ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ ।।
২০২২-২৩
বাজেটবর্ষের প্রস্তাবিত বাজেটটি কেমন হয়েছে এ ধরনের চিন্তাভাবনার মধ্যে
সবাই এখন। এখন একই সঙ্গে সংসদে উত্থাপিত ২০২১-২২-এর সম্পূরক ওরফে সংশোধিত
বাজেটের ওপর নজর দেওয়ার ফুরসত মিলবে না, সুযোগ রাখা নেই, কারণ গত বছর
ঢাকঢোল পিটিয়ে (এবারও যা করা হচ্ছে) নতুন বাজেটে কী করতে চাওয়া হয়েছিল, তার
কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, কতটুকু কেন হয়নি এসব প্রশ্ন আনলে এবারের বাজেটে
প্রথাগত প্রতিশ্রুতি প্রত্যাশার সুর বেসুরো হয়ে উঠতে পারে বলেই।
’ঔপনিবেশিক’ প্রশাসন ও সময়ের গণবিছিন্নতার, গণদূরত্ব সৃষ্টির ধোঁয়াশে
সুযোগ একটি ’গণপ্রজাতন্ত্রী’ দেশে চলমান অব্যাহত থাকা বা রাখার জন্যই জাতীয়
বাজেট স্বার্থসন্ধ গুষ্ঠির, কোটারির, কালোবাজারির, মজুদকারী, পাচারকারীর
পোয়াবারো হলেও তাকে জনবান্ধব, ব্যবসাবন্ধব, মধ্যবিত্ত ও গরিববান্ধব বলে অতি
প্রচারের পরিবেশ সৃজিত হয়। সেখানে নির্মোহ, নিরপেক্ষ মূল্যায়নের সুর
ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
ছয়টি বিষয়কে প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে
চিহ্নিত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে (স্বউচ্চারিত বক্তৃতায় নয়, তথ্যচিত্রে),
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অত্যন্ত কৌশলী হতে হবে। কেননা কোনো একটি সমস্যা
সঠিকভাবে সমাধান করা না গেলে তা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বিনষ্ট
করতে পারে এ নির্মম সত্যের উপলব্ধি থেকেই।
চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে- (১)
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা; (২) গ্যাস,
বিদ্যুৎ ও সারের মূল্যবৃদ্ধিজনিত বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান;
(৩) বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যবহার এবং মন্ত্রণালয়ের উচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত
প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করা; (৪) শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের
প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন; (৫) অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর সংগ্রহের
পরিমাণ এবং ব্যক্তি আয়করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং (৬) টাকার বিনিময় হার
স্থিতিশীল ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা।
চ্যালেঞ্জ
মোকাবিলায় মূল কৌশল হিসেবে বিবৃত হয়েছে- (১) বিদ্যমান চাহিদার প্রবৃদ্ধি
কমিয়ে সরবরাহ বৃদ্ধি করা। (২) আমদানির্ভির ও কম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয়
বন্ধ রাখা অথবা কমানো। (৩) নিম্ন অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর
বাস্তবায়নের গতি হ্রাস (৪) উচ্চ ও মধ্যম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর
বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা। প্রথম দুটি কৌশল বাস্তবায়নের কোনো পথনকশা নেই।
সরকারি ব্যয় বন্ধ বা কম করার উপায় উপলক্ষ অনুন্নয়ন ব্যয় বহরের বিশাল বপু
দেখে ঠাওর করা যায় না।
বরং এক খাতের সনাতন ব্যয়কে মুখরোচক করার জন্য
আরেক খাতে দেখিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রবণতা বলে ক্ষীণ কণ্ঠ সমালোচকরা
বলছেন। যার বা যাদের গলার জোর বেশি তারাই তো নীতি-নৈতিকতার হতাহতের
হুকুমদার, ন্যায়-অন্যায়ের পৃষ্ঠপোষক ও ‘সর্প হয়ে দংশনকারী আর ওঝা হয়ে
