মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.) ||
বাংলাদেশের
চলার পথে বিকল্পহীন বাতিঘর আমাদের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রাম ইতিহাস ও
মুক্তিযুদ্ধ, যার বিকল্পহীন সলতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার। সীমাহীন
ঝড়-তুফানের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখনো সলতেটি জ্বালিয়ে রেখেছেন।
১৯৭৫ সালের পর থেকে এই সলতেটি উপড়ে ফেলা এবং বাতিঘরটি নিভিয়ে দেওয়ার জন্য
কত চেষ্টাই না হয়েছে এবং এখনো চলছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো।
আবার
রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে জামায়াত-বিএনপি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যা
করার জন্য গ্রেনেড আক্রমণ চালাল। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-প্রতিযোগিতা অন্য
বিষয়। রাজনীতির নামে যারা প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করে এবং করতে চায় তাদের
দ্বারা রাষ্ট্র ও জনগণের কোনো কল্যাণ হয় না, শেষ পরিণতিও ভালো হয় না। একটি
পরিবারকে সম্পূর্ণ শেষ করে দেওয়া এবং রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্য
বাংলাদেশের ভেতর থেকে যারা চেষ্টা করছে তাদের উদ্দেশ্য কী, তারা কী চায়।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে অনুরোধ করছি।
দৈব কথা
নয়, যৌক্তিক বিশ্লেষণই বলবে শেখ হাসিনার অবর্তমানে বাংলাদেশ এত দিনে হয়
পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো একটি রাষ্ট্রে পরিণত হতো, আর নয়তো কোনো
পরাশক্তির তাঁবেদার রাষ্ট্র হয়ে যেত। ১৯৭৫ সালের পর থেকে ২০০৮ পর্যন্ত
বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে যা যা ঘটেছে এবং এখনো যেসব ষড়যন্ত্রের
নিদর্শন পাওয়া যায় তার নির্মোহ বিশ্লেষণ করলে আমার মন্তব্যের যথার্থতা
পাওয়া যাবে। রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে হঠাৎ করে কিছু হয় না। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল
পর্যন্ত স্বাধীনতা অর্জনের পথে ধারাবাহিকভাবে যত সংগ্রাম ও কর্মকাণ্ড হয়েছে
তার প্রতিটির উদ্ভাবক, চালিকাশক্তি ও অবলম্বন ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত করে কেউ কিছু কখনো বলতে
পারে না। অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে অজানা পথে চলতে হয়। রাষ্ট্রের বেলায় সেই অজানা
চলার পথে পেছন থেকে আলো নিক্ষেপ করে তার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ২৩ বছরের
সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দর্শন, আদর্শ ও মূল্যবোধকে অবলম্বন
করে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু একাত্তরের
দেশি-বিদেশি সম্মিলিত পরাজিত পক্ষের প্রতি-আক্রমণে মাত্র সাড়ে তিন বছরের
মাথায় বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন, বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে গেলেন দুই
মেয়ে—শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তারপর শুরু হয় দুই সামরিক শাসকের অন্ধকার
যুগ। মহাসর্বনাশ ঘটতে থাকে একের পর এক। গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের
আদর্শ-দর্শনসহ যা কিছু জাতি-রাষ্ট্রকে পথ দেখাতে পারে তার সব কিছু ধ্বংস
করে ফেলা হয়। ভূতের মতো রাষ্ট্র পেছনে হাঁটতে থাকে। ১৯৯১ সালে এসে একটা
গণতান্ত্রিক আবহের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ২০০১ সালে একটি বিতর্কিত নির্বাচনের
মাধ্যমে বিএনপি সরকার গঠন করে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতকে নিয়ে। চিহ্নিত
যুদ্ধাপরাধীরা মন্ত্রী হন। দেশব্যাপী অবারিতভাবে চলতে থাকে বোমাবাজি,
গ্রেনেড হামলা, লুটপাট ও দুর্নীতির মহোৎসব। বিশ্ব অঙ্গনে কালো তালিকায় নাম
ওঠে বাংলাদেশের। তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল ও দেশের সর্ববৃহৎ দল আওয়ামী
লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চালানো হয় ২০০৪
সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট অপকর্মের
জন্য নির্বাচনে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে বিচার বিভাগ, নির্বাচন
কমিশন, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনসহ সর্বত্র নির্লজ্জভাবে দলীয়করণ করে। প্রতিবাদে
সোচ্চার হয় দেশের সব শ্রেণির মানুষ।
২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে
অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের জন্য ২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন
স্বয়ং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়ে টু ইন ওয়ান হিসেবে যে নির্লজ্জ
ভূমিকা রাখেন তারই ফলে কথিত এক-এগারোর আগমন ঘটে। জরুরি আইনসহকারে
ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে যে সরকারটির আগমন ঘটে সেটি পরিচিতি পায় সেনাসমর্থিত
সরকার হিসেবে। আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারটির শিরোনাম হয়
মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকার। অল্প দিনের মধ্যেই এদের দুরভিসন্ধি মানুষের
কাছে ধরা পড়ে। তারা প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলকে ভেঙেচুরে, তার
নেতৃত্বকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে উদ্যত হয়, যাতে তাদের লক্ষ্য ও দুরভিসন্ধি
বাস্তবায়নের পথে কোনো বাধা না থাকে। তাদের এই পথে এক নম্বর প্রতিবন্ধক
ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মেয়ে ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ফলে রাজনীতি থেকে
চিