জুতা মাছ এবং কপালের ভাঁজ
কাজী মোহাম্মদ আলমগীর ||
জুতা
ছিঁেড় গেলে ছোট ছেলে বলে স্কুলে যাবে না। তার মা বাবা দুজনে নরম করে বলে,
নতুন জুতা কিনে দিবে। ছেলে ছেঁড়া জুতা পায়ে স্কুলে যায়। তারপর একদিন
স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলে তার মেঝো ভাই এবং প্রতিবেশি হিসেবে আমি অবচেতনে
আরজিটুকু রেখে দেই, ‘ মা আমার জুতা লাগবে।’
মা বাবা ভুলে যায় ছেলে স্কুলে যায় না। অথবা তারাও অপেক্ষায় থাকে হাতে টাকা এলে ছেলের জন্য জুতা কিনবে। তারপর ছেলে স্কুলে যাবে।
আমরা
তখন জৈষ্ঠমাসের শেষের দিকে আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘ খুঁজি। মেঘ থাকলে
বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি হলে মাছ ধরবো। মাছ ধরে ঘরে আনবো। আরও বেশি পেলে বিক্রি
করবো। সেই টাকায় জুয়া খেলবো। আরও পেলে প্রতিবেশিকে দেব- আত্মীয়কে দেব। সারা
রাত খাল পাড়ে কাটিয়ে দিয়ে তৃতীয় রাতে ঢুলু ঢুলু চোখে ঘুমুতে গিয়ে ঘুমের
ভেতরও মাছ ধরবো। যে মাছ জালে ওঠেনি সেই মাছ স্বপ্নে ধরবো আর বার বার ঘুমের
ভেতর চমক খেয়ে পাশ ফিরে শুবো। এমন না হলে কি মাছ ধরা!
আমরা আবার আকাশের
দিকে তাকাই। আমরা জৈষ্ঠ মাসের শেষের দিকের আম জাম কাঁঠাল খেয়ে বারেন্দার এ
মাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত গড়াগড়ি খাই। আমাদের পেট ভরে। মন ভরে না। তাই আমরা
আকাশ চাই। মেঘ চাই । বৃষ্টি চাই। মাছ চাই। এভাবে চাইতে চাইতে আমরা দশ
বারো বছর আগের কোন সময়ের ভেতর ঢুকে দেখি বৃষ্টি হচ্ছে। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে।
মানুষ মাছ ধরছে। মাছ লুট হচ্ছে। লুট না হলে এ মাছের মালিক কে? নিশ্চয়
কারো পুকুর ভেসে গেছে। দিঘি ভেসে গেছে। খাডি ভেসে গেছে। জলাশয় ভেসে গেছে। এ
মাছের কোন মালিক নেই। সব লুটের মাছ। লুটের মাছে আনন্দ বেশি।
তারপর
আমরা অনেক কষ্টে পূর্ববর্তী দশ পনেরো বছরের ভেতর থেকে বের হয়ে আকাশের দিকে
আবার তাকাই। তখনো আমরা শুনতে পাই, সেই আরজঃ ‘মা আমার জুতা লাগবে’। এই আরজ
আমরা দুজনে একত্রে শুনি কিনা হলফ করে বলতে পারি না । আমি ঠিক ঠিক শুনি। তবে
শ্রবন কালের চিহ্ন হিসেবে আমার এবং আমার বন্ধুর কপালের ঠিক মাঝ বরাবর
একটা সমান্তরাল ভাঁজ ফুটে থাকে।
লম্বা বরান্দার শেষ মাথায় এসে আমি এবং
আমার বন্ধু প্রার্থনা করি,ঝাপ্পুইরা জামগাছের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘প্রভূ
বৃষ্টি দাও।’ প্রার্থনা বাক্য আমার বাবা শুনে ফেললে বাবা বলে, ‘আগামী