ঝাড়েন।’
বাজেট তথ্যচিত্রে বলা হয়েছে, জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও
সারের বিক্রয়মূল্য পর্যায়ক্রমে ও স্বল্প আকারে সমন্বয় করা হবে। রাজস্ব আহরণ
কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে কর সংগ্রহে অটোমেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা
হবে। মূল্য সংযোজন কর ও আয়করের আওতা বাড়ানো হবে। বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয়
আমদানি নিরুৎসাহিত করা হবে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার
প্রতিযোগিতামূলক রাখা হবে। গতবার কেন, প্রায় প্রত্যেকবার এমন ধরনের
আপ্তবাক্য উচ্চারিত হয়, বাস্তবায়নোত্তর তার সাল তামামি হয় না বলেই এটা সে
পর্যায়ে থেকে যায়। জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিনিধিরা মহান সংসদে সবার
পক্ষ হয়ে পরীক্ষা পর্যালোচনা করবেন এমন একটি সংবিধিবদ্ধ প্রত্যাশায় পাঠিয়ে
দেন সবাই এটা কালের কপোলতলে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪
কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেটের আকার জিডিপির ১৫ দশমিক ২
শতাংশ। পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৪ লাখ ৩১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা এবং
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব
করা হয়েছে যা সংখ্যাগরিষ্ঠ ট্রেজারির প্রস্তাব তাদেরই কণ্ঠভোটে সুপারিশকৃত
হয়ে রাষ্ট্র্রপতির ‘অ্যাসেন্টে’র জন্য যাবে। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব
আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর
সংগৃহীত কর থেকে পাওয়া যাবে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, এনবিআরবহির্ভূত কর
থেকে আসবে ১৮ হাজার কোটি টাকা আর কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি
টাকা। ফলে মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা
জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। গত বাজেটে এ হার ছিল ৬ দশমিক ২।
বাজেটের আগে
জনমতের প্রস্তাব ছিল, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে
বরাদ্দের হার বৃদ্ধি করার, বাজেটে তা শনাক্তযোগ্য হয়নি। বাজেট প্রস্তাবক
তার নিজের ছাতার নিচে সবাইকে সমানভাবে আশ্রয় দেননি, বরং ছাতাটা তুলে
দিয়েছেন ব্যবসায়ীদের হাতে, অর্থ পাচারকারীদের হাতে। নানাভাবে তাদের কর ছাড়
দেওয়া হয়েছে, সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় পরিচালনার মূলনীতি
২০(২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে।
প্রশ্ন উঠছে সরকার দেশের
অতিদরিদ্রদের কাছে ১০ টাকা দরে মাসে যে ৩০ কেজি করে চাল বিক্রি করে আসছিল,
তার দাম কেজিতে ৫ টাকা করে বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
এ ধরনের
সহস্র প্রশ্নের মধ্যে উঠে আসছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, সার, তেল, গ্যাস,
খাদ্য ইত্যাদির ভর্তুকি, সামাজিক নিরাপত্তা, ক্ষুধার্ত, গরিব-দুঃখী,
বেওয়া-বিধবা, বেকার, ছদ্মবেকার, চাকরিচ্যুত, কর্মচ্যুতদের খাওয়ানো, এর
সঙ্গে গুরুত্বের সঙ্গে থাকছে আরেক শ্রেণির মানুষের বাঁচার প্রশ্নের কথা,
যারা চক্ষুলজ্জায় হাত পাততে পারে না, অথচ আধপেটা থাকে, চিকিৎসাহীন থাকে,
বাজারে যেতে ভয় পায়, সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এর পর রয়েছে দৃষ্টির অগোচরে পড়ে
থাকা ছোট, অতিছোট, ক্ষুদ্র ও মাঝারি এন্টারপ্রাইজের মালিকরা, যাদের কথা
কেউ বলে না। বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের কথা, বৈদেশিক মুদ্রার বাজার ও
