নিজস্ব
প্রতিবেদক: নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়ার পর শত
প্রতিকূলতার মধ্যেও তা বাস্তবায়নের কঠিন যাত্রায় সঙ্গে থাকায় দেশের মানুষের
প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি
বলেছেন, “মানুষের কাছ থেকে যে অভূতপূর্ব সাড়াটা আমি পেয়েছিলাম, সেটাই
কিন্তু আমার সাহস আর শক্তি।ৃ মানুষ আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। তাদেরই সাহসে এই
পদ্মা সেতু আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।”
আগামী শনিবার পদ্মা সেতু
উদ্বোধনের আগে বুধবার সকালে নিজের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। স্বাভাবিকভাবেই তার
বক্তৃতার একটি বড় অংশে ছিল পদ্মার স্বপ্ন পূরণের ইতিবৃত্ত।
বিশ্ব ব্যাংক
এ প্রকল্পে অর্থায়নের চুক্তি করলেও পরে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলে,
যা নিয়ে দীর্ঘ টানাপোড়েন চলে। কিন্তু সেই অভিযোগ তারা প্রমাণ করতে পারেনি।
পরে
প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে নিজস্ব অর্থায়নে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ
সেই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায় নির্মিত এ সেতুতে
এখন যান চলাচল শুরুর অপেক্ষায় পুরো দেশ।
শেখ হাসিনা বলেন, “পদ্মা সেতু
আমাদের অহংকার, আমাদের অর্জন। প্রমত্ত পদ্মা নদী দেশের দক্ষিণ অঞ্চলকে
রাজধানী ঢাকা ও আরও অনেক অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। আমরা দক্ষিণ
অঞ্চলের মানুষ। কাজেই সেই কষ্টটা আমরা খুব ভালো করে জানি। দক্ষিণ অঞ্চলে
বসবাসকারী মানুষরাই জানে কী ঝুঁকি নিয়ে আর কত কষ্টে সময় ব্যয় করে আমাদের
রাজধানীতে প্রবেশ করতে হয়।”
পদ্মা সেতু নির্মাণে গুণগত মানের ক্ষেত্রে
কোনো ‘আপস করা হয়নি’ মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “এই সেতু নির্মিত হয়েছে
বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণ দিয়ে। পুরো নির্মাণ প্রক্রিয়া
সম্পন্ন হয়েছে সর্ব্বোচ্চ মান বজায় রেখে।
“পদ্মা সেতুর পাইল বা মাটির
গভীরে বসানো ভিত্তি এখন পর্যন্ত বিশ্বে গভীরতম। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর
পর্যন্ত এই সেতুর পাইল বসানো হয়েছে। ভূমিকম্প প্রতিরোধ বিবেচনায় ব্যবহৃত
হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি।”
পদ্মা সেতু করতে গিয়ে ভূমি অধিগ্রহণের
প্রয়োজনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের
যথাযথ ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও জানান সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন,
“ভূমিহীনসহ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্লট বরাদ্দ দেওয়া
হয়েছে। অতিরিক্ত সহায়তা, ভিটা উন্নয়ন সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তাদের
জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য কর্মমুখী ও আয়বর্ধনমূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ
দেওয়া হয়েছে, অর্থ সাহায্য দেওয়া হয়েছে এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য পুনর্বাসিত
এলাকাকে “পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সেখানে বনায়ন
সৃষ্টি করা হচ্ছে।”
সেতু চালু হলে সড়ক ও রেলপথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১
জেলার সঙ্গে ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের
দীর্ঘদিনের অবহেলিত, আমরা দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ উন্নয়নের ছোঁয়া আমরা পাব।
এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের ভোগান্তি লাঘব হবে, অন্যদিকে অর্থনীতি হবে
বেগবান। পদ্মাসেতু জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসনেও ভূমিকা রাখবে
জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আশা করা হচ্ছে এ সেতু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ১ দশমিক
২৩ শতাংশ হারে অবদান রাখবে এবং প্রতি বছর দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য
নিরসন হবে।
“আল্লাহর রহমতে অতি দরিদ্র তো থাকবেই না, দারিদ্র্যের হারও
কমে আসবে। এ সেতুকে ঘিরে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে, হাই টেক পার্ক
হবে। এমনকি আমাদের দ্বিতীয় নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টও দক্ষিণ অঞ্চলে করা
যায় কিনা তার জন্য আমি জমি খুঁজে বেড়াচ্ছি।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন,
“পাওয়ার প্ল্যান্ট আগে করে ফেলেছি এই জন্য যে সেতু হওয়ার সাথে সাথে সেখানে
শিল্পায়ন ঘটবে। সেখানে প্রয়োজন হবে বিদ্যুতের। সেদিকে লক্ষ্য রেখেছি। আর
পায়রা সেতুটাও আমরা এখন নির্মাণ করেছি। আমাদের ইচ্ছা আছে এটা চাহিদা
মোতাবেক আমরা সেটাকে ডেভেলপ করব।”
আওয়ামী লীগ সরকার যখনও কোনো উন্নয়ন
প্রকল্প নেয়, সেখান থেকে কতটুকু ‘রিটার্ন পাবে’ বা কতটুকু মানুষের সহায়তায়
আসবে, সেটা বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হয় বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী
লীগ সভানেত্রী।
তিনি বলেন, “পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গেও একটা
সংযোগ হবে। তাই আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এই সেতু বিশেষ ভূমিকা রাখবে
এবং পদ্মার দুই পাড়ে পর্যটন শিল্পও গড়ে উঠবে।”
হাজারো মানুষের শ্রমে এই
স্বপ্নের সেতু নির্মিত হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশ ছাড়াও
চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউ
জিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, জাপান, ডেনমার্ক, ইতালি, মালয়েশিয়া,
কলম্বিয়া, ফিলিপিন্স, তাইওয়ান, নেপাল ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিশেষজ্ঞ এবং
প্রকৌশলীরা এই সেতু নির্মাণের সঙ্গে জড়িত।
“আজ সকল ষড়যন্ত্র-প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে লাখো শুকরিয়া”, বলেন শেখ হাসিনা।