সপ্তায় বৃষ্টি হবে। আগামী সপ্তায় ফিরতি রথ। আগ রথে যেহেতু বৃষ্টি হয়নি, ফের
রথে বৃষ্টি হবেই।’
আষাঢ় মাসের এক সপ্তাহ চলে গেছে বৃষ্টি নেই! পৃথিবীর
খুব রাগ হয়েছে। উষ্মা প্রকাশ করছে। পৃথিবীর গাড়িগুলো রাতদিন পেদেপেদে বায়ূ
নষ্ট করে। অতি আরামে বে-আরাম আসে।
অষ্টম দিনে সত্যি বৃষ্টি নামে। বৃষ্টি
নামে ধুল্লা জমিতে ঘন বীজ রোপনের মতো। আমরা কল্পনায় নবী সোলেয়মানকে বলে
আকাশ থেকে বৃষ্টির সঙ্গে মাছ নামাই। কৈ টেংরা শিং লাটি পুটি,ভূমিতে বীজ
রাখা সেই সব মাছ। কেউ নিশ্চয় আকাশ থেকে আমাদের জন্য মাছ নিক্ষেপ করে।
উত্তেজনায় আমরা আর ঘরে থাকতে পারি না। টনি জাল নিয়ে ভাঙানীয়া খালে মাছ
ধরতে দৌড়-দৌড় লাগাই। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে পলিথিনের বস্তা কোনাকারে মাথা ও
শরীরের অর্ধেক ঢাকি। তবুও আমরা প্রায় ভিজে যাই। আমরা শিহরিত হই।
গত
কয়েক বছর খালে মাছের সংখ্যা কমে গেছে বলে আমরা নবী সোলেয়মানকে বলি, ‘মাছ
দিন।’ কিন্তু নবী সোলেয়মান কী কারণে আমাদের কথা শুনবেন। তবু আমাদের রক্ত
থেকে ‘মাছ পাবোই’ এমন প্রত্যাশা কোন ভাবে মুছতে পারি না। আর কোন দিন মাছ
ধরতে যাবো না বলেও মাছ ধরতে যাই। আমরা এমন বেহায়া।
আমরা দু বন্ধু খালে
জাল ফেলে ধর্মে নিবিষ্ট ধ্যানির মত চুপচাপ বসি। টু শব্দ করি না। এই টনি বা
টানা জালের আরেক নাম ধর্মজাল। ধ্যানও ঠিক থাকে। অনেকক্ষণ পর আমরা বৃষ্টির
ভেতর ভুল সংবেদ নিয়ে জাল আলগি দিয়ে দেখি কোন মাছ নেই।
আবার জাল ফেলি।
বৃষ্টির
শব্দে নামতা গুনি। প্রেমের নামতা। শিউলী টিউলী কিউলী। তিন নামতার মুখ। আধা
খসরা মুখ। বৃষ্টি ও বাতাসে সকল নামতা এলামেলো হয়ে যায়। জালের রশিতে জলের
শব্দ বুঝতে টান টান সজাগ থাকি। সামান্য কণা এলেও হৃদতন্ত্রী টুং করে ওঠে।
আমরা আবার ভুল সংবেদ পাই। জাল আলগি দেই। কিন্তু জাল খালি। মাছ নেই। দুটি
মাদার পাতা কয়েকটি আম পাতা আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করে। আমাদের ধ্যানের গাঢ়তা
কমিয়ে দেয়।
তিন সংখ্যা- অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাগ্য নির্ণয়ক। আমরা
তৃতীয়বার জাল ফেলি। আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেয় কেউ। গভীর দুশ্চিন্তায় মগ্ন
হই। আমাদের কপালে লম্বা সমান্তরাল ভাঁজ। চিন্তা ক্রমশ একিভূত হতে থাকে।
চূড়ান্ত অবস্থায় এলে আমরা জাল আলগি দেই। হায়! হায়! কোন মাছ নেই। শুন্য
জাল। খরকুটা ছাড়া কিছু নেই।
আমরা এবার জাল ত্যাগ করে খাল পাড়ে ওঠে এদিক
ওদিক তাকাই। খাদ্যান্বষণে বের হওয়া দুই পায়ের উপর দণ্ডায়মান নেউল আমরা।
সামনে সাপ পেলে, সাপ ধরে, বেদেদের কাছে বিক্রি করে দিব। আর কিছু না হোক
আমাদের জুয়াড় টাকা চাই। আমরা তখন আর কোন আরজ শুনি না। কেউ বলে না, ‘মা জুতা
লাগবে’।
তখন বজ্রের তীব্র ঝিলিক হলুদ বর্ণের ছায়ার ভেতর আমাদের শুষ্ক
স্নান করায়। আমাদের মনে পড়ে, বাদাম তুলতে গিয়ে কোন একজন বজ্রপাতে প্রাণ
দিয়েছে। আমরা জড়োসরো হয়ে যাই। ভয় পাই। ভয় পেলে মানুষ বোকা হয়ে যায়। কিন্তু
এই প্রথম আমরা জ্ঞানীদের মতো করে চিন্তা করতে চেষ্টা করি। আমরা লক্ষ করি,
আশপাশের সকল নিচু জমি পুকুর ডোবা দিঘীসহ সকল জলাশয় মাছের চাষের আওতায় চলে
গেছে। চাষের জন্য, লাভের নিশ্চয়তার জন্য চমৎকার ভাবে প্রতিটা মৎসাধার ঘের
দেয়া। বাঁশের বেড়া, সুক্ষ্ম লাইলনের জাল, বাঁশের খুঁটি এবং কোন কোনটি খাড়া
বাঁধ।
খালের মুখের বিশাল জলাশয় মৎস্য চাষে বন্দি। সতরাং যে কোন প্রকার মাছ আশা করাই বোকামী।
আমাদের
ধর্মজালের মাথার উপর কোত্থেকে সপ্তরঙা একটা তরতাজা মাছরাঙা এসে ঠোঁট
ঘষে, লেজ উঁচু করে নিচু করে, ফুরুৎ করে অদৃশ্য হয়ে যায়।
আমরা বিশ^াস করতে পারি না জালে মাছ ওঠবে না। এতো এতো বেড়ার ভেতর কোন না কোন ফাঁক নিশ্চয় আছে। মাছ বের হবেই। মাছ জালে ওঠবেই।
তখন আমাদের চারদিকে অর্ধবৃত্তাকার অন্ধকার নামে।
তখন
স্্েরাতের দিক থেকে খাল পাড় ধরে একটা লোক আসে। তার মুখ বাঁধা লাল সাদা
গুনিখদের গামছায়। তাকে আমরা চিনতে পারি না তবে আন্দাজ করতে পারি। নিকটে এসে
লোকটি বলে, ‘তোমাদের লগে শাবল আছে’? আমরা বলি, ‘আছে’। টনি জালের রশি থির
রাখার জন্য, বাঁশ গাঁথনের জন্য আমরা শাবল নিয়ে এসেছি। লোকটি বলে, ‘তাড়াতাড়ি
শাবল দাও’। আমরা শাবল দেই । লোকটি বলে, ‘আমার পেছেনে পেছনে আইয়ো না। আমি
তোমাদের শাবল ফেরত দিয়া যামু। দেরি হবে না’।
কিন্তু আমরা লোকটির পেছনে পেছনে যাই। দূরত্ব রেখে যাই।
লোকটি
বলে, ‘মাছ শুধু তারাই খাইবে। তারাই বেচবে। মানুষের মাছ খাওয়ার অধিকার নাই।
দাঁড়া মাছ খাওন দেখাইতাছি। জমা মিয়ার জমা দেখাইতাছি, শালা।’
লোকটি নেমে যায় জলাশয়ে। শাবল মেরে মেরে ঘেরের বাঁশ আলগা করে, তরজার বেড়ার নিচে শাবল মারে, আড়ি দেয়।
আমরা চিৎকার দিতে পারি না। কিন্তু ভেতরে চিৎকার আটকে দিতে গিয়ে হতবিহ্বল হই। মূর্ত হই। বিমূর্ত হই।
লোকটা শাবল ফেরৎ দিয়ে এক মুহূর্তে চলে যায়।
আমরা
মাছ ধরতে শুরু করি। মাছ পাওয়ার এ সংবাদ দ্রুত ছড়ায়। মাছ আর মাছ। আরো অনেকে
মাছ ধরতে আসে। সকলে অবাক হয়। এতো চাষের মাছ বের হয় কী করে!
তখন আমরা
দুটি আমি’তে ভাগ হয়ে মাছ নিয়ে বাড়ি যাই। বাড়ি থেকে ফিরে এসে আরও মাছ ধরি ।
এবার লোক দিয়ে মাছ পাঠাই বাড়িতে। আরও মাছ ধরে দুই বন্ধু বাজারে যাই ।
সন্ধ্যায় তখন বাজারে মাছ কেনার লোকও কম। তবু আমরা নিজ নিজ মাছ বিক্রি করি।
তারপর আমি এক কাপ গরম চা পানের জন্য বাজারে অহিদ মিয়ার চা দোকনে বসে থাকি।
চা এলে, চা খাই। তারপরও বসে থাকি। আমার বন্ধু মাছ বিক্রি করে ফিরে আসবে।
বন্ধুর জন্য অপেক্ষায় থাকি।
অবশেষে আমার বন্ধু ফিরে এসে বলে, ‘একটা জুতার দোকান খোলা ছিল। এমন বৃষ্টির মধ্যে কে দোকান খোলা রাখে।’
তখন আমি আরজটি আবার শুনি, ‘মা আমার জুতা লাগবে।’
সে রাতে আমরা স্বপ্নের ভেতর মাছ ধরি না। ক্লান্তিতে নিমজ্জন ঘটে আমাদের। গভীর ঘুমে ডুবে থাকি।
পরদিন
সকালে একটি দুঃসংবাদ এক সঙ্গে দুই বন্ধু শুনতে পাই। জমাদার বাড়ির জমাদার
সাহেব তার সবকিছু তদারককারি লোকটিকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। দুই বন্ধু
হাসপাতালে যাই। গিয়ে তাকে খুঁেজ বের করি। লোকটিকে বেদম মেরেছে। সারা শরীরে
ব্যান্ডেজ। চোখ বন্ধ। এই লোকটি কাল মাছ চাষের বেড়ার গোয়াড় আলগা করেছিল।
অনেকক্ষণ
সময় নিয়ে লোকটিকে দেখে পায়ে হেটে আমরা খালপাড় ধরে যখন বাড়ি ফিরি তখন দেখি
বন্ধুর ছোট ভাইটি নতুন জুতা পড়ে স্কুলে যায় আর বারবার জুতার দিকে তাকায় আর
তার ভাইয়ের দিকে তাকায়।
আমাদের দুই বন্ধুর কপালে তখন সেই লম্বা সমান্তরাল ভাঁজ।
ঝড়ের সীমারেখা
আরিফুল হাসান ||
ঝড়পূর্ব
বিজ্ঞাপনে আমরা স্লোগান হই। বিজ্ঞাপনের ভাষা বুঝি, ভাষা বুঝি না পাখির,
খাঁচার। শুধু মানুষের ভাষা বুঝলে আজকাল চলে না। হিংস্র জানোয়ারদের ভাষাও
রপ্ত করতে হয়। মেঘের ডাক, বজ্রের গর্জন কিংবা যুদ্ধের দামামাশীর্ষক
ভাষাগোষ্ঠির কাছে নিজেকে বন্দক রাখতে হয়। না হলে চলা মুশকিল। এই
শ্বাপদসংকুল পৃথিবীতে এতোবেশি অভাষা বিরাজিত যে, প্রকৃত ভাষা আজ খুঁজে
পাওয়া মুশকিল। তবু কেউ গাছের ভাষায় কথা বলে, কেউ বলে তারার ভাষায়। আবার কেউ
জ্যোৎস্নার ভাষায় কথা বলে উঠে। এসব শুনতে ভালো লাগে তবে শোনাটা ভাগ্যের
ব্যাপার। একান্ত সৌভাগ্যের না হলে সুশ্রী ভাষার মানুষের সংস্পর্শে যাওয়া
যায় না।
জন্মথেকেই আমরা চারজন দুর্ভাগা। বেড়ে উঠেছি বস্তিতে আর বেড়ে উঠার পর নিজের চেষ্টায় কিছু করতে না পেরে মালিকের আন্ডারে কাজ করি।
বস্তির
মালিক জুলমত খা একজন পাকা বদমাশ। আমাদের কাজ হচ্ছে বস্তির মেয়েদের ফিটিং
দেয়া। তার বিনিময়ে দুচার পয়সা আমরা পাই। বস্তির মেয়েরাও পায়। সে টাকায় তারা
আলতা কেনে, ফেইস পাউডার কেনে। মুখে মেখে রক্তজবার পা দেখিয়ে চলে যায়।
আমরাই তাদেরকে এগিয়ে দেই কলতলা থেকে মালিকের মুগদার হোটেলে। রাতের অন্ধকারে
চুপিচুপি তাদেরকে নিয়ে যাওয়া এবং সূর্য উঠার আগে আগে তাদেরকে বাসায় ফিরিয়ে
আনা আমাদের দায়িত্ব।
কাজটা সহজ হলেও বেশ ঝামেলা আছে। রাস্তায় পুলিশ আর
মাস্তান গুণ্ডারা মেয়েদেরকে ছিনিয়ে নিতে চায়। সে জন্য আমরা পকেটে সাধারণ
কিছু অস্ত্র রাখি। মানিকের চাপাতিটা কালকে কিনেছে। এর আগ পর্যন্ত সেও আমার
মতো গরু জবাইর একটা ছুরি রাখতো পিঠের কাছে গুঁজে। আজকাল তার সখ হয়েছে
চাপাতি দিয়ে মানুষ কোপাবে। যেই ভাবা সেই কাজ, মালিককে গিয়ে বললো আমার একটা
চাপাতি লাগবে। মালিক জুলমত খাঁ তাকে কানে কানে কী যেনো বলে। মুখটিপে হাসে
মানিক। জুলমত খা তার পিঠ চাপড়ে দেয়। মানিক নুয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে
মালিককে।
আজ সন্ধার পর থেকে পিয়ারিকে বুঝাচ্ছি। কিন্তু তার একই কথা।
Ñট্যাকার দরকার নাই। আরে বোকা, ট্যাকা না থাকলে খাবি কী? আর কষ্টতো তর হইবো
ঠিকই, তারউপর আনন্দও তো পাবি। আনন্দের কথা শোনে পিয়ারি মুখ টিপে হাসে। তার
তেরো বছরের ফুটে উঠা যৌবন কলি থেকে পুষ্পের দিকে রুখ লয়। সুযোগটা হাতছাড়া
করতে চায় না রতন। সে গিয়ে পিয়ারিকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। লজ্জায় লাল হয়ে
যেতে যেতে পিয়ারির শ্যামলা বদন একধরণের খয়েরি রূপ ধরে। Ñযাহ! বদমাশ। পিয়ারি
ঝাড়া দিয়ে রতনকে ছাড়াতে চায়। সোহাগ গিয়ে পিয়ারির ঠোঁটে চুমু খায় আর আমি
সুযোগ বুঝে পেয়ারার মতো ফুলে উঠা স্তনে মর্দন করি। পিয়ারির শরীরটা কেঁপে
উঠে। Ñকী? যাবি তো? কথা কয় না পিয়ারি। চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে
থাকে। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে ডাস্টবিনটার পিছে ঝোঁপের ভেতর পিয়ারি তখন
আমাদের সাথে যেতে রাজি হয়।
মালিকের ভাড়া করা সিএনজিতে রাত নয়টার সময়
আমরা মুগদা আয়েশ হোটেলের সামনে পৌঁছুই। যাবার সময় পিয়ারি কেমন মায়া মায়া
চোখে আমার দিকে চায়। যেনো বলতে চায়, সত্যিই যাইমু ভিতরে? Ñহ, যা। ভিতরে
সুখের খনিÑআমিও চোখের ভাষায় বলি। পিয়ারি নতমুখে হোটেলের গেট দিয়ে ঢুকে।
একপা গিয়ে আবার সে ফিরে আসে এবং কি জানি কি ভেবে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়।
আমি থতমত খেয়ে গেলে সে আমার চোখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, Ñআমার জন্য তুমি
অপেক্ষা করবা? Ñহ,করবো। বলেছি তাকে। কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করা আমাদের
কাজ না। মালিকের ছোটখাটো অন্য কাজ থাকে। আমরা এখন সেসব করতে বেরোবো।
মালিকের
মেয়ের জন্য বিয়ের গয়না লাগবে। তা না হলে এতো বড় চালানের রিস্ক সে নিতো না।
দশ হাজার পিস ইয়াবা ঢুকবে আজ ট্রাকে করে। আমাদের কাজ সেগুলো সেখান থেকে
এনে জুলমত খাঁর ঘরের মেঝেয় পুতে দেওয়া। রাতের অন্ধকারেই করতে হবে এসব কাজ।
এর জন্য অবশ্য মোটা অংকের টাকাও দিবে আমাদেরকে। জুলমত খা বলেছে, Ñযুদি
ঠিকঠাক করতে পারোস, তদের চাইরজনের জন্য থাকলো বিশ হাজার ট্যাকা। আমি ভাগের
পাঁচহাজার টাকার স্বপ্ন দেখি। মানিক, রতনও নিশ্চয়ই দেখে। সোহাগ হয়তো স্বপ্ন
দেখে এ টাকায় সে ভালো কোনো হোটেলে যাবে। মালিকের বস্তির মেয়েদেরকে খেয়ে
তেমন স্বাদ পাওয়া যায় না। অনুভুতিটা কেমন ভোঁতা হয়ে আসে। সোহাগ চোখ পিটপিট
করে বলে, আইজগা মডেল খামু। আমি রতনের দিকে চেয়ে বলি, Ñট্রাক কয়টায় ঢুকবো?
