মেহেরুন্নেছা ||
চালতা ফুলের সাদা পাপড়ি আর তার হলুদ পরাগকেশর বহুকাল যাবত এই বাংলায় বর্ষা বন্দনা করে চলেছে। আষাঢ়ের প্রথম দিনেই আষাঢ়স্য ঘোরে বর্ষার দু'টো দেয়ালচিত্র নিয়ে এসেছিলাম। শোভা পাচ্ছে সেগুলো আমার শিয়রে। ঘুম থেকে ওঠে ঘুমঘুম চোখে অপলক তাকিয়ে থাকি ছবির দিকে। মনের কোনে বেজে ওঠে নজরুলের বর্ষাসিক্ত কথামালা,
"রিমি ঝিম রিমি ঝিম ঐ নামিল দেয়া
শুনি শিয়রে কদম, বিদরে কেয়া।"
যদিও আষাঢ়ের এই লম্বা দিনে চড়া রোদে নাকাল হই, ভ্যাপসা গরমে ক্লান্ত হই। কখনো ঝপ করে নিভে যায় রোদের তেজ। চমকে বেসামাল হয় হৃদয়। সাদা মেঘের ফাঁক-ফোকরে জমে থাকা খন্ড খন্ড কালো মেঘ মনের আঙিনায় ছড়ায় বর্ষার অভূতপূর্ব রেশ। দূরে কৃষ্ণচূড়ার লালচে আভার দিকে
তাকিয়ে ব্যাকুল হই। যেন ঐ কৃষ্ণচূড়ার মতন আমিও প্রতি বর্ষায় মহাকালের বুকে হারিয়ে যাওয়া কোনো পুরোহিতের হলুদ খামের অপেক্ষায় প্রহর গুণি।
ঐ যে কৃষ্ণচূড়ার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সোনালু। গ্রীষ্ম থেকেই সোনালু আর কৃষ্ণচূড়া মোহমুগ্ধতা বিলিয়ে যাচ্ছে অবিরত। যে স্নিগ্ধতার শুরু গ্রীষ্মে বর্ষায়ও তার এতোটুকু কমতি নেই। হে পাঠক, জগত যে সুন্দরের আধার! বর্ষার দূত কদম্ব যেন সেই স্বর্গীয় শোভাকে আরো অযুতগুণ বাড়িয়ে দেয়। বৃষ্টিস্নাত তারুণ্যে উদ্দীপিত হয় পল্লবরাজি। প্রকৃতি ধুয়েমুছে অনাবিল আনন্দের পসরা সাজিয়ে বসে। কি অদ্ভুত! প্রকৃতির এই আনন্দ আয়োজন কেবল পৃথিবীর মানুষের জন্যই!
কবিগুরু বর্ষার বন্দনা করেছেন এভাবে,
"এই শ্রাবণ বেলা বাদল ঝরা
যূথীবনের গন্ধে ভরা
বাদল সাঁঝের আঁধার মাঝে
গান গাবে প্রাণ পাগল করা।"
বর্ষার এতো সৌরভ, এতো রূপ! কবিকণ্ঠে আরো ধ্বনিত হয়---
"বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছো দান
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান...."
শহরের ছাদবাগানে রঙ আর ঘ্রাণের মাতম তুলে এই বর্ষার পুষ্পরাজি। রজনীগন্ধার ঝংকার, গোলাপের হাসি, জবার বেপরোয়া বাড়িয়ে রাখা বদন, হাসনাহেনার পাগল করা সৌরভ, মোরগঝুঁটির তাক লাগানো রূপ, সরলা কলাবতী আর ঝকমকে নয়নতারাদের গল্পের যেন শেষ নেই।
প্রতি বর্ষায় আমি হই এক দোলনচাঁপা। সাদা রঙের বড় বড় পাপড়ির মতো নিজেকে মেলে ধরি ঐ নীলিমায়। পেলব পরশে আচ্ছন্ন থাকি দিনমান। আহা! ঝরছে বারিধারা! রূপবতীরা যে আজ দোলনচাঁপার ন্যায় প্রজাপতি!
বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় পিয়াসি মন নিয়ে যখন টিভির সম্মুখে নিবেশিত হলাম ঠিক তখনই দৃষ্টি হয়ে গেলো অনড়। টিভির পর্দায় অবারিত জলের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। বন্যার পানিতে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ! মানুষের আহাজারি-দুঃখ-রোনাজারি। বন্যার্ত হাজার মানুষের গ্রন্থিত দুঃখ-বেদনার প্রতিবেদন উপস্থাপকের বর্ণনায় কর্নকুহরে স্পর্শ করতে লাগলো। নান্দনিক বর্ষা যে রীতিমতো রাক্ষসী! এই রাক্ষসী ঘন্টায় ঘন্টায় ফুলে ফেঁপে উঠছে। নূহ নবীর বন্যা যেন! নদী আর সমতলের জলে কোনো ভেদাভেদ নেই। ঘরবন্দী মানুষ মাচায় আশ্রয় নিয়েছে। সর্পে-মানুষে কিংবা পতঙ্গে-মানুষে
গলাগলি। থৈথৈ পানিতে আশ্রয়হীন প্রতিটা জীব। এমনকি পিঁপড়ের দলও!
