প্রভাষ আমিন ||
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বারবার পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে ষড়যন্ত্রের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়ী করেন, আরো অনেকের মতো আমারও খারাপ লাগে। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ব্যক্তি, বিশ্বের অনেক দেশেই যাকে সম্মানের উচ্চ আসন দেওয়া হয়েছে, যাকে নিয়ে গোটা জাতির গর্বিত হওয়ার কথা; তার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর বারবার এমন অভিযোগ একটু অস্বাভাবিক মনে হতে পারে।
এমনকি শেখ হাসিনা পদ্মা নদীতে ড. ইউনূসকে ‘চুবনি’ দিতে চেয়েছেন। মনে হতে পারে, ব্যক্তিগত বিরাগ থেকেই বুঝি শেখ হাসিনা বারবার বিষোদগার করছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তো তাঁর অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠে দায়িত্ব পালন করার কথা। ফলে তিনি যদি সত্যি সত্যি ব্যক্তিগত বিরাগ থেকেই ড. ইউনূসের বিরোধিতা করেন, তবে তা শপথেরও লঙ্ঘন। কিন্তু যারা ষড়যন্ত্রের ভেতরটা জানেন, তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের চলে যাওয়ার পেছনে ড. ইউনূসের বড় ভূমিকা রয়েছে। সরকার চাইলে দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারতো। কিন্তু শেখ হাসিনা নিছক মুখের কথায় তাকে মাফ করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে ড. ইউনূসের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল। তিনি চাইলে দেশের স্বার্থে এই ভাবমূর্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে আরো ত্বরান্বিত করতে পারতেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য- কখনোই দেশের কোনো বিপর্যয়ে ড. ইউনূসকে পাওয়া যায়নি। দেশের স্বার্থে ইউনূস কখনোই নিজের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবহার করেননি। তা অবশ্য তিনি না-ই করতে পারেন, সেটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু তিনি যখন তার ক্ষমতা, প্রভাব আর ভাবমূর্তি দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন, তখন সেটা বেদনাদায়ক।
বয়স ফুরিয়ে যাওয়ার পরও গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকতে চেয়েছিলেন ড. ইউনূস। একজন ব্যক্তির জন্য আইনের ব্যতিক্রম করতে চায়নি সরকার। বিষয়টি গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। সেখানে হেরে নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়তে হয়েছিল তাকে। সেই থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি তার বিরাগ। আর সরকারের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরোধ থেকেই তিনি বাংলাদেশকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেন। এটা বাংলাদেশের জন্য বড় একটা আক্ষেপের বিষয়- ড. ইউনূসের মতো এত বড় সম্পদ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের কোনো কাজেই লাগলো না!
এ কথা মানতে দ্বিধা নেই, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী। স্বাভাবিকভাবেই পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্পেও বিশ্বব্যাংক পাশে থাকবে এটাই প্রত্যাশিত। শুরুতে ছিলও। প্রথমে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। তারপর একে একে এসেছিল আইডিবি, এডিবি এবং জাইকা। একটা সময় ছিল যখন উন্নয়ন সহযোগীরা ঋণের পাশাপাশি গাদা গাদা শর্ত আর পছন্দের প্রতিষ্ঠান নিয়ে আসতো। বাংলাদেশকেও তা মেনে নিতে হতো মুখ বুজে। দিন যে বদলে গেছে, তা বোধহয় বুঝতে পারেননি দাতারা। বলা হচ্ছে, পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দেওয়াতেই বিগড়ে যায় বিশ্বব্যাংক। একটি উড়ো চিঠির সূত্র ধরে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর পরামর্শক প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ আনে। তারপর যুক্ত হয় কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের শীর্ষ কর্মকর্তার ডায়েরির পাতায় লেখা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কাল্পনিক অভিযোগ। বিশ্বব্যাংকের প্রবল চাপে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির কাল্পনিক অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন। বাংলাদেশ ধোয়া তুলসি পাতা, কোনো প্রকল্পে দুর্নীতি হয় না; এমন দাবি আমি কেন, শেখ হাসিনাও করবেন না। কিন্তু কোনো টাকা ছাড় হওয়ার আগেই কীভাবে দুর্নীতি হতে পারে, তা আমার মাথায় ঢোকে না।
পদ্মা সেতুর তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনকে দূর থেকে চাপ দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি বিশ্বব্যাংক। তাদের প্রতিনিধি দল ঢাকা এসে বৈঠক করে দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে। তারা তদন্তের আগেই বারবার চাপ দিচ্ছিল মামলা করার, তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে আসামি করার। বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদল বারবার জানতে চাইছিল ড. ইউনূস আর ড. কামালের সঙ্গে সরকারের সমস্যা নিয়ে। চাপ শুধু বিশ্বব্যাংকের দিক থেকে নয়, চাপ ছিল সরকারের ভেতর থেকেও। তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এবং প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীও দুদককে চাপ দেন, যাতে তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, রিমান্ডে নেওয়া হয়। আসলে তারা চেয়েছিলেন, যে কোনো মূল্যে বিশ্বব্যাংক যাতে সন্তুষ্ট থাকে। বিশ্বব্যাংক একবার ফিরে গেলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি হবে, এ নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু যেখানে দুর্নীতির ধোঁয়াও নেই সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না দুদকের পক্ষেও। দেশে-বিদেশে তদন্ত করেও অভিযোগের সত্যতা পায়নি দুদক।