Ñরাত বারোটা। রতন উত্তর দেয়। আমরা তখন বাংলা মদ খাওয়ার জন্য দুতিনঘন্টা পড়ে
থাকি স্বর্ণা আপার কাছে। স্বর্ণা আপা ভাতের ফ্যানের মতো না চোয়ানো পঁচা মদ
আমাদেরকে গেলাসে ভরে দেয়, আমরা ঢকঢক করে পান করি। পান করতে করতে আমরা
ভাবি, Ñপাঁচ হাজার টাকা করে পাইলে এই শালার ফেনের মদ আর খাবো না। একটা কেরু
কিনে ঢকঢক করে পান করার তৃষ্ণা আমার প্রবল হয়ে উঠে।
এগারোটা
পঁয়তাল্লিশে আমরা স্বর্ণা আপার বাসা থেকে উঠি। তখন রাতের এ অংশটা অনেক নীরব
হয়ে গেছে যদিও ঢাকা শহর এই উপকণ্ঠ থেকে বেশি দূরে নয়। আমরা নিজেদের চোখ
চাওয়াচাওয়ি করে রাস্তার পাশে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকি। কৌশলে হাত বুলাই
আমাদের পিঠে সাঁটা ধারালো অস্ত্রগুলোতে। চাপাতিতে হাত বুলিয়ে মানিকের মুখটা
কেমন দানবীয় উজ্জল হয়ে উঠে। সে আপন মনে বিরবির করে বলে Ñশালা কথা কইবি কম।
ঘটনা এমন যে যেনো সত্যি সত্যিই কাউকে চাপাতি উচিয়ে শাসাচ্ছে। আমরা শব্দ
করে হাসতে গিয়ে চুপ করে যাই।
রাত বারোটা বিশে আমাদের কাঙ্খিত ট্রাকটি
আসে। মানিক এ বিষয়ে খুব চাল্লু। সে ট্রাকের দরজা খুলে লাফিয়ে উঠে যায়
ড্রাইভারের পাশে। তার পরমুহুর্তেই হাতে একটা মাজারি সাইজের অসুধের বক্সের
মতো কিছু একটা নিয়ে লাফিয়ে নামে। কাজটি সে এতো দ্রুত করে যে তার উটা এবং
নামার তফাৎ থাকে না। আমরা এবার অন্ধকারে রাস্তা ছেড়ে অলিগলি, মাঠ, বাসার
চিপাচাপা ইত্যাদি দিয়ে এগুতে থাকি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। আইল্লার দল
আমাদেরকে আক্রমন করে এবং আমাদের কাছ থেকে ইয়াবার পুটলাটা কেড়ে নিতে চায়।
অগত্যা আমাদের রণ লাগে আইল্লা সন্ত্রাসের দলের সাথে। ওদের হাতে হয়তো
শর্টগানটর্টগান আছে। দুয়েকটা ফাঁকা গুলি ছুড়ে। আমরা পালিয়ে যে যেদিকে পারি
ছুটি। তবে রতনের পড়ে যাওয়ার শব্দ পাই। ওকে ধরে ফেলার ভেতর আমরা আমরা
সুযোগের সদব্যবহার করে সটকে আসি। ইয়াবার পুটলাটা মানিক বুকের কাছে রেখে
হাঁপায়। মালিক তার গালে চুমু খায়। বলে, Ñমন চায় মাইয়াডারে তর কাছেই বিয়া
দেই। কিন্তু কী করমু ক, মাইয়াডা পছন্দ করে অন্যকাউরে আর তুইও ইডাবিডা ছাড়া।
ইডাবিডা ছাড়া শোনে আমাদের মন খারাপ হলেও টাকাটা পেয়ে আমরা খুশি হই। তারপর
মালিকের কথামতো হোটেল থেকে পিয়ারিকে আনতে গেলে হোটেলের দারোয়ান আমাদেরকে
স্টোররুমের দিকে নিয়ে যায়। সেখানে পরিত্যাক্ত চাদর-তোষকের ভেতর পিয়ারির
রক্তাক্ত দেহ দেখায়। মুখে বলে, Ñএতো কম বয়সের মাইয়ারে আনছেন, আপনেরা কি
মানুষ না নাকি? নাকি জানোয়ার?