কোথাও উঁচু দালান ধ্বসে পড়ছে। জীবন বাঁচাতে পাকা বাড়ির একতলা ছেড়ে দোতলায় যাওয়ার সুযোগ পেলোনা এক পরিবার। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া
নীচতলাতেই তাদের সলিলসমাধি হলো। সিলেটের সর্বত্র খাবারের অভাব, পানির অভাব, আশ্রয়ের অভাব। সিলেট ও সুনামগঞ্জবাসীর দুর্দশার সীমা রইলোনা। চারদিকে জল আর জল! অথচ তৃষ্ণায় তাদের বুক ফেটে যাচ্ছে।
এসময় যারা পৃথিবীর মায়ালোক ত্যাগ করে পরলোকে গমন করে তাদের নিয়ে যারা বেঁচে থাকে তারা মহাবিপদে পড়ে যায়। কোথায় তাদের প্রিয়জনদের লাশ সমাধিস্থ করবে? বিশাল জলরাশিতে লাশ ভাসিয়ে দেয়া ছাড়া উপায় নেই। সন্তান ভাসিয়ে দিচ্ছে বাবার লাশ কিংবা মায়ের লাশ। বাবা ভাসিয়ে দিচ্ছে সন্তানের লাশ। জগতের এ চিত্র যে কত হৃদয়বিদারক! পৃথিবীর বেঁচে থাকা মানুষগুলোর এতোটা কষ্টের ভারও যে বইতে হয়! তবুও বেঁচে থাকা! তবুও লড়াই করে যাওয়া!
অতঃপর সব বিপর্যয় একসময় ম্লান হয়ে আসে। বন্যার প্রকোপও কমে আসে। এরইমধ্যে বাংলাদেশে মর্মান্তিক ও ঘৃণ্য দু'টি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে। এ দুটি ঘটনার বিবর্ণ আবহে এখন আর বর্ষার রিনিঝিনি শব্দ মনকে সিক্ত করে না। বরং বেদনার বাতাসে রিক্ত করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত আমাকে। আমার এ কলম বর্ষার সুধা রচনার চেয়ে পরপর ঘটে যাওয়া দু'টো ঘটনার দিকেই ধাবিত হচ্ছে।
ছাত্রের ক্ষোভের শিকার হলো তারই শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার। জিতু নামের এই ছাত্রটি তার শিক্ষককে ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে মেরেই ফেললো। ভাবছি, ছাত্র কেনো এতো ক্ষোভ পুষে রাখবে শিক্ষকের উপর? তবে কি ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের মানসিক স্বাস্থ্য পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে? একবার ভাবুন, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বন্ধন কতটা নাজুক এখন? ঘটনাটি মনে পড়লেই শিউরে উঠছি!
এখন সময়টাই অসময়ের। বৈশ্বিক উষ্ণতার আঁপ যেন প্রতিটি মানুষের মননে, মগজে, মেজাজে। এখন ছাত্র পেটায় শিক্ষককে, তার বাবা-মাকে, তার গুরুজনদের। আবার শিক্ষকও পেটায় ছাত্রকে, বলাৎকার করে, ছাত্রীকে ধর্ষণ করে, ইভটিজিং করে।
আপনাকে স্বীকার করতে হবে এ প্রজন্মের সন্তানদের শৈশব নেই, পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ নেই, মানবিকতা নেই, সামাজিকতা নেই। তাদের আছে মোবাইল, তাদের আছে ল্যাপটপ, তাদের আছে টিকটক। সন্তানকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-পুলিশ-আমলা বানাতে গিয়ে ওদের জীবনকে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেয়ার জন্য আমরা বাবা-মা কি দায়ী নই? সমাজ দায়ী নয়? আমরা কোমলমতি ছাত্রকে দোষ দিয়ে নিজের অপরাধ কতটা ঢাকতে পারবো?