রিজার্ভ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার কথা, ব্যাংকে সুদহারের পরিবর্তনের কথা
যা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে জড়িত ও সম্পর্কিত। ব্যাংক কমিশন গঠনের সেই বড় আশাবাদ
ও প্রতিশ্রুতি এখন আর উচ্চারিত হয় না কেন। অবশ্যই প্রশ্ন উঠছে রাজস্ব
বৃদ্ধির ওপর, যা ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা দিতে নারাজ। কারণ তাতে ব্যবসার ক্ষতি
হবে, রপ্তানির ক্ষতি হবে আবার চাকরিজীবী ও মধ্য-আয়ীদের রাজস্ব দেওয়ার
ক্ষমতা নেই, থাকলেও সীমিত। থাকবে উন্নয়ন বাজেট বা উন্নয়ন প্রকল্পের কথা- বড়
বড় মেগা প্রকল্পের কথা। এসব কি মন্থর করা হবে। করলে সিমেন্ট, ইট-বালি,
রড-স্টিলের ব্যবসার কী হবে, কী হবে ব্যাংকের অবস্থা। ইতোমধ্যে গ্যাসের দাম
বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ ও তেলের দাম বাড়বে। কারণ ভর্তুকি হ্রাস ছাড়া গতি
নেই। আরেক দফা বিদ্যুৎ, গ্যাস ও তেলের দাম বাড়লে বাজারের আগুনে ঘৃতাহুতি
দেওয়া হবে। সাধারণ মানুষের সব চিন্তা এখানেই সীমাবদ্ধ। কেউ ‘প্রবৃদ্ধির
হার’ নিয়ে এখন ভাবিত নয়। প্রবৃদ্ধি দিয়ে কী হবে, যদি পেটে ভাত না থাকে;
বিদ্যুৎ, ফ্রিজ, টেলিভিশন না চলে, গাড়ি না চলে। উপরন্তু সাধারণ মানুষ যদি
খেতে না পায়।
মূল্যস্ফীতির কবল থেকে মানুষকে বাঁচাতে সব কূল রক্ষা করে
সর্বোচ্চ অধিকার দিতে হবে গরিব, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তকে বাঁচাতে।
গরিবদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়ার আবশ্যক আকারে ও পরিমাণে। ছোট ছোট
ও অতিক্ষুদ্র গ্রামীণ উদ্যোগগুলোকে বাঁচাতে হবে। খোলাবাজারে পণ্য বিতরণ
অব্যাহত রাখতে হবে। লোকের কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। মূল্যস্ফীতির কবল থেকে
মানুষকে বাঁচাতে হলে দুটো পদক্ষেপ দরকার হবে। দরিদ্রদের জন্য, অতিদরিদ্রদের
জন্য এক ব্যবস্থা, আবার নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য আরেক ব্যবস্থা।
গরিব ও অতিদরিদ্রদের জন্য চিন্তাভাবনা হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাজেটে
অর্থবহ ও বাস্তবায়নযোগ্য কৌশল, পদ্ধতি নির্দেশনা নেই এমন কথা বলছেন ক্ষীণ
কণ্ঠরা। একশ্রেণির লোকের কথা কেউ বলে না। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা তাদের
নিজেদের কথা বলে। গরিব ও অতিদরিদ্রদের কথা অনেকেই বলেন না। কিন্তু যারা
দুঃখে আছে, কষ্টে আছে অথচ মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না, যারা টিসিবির ট্রাক
সেলে লাইন দিয়ে পণ্য তুলতে পারে না তাদের কথা কেউ বলে না। এমনকি নগর
দরিদ্রদের কথা বলার লোকও আছে। অথচ যে মধ্যবিত্তকে সবাই বলে তারাই হচ্ছে
বাজার অর্থনীতির প্রাণ। তাদের কথা কেউ বলে না। কিন্তু তারা যে দিনে দিনে
নিঃশেষ হচ্ছে তার খবর বাজেটপ্রণেতারা রাখেন বলে প্রতীয়মান হয় না। বাংলাদেশ
রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত জড়িত। তাদের আকাক্সক্ষাই
জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশকে। অথচ সেই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত হারিয়ে যদি যায়
অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে। দেশ যদি হয়ে পড়ে শুধু অধিকতর
ধনী ও ক্রমশ দরিদ্রদের, যাদের আয়ের উৎস হচ্ছে সংকুচিত। সেটি হবে বড়
বেদনাদায়ক ও বিভ্রান্তকর।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : কলাম লেখক ও উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক