
বিশ্লেষকরা বলছে, অতিরিক্ত টাকা জোগানের কথা বলা হলেও এ খাতের পরিধি
বাড়েনি। তার কারণ? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের সামগ্রিক বাজাটের পরিধি যেখানে
গত বছরের তুলনায় ১৪ দশমিক ২৪ শতাংশ বেড়েছে, সেখানে স্বাস্থ্য খাতে বেড়েছে
১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। তার মানে করোনা যতটা হইচই ফেলেছিল, নাড়িয়ে দিয়েছিল
বিশ্বকে, বিশ্বের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল
সীমাবদ্ধতা ও সংকট। তা থেকে আমরা খুব বেশি শিক্ষা নিতে পারিনি। এ খাতকে সেই
নাড়িয়ে দেওয়া সময়ের বিচারে খুব বেশি গুরুত্ব দেইনি। দেইনি বাড়তি নজরও।
এই
দুটো দিকের বাইরে আমাদের মধ্যবিত্তের নজর থাকে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার দিকে।
নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার কারণেই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ
সঞ্চয়পত্রে। প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে বিনিয়োগকারীদের মুনাফাকে কয়েকটি ভাগে
ফেলা হয়েছে। পনেরো লাখ টাকার নিচে যারা বিনিয়োগ করবেন, তাদের মুনাফা
অপরিবর্তিত রাখা হলেও, এর ঊর্ধ্বে বিনিয়োগকারীদের মুনাফা কমবে।
সাধারণ
মানুষ জটিল তত্ত্ব-তথ্য দিয়ে বাজেট বিশ্লেষণ করেন না। তারা দেখেন নিজেদের
সুখ, সুযোগ-সুবিধা। তারা দেখেন তাদের জীবনযাত্রায় যেন প্রভাব না পড়ে। তারা
চান স্বস্তি। আমাদের বাজেটের বড় বরাদ্দ চলে যায় এডিপির পেছনে। ৬ লাখ ৭৮
হাজার ৬৪ কোটি টাকার প্রস্তাবিত এ বাজেটের ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা
ব্যয় হবে উন্নয়ন বাবদ। আমরা জানি, যত বেশি অর্থ ব্যয়, উন্নয়ন ব্যয় তত বেশি
কর্মসংস্থানের সুযোগ। কিন্তু একইসঙ্গে এতে করে কমে সঞ্চয় এবং বাড়ে ঋণের
বোঝা। কারণ আমাদের আয়ের অনেকটাই খরচ হবে এ খাতে। যা মধ্যবিত্তেরও প্রধান
সমস্যা। আমাদের আকাক্সক্ষার পরিধি বাড়ার প্রভাব পড়ছে জীবনযাত্রায়। ফলে
নিজেদের আধুনিক ও অন্যের সঙ্গে তুলনীয় করে উপস্থাপনের আগ্রহ আমাদের ভুলিয়ে
দিচ্ছে দৈনন্দিন প্রয়োজন। যে কারণে সমস্যার দিকে নজর না দিয়ে আমরা ছুটতে
থাকি চাকচিক্যের পেছনে। উন্নয়ন জরুরি, কিন্তু তার চেয়েও জরুরি সেই উন্নয়নের
পেছনে যেন অপ্রয়োজনীয় খরচ না হয়। এখন ভোগের দিকে নজরকে প্রসারিত না করে
বরং প্রয়োজনের দিকেই যথাসম্ভব চোখ ফেরানো দরকার।
আজকের পৃথিবীকে শাসন
করছে শিক্ষা। এই একটি ক্ষেত্রে আমাদের যতটা উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে, অন্য
কোনো দিকেই তা সম্ভব নয়। এই একটি ক্ষেত্রে উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের যতটা
এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, তা অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়। আমাদের চিন্তা ও
উদ্ভাবনী শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার মাধ্যমে অগ্রসর
জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠায় এ রকম সুবিধা আর কোনো খাতে নেই। অথচ শিক্ষা
খাতে বরাদ্দ নিয়ে আমাদের শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের অসন্তুষ্টি কোনোবারই কমে না।
এবারও পূরণ হয়নি শিক্ষা খাতে বাজেটের কুড়ি শতাংশ বরাদ্দের দাবি।
অতিমারী
করোনা আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে আমাদের ফারাকটাকে স্পষ্ট করেছে। আমাদের
প্রাগ্রসর চিকিৎসকরা আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে গেলেও প্রযুক্তির
সুবিধা থেকে যে তারা বঞ্চিত সেদিকটিকেও তো করোনা চোখে আঙুল দিয়েই
দেখিয়েছে। চিকিৎসককে তার অর্জিত বিদ্যা প্রয়োগের যথাযথ সুযোগ যদি আমরা দিতে
চাই, তাহলে তাকে দিতে হবে আধুনিক চিকিৎসা উপকরণও। বাজেটে চিকিৎসা খাতে
গবেষণা বরাদ্দ রাখা হয়েছে গতবারের মতো এবারও একশ কোটি টাকা। গবেষণার জন্য
এই টাকা অপ্রতুল হলেও, বরাদ্দটুকুর যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত হয় কিনা, তা
আমাদের সহযোগিতা করতে সক্ষম কিনা সেদিকটিও পরীক্ষা করে দেখা দরকার। শুধু যে
বরাদ্দ বাড়িয়েই ফল মিলবে তা তো নয়, এও তো সত্যি যে, যুগোপযোগী করে চালিত
করার মধ্য দিয়েই আসে কাক্সিক্ষত ফল।
এক সময় অর্থনীতিবিদরা ভাবতেন, দেশের
ভাণ্ডারে যত বেশি টাকা-পয়সা জমবে, দেশ তত বেশি আর্থিক উন্নয়নের দিকে
এগোবে। কথাটিকে আজকের জামানাতেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ অর্থনীতি তো
বলছে, মূলধন আসে সঞ্চয় থেকে। সরকার এবারের বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ
উৎস থেকেও ২১.৬ শতাংশ ঋণ নেবে। দেশের ভা-ারে সঞ্চয় না থাকলে, ঋণ নেওয়া যেমন
কঠিন, তেমনি আর্থিক বিশৃঙ্খলতার শঙ্কাও থাকে। বড় বিনিযোগকারীদের বিনিয়োগের
ক্ষেত্র প্রসারিত, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর সে সুযোগ নেই। তাদের ভরসা
সঞ্চয়পত্রের মুনাফা। তাই সঞ্চয়ের ওপর বিনিয়োগকারীদের অনুৎসাহিত করারও
কিন্তু সুযোগ নেই।
মামুন রশীদ : কবি, সাংবাদিক