দুদক যতই ক্লিন সার্টিফিকেট দিক, বিশ্বব্যাংকের আনা অভিযোগ থেকে বাংলাদেশের বাঁচার উপায় ছিল না। এমনিতেই দুদকের দুর্নাম আছে সরকারি দলের নেতাদের ক্লিন সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যাপারে। সেখানে এত বড় ইস্যুতে, সত্য-মিথ্যা যাই হোক, দুদকের কথা কেউ বিশ্বাস করতো না। বাংলাদেশকে আসলে বাঁচিয়ে দিয়েছে কানাডার আদালত। কানাডার আদালতও যখন বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ উড়িয়ে দিলো তখন আর তাদের মুখ থাকলো না। তবে বিশ্বব্যাংক তাদের অভিযোগ প্রত্যাহার করেনি, একটি দেশের বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ ভুল প্রমাণিত হওয়ার পর তারা ক্ষমা তো চায়ইনি, কোনো ব্যাখ্যাও দেয়নি।
কোনো অপরাধ প্রমাণিত না হলেও মন্ত্রিত্ব হারাতে হয়েছিল সৈয়দ আবুল হোসেনকে। দেশের স্বার্থে বিশ্বব্যাংককে সন্তুষ্ট করতে কারাগারে যেতে হয়েছিল তখনকার সেতু সচিব বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোশাররফ হোসেন ভুইয়াকে। সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে। তিনি জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংক তাকে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার শর্তে বিশ্বের যে কোনো জায়গায় মোটা বেতনের চাকরির অফার দিয়েছিল। কিন্তু তাকে টলানো যায়নি।
এত কিছুর পরও বিশ্বব্যাংককে ঠেকানো যায়নি। পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয় তারা। বিশ্বব্যাংককে অনুসরণ করে একে একে চুক্তি বাতিল করে আইডিবি, এডিবি, জাইকাও। তখন সবাই ধরে নিয়েছিলেন পদ্মা সেতু আর হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ায় অনেকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েও শঙ্কিত হয় পড়েছিলেন। কিন্তু একজনের মনে ছিল অন্য কথা- তিনি শেখ হাসিনা। নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু করার ঘোষণা দিয়ে তিনি সবাইকে চমকে দেন। তবে শেখ হাসিনার ঘোষণায় আস্থা রাখতে পারেননি অনেকে। সরকারের ভেতরের-বাইরের একটা বড় অংশ মনে করেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে পদ্মা সেতু করতে যাওয়াটা দেশের জন্য ভালো হবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা কারো কথা শোনেননি। শেখ হাসিনা যদি তখন সবার কথা শুনে নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু না বানাতেন, তাহলে হয়তো দেশের একটি সেতু কম হতো। কিন্তু তারচেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি দেশের ভাবমূর্তির। সারা জীবন বাংলাদেশকে একটি কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগ বয়ে বেরাতে হতো। বিশ্বব্যাংকও চিরকালের জন্য বাংলাদেশকে পেয়ে বসতো। তাদের কথায় ওঠবস করতে হতো। এক সিদ্ধান্তে শেখ হাসিনা সারাজীবনের জন্য বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দিলেন। বিশ্বকে তিনি সুস্পষ্ট বার্তা দিলেন, বাংলাদেশ এখন আর আগের অবস্থায় নেই। আত্মমর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়ানোর মতো সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক চলে যাওয়ার পরও কিন্তু ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। এমনকি তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তিও ‘জোড়াতালি’ দিয়ে পদ্মা সেতু বানানো হচ্ছে অভিযোগ করে, সেতুতে না ওঠার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ছিল নানা রকমের রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা। এমনকি পদ্মা সেতুতে শিশুর মাথা লাগবে, এমন গুজবে আতঙ্ক ছড়ায় সারাদেশে। এই গুজবে প্রাণ গেছে একাধিক মানুষের। এমনকি পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পরও ষড়যন্ত্র থামেনি। কখনো ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে, কখনো সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেই যাচ্ছে একটি মহল। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল দাবি করেছেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়া কবে কোথায় গোপনে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করলেন; দেশের মানুষ জানলো না; এ এক রহস্য বটে!
সব কাজ শেষ হওয়ার এখন একটি মহল লেগেছে টোলের পেছনে। নিজেদের টাকায় বানানো হলে পদ্মা সেতুতে টোল লাগবে কেন? এমন শিশুতোষ প্রশ্নও শুনতে হচ্ছে। পদ্মা সেতু বানাতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে টাকা নিয়েছিল সেতু বিভাগ। এখন টোল থেকে সেই টাকা ফেরত দিতে হবে। এই সোজা কথাটাও অনেকে বুঝতে চাইছেন না। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিড়ে নানা ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা করা হচ্ছে। নেওয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
ষড়যন্ত্র যেমন থেমে থাকেনি, থেমে থাকেনি পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজও। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা পিছিয়ে দিলেও পদ্মা সেতু এখন তৈরি। ৯ মাত্রার ভূমিকম্পও পদ্মা সেতুকে টলাতে পারবে না। শত-সহস্র ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে পদ্মা সেতু এখন ঝলমল করছে কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করে। ষড়যন্ত্রের কালো মেঘ ঢেকে রাখতে পারেনি খরস্রোতা পদ্মার বুক চিড়ে বানানো গর্বের সেতুকে।