আমি মনে করি, এই কোমলমতিদের পংকিলতায় ঠেলে দিয়েছে সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার সকলে মিলে। আজ সেটা ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে দেখা দিয়েছে। এই অশুভ পরিক্রমা থেকে বের হতে হলে এক্ষুনি তৎপর হতে হবে। নতুবা ডিজিটালাইজেশন আর উন্নয়ন হয়ে পড়বে পঁচা শামুকের মতো। কাটা যাওয়া শরীরে অতিদ্রুত এরা পচন ধরাবে।
আরেকটি জঘন্য ঘটনা ঘটেছে নড়াইলের কলেজ অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে নিয়ে। হাজারও মানুষ এবং পুলিশের সামনে
উনাকে জুতার মালা গলায় পরতে হলো। স্বপন কুমারের অন্যায়টা কী? নাহ! স্বপন কুমারের কোনো অন্যায় নেই। এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে তাতে মনে হচ্ছে, এই সমাজের বিচার এখন উত্তেজিত জনতার হাতে। স্বপন কুমারের কলেজের একজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এসেছে। তো অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি অন্যান্য শিক্ষক, অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বাবা ও কলেজ পরিচালনা পরিষদের কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা পুলিশকে খবরও দিয়েছেন। তারপরেও স্বপন কুমারের শেষ রক্ষা হয়নি। বাকী জীবন তিনি জিন্দালাশ হয়ে বেঁচে থাকবেন।
এ জুতার মালা কেবল নড়াইলের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় নয়, এ জুতার মালা আপনার-আমার গলায়ও ঝুলছে। একটা জাতি ধর্মান্ধতা এবং অসভ্যতার চরম সীমায় পৌঁছালেই কেবল এটা সম্ভব। ধর্ম আর রাজনীতির লিভিং টুগেদারের ফসল হচ্ছে আজকে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানো। শিক্ষকরা নীরিহ। শিক্ষককে দোষারোপ করা সহজ। অথচ হঠকারি পুলিশের হঠকারিতা ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। এদেশের পুলিশ নারীর কপালের টিপ নিয়ে ব্যঙ্গ করতে পারে। এদেশের পুলিশ শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানোতে সহায়ক হতে পারে। এরপরেও আমজনতা এই পুলিশের দুর্বিনীত ভূমিকাকে আড়াল করতে চাইবে। এর কারণ একটাই। সেই ধর্ম! ধর্মের দোহাই দিয়ে এইসব অরাজকতাকে জনতা সাপোর্ট দিচ্ছে।
এখনো ব্রিটিশ বেনিয়াদের রেখে যাওয়া আমলাতন্ত্রের রোষানলে পড়ে নীরিহ শিক্ষক। যত দোষ নন্দঘোষের মতো প্রতিক্রিয়াশীল ও অসভ্য অভিজাততন্ত্রের পাঠার বলি হয় শিক্ষক। রীতিমতো উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার মতো করে জুতার মালার ঘটনার জন্য শিক্ষকদেরই একটা মহল দুষছেন। তারা বলছেন, শিক্ষকের কর্ম পরিণতির জন্যই নাকি আজ শিক্ষকের গলায় জুতার মালা উঠছে। এই ভাবনাওয়ালাদের ভাবনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার শক্তি আমার বাহুতে নেই। কেবল ঘৃণা প্রকাশের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানোই এই অধমের দৌরাত্ম্য।
আজব এ সমাজ! নড়াইলের অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরানোতে যারা শিক্ষক সমাজকে দুষছেন তারাও আসলে ধর্মান্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল। ঘটনার গভীরে না গিয়ে ইচ্ছাকৃত ধর্মান্ধগোষ্ঠীকে রক্ষার জন্যই তারা এই স্টান্টবাজি করছে।
এমন বিষাদময় দিনে টাপুরটুপুর বৃষ্টি আবারো স্পর্শ এনে দেয় বর্ষার অমিয় স্নিগ্ধতার। অনুভূতিরা মৃদলয়ে মনের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে। কবির কাছে বর্ষার রূপ-রন্ধ্র ক্রম উন্মোচিত হতে থাকে। বর্ষার বারিধারায় বিগলিত হয়েই কালিদাস লিখেছিলেন 'মেঘদূত'। মেঘের নিনাদ বজ্রপাত আর বিজলির চমক কবিকে কাব্যসুধায় বিভোর করে রাখে। বর্ষা তার কবিকে নিরেট বাস্তবতা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় দূর কোনো মোহময় স্বপ্নে! কি এক পাওয়া না পাওয়ার বেদনায় দুলে ওঠে প্রেমিক-প্রেমিকার কোমলপ্রাণ।
বারান্দার কেদারায় বুদবুদসম কল্পনার ডালা নিয়ে বসেছি। বিকেল সন্ধ্যাকে ছুঁই ছুঁই করছে সবে। গুরুগুরু মেঘ গুমরে উঠছে গগনে। এই বুঝি নামবে ঝপাস বৃষ্টি! সত্যিই নামলো তাই! আমি উঠতে পারলামনা চেয়ার থেকে। আজিকে কে যেন আমাকে আটকে রেখেছে বৃষ্টির পরশে! আমি আজ ঠিক পথের পাঁচালীর দুর্গা। চুল ঘুরিয়ে বৃষ্টি মাথায় সেই কদম্বতলে নাচবো বলে অপেক্ষায় রয়েছি।
অতঃপর ভেজা বাতাসে ভর করে রাত নামে। ঘনরাতে ঠাওর করতে পারিনা কোথায় ডাকছে ভেকের দল। মন্ত্রমুগ্ধের মত
পার করে দেই সারাবেলার আজকের স্মৃতি। চেয়ে রই আরেকটি বর্ষণমুখর দিনের আশে। কারণ ছাড়াই অজানা আনন্দে গুণগুণিয়ে উঠলাম....
"নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে
তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।"
মেহেরুন্নেছা
সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ।
কুমিল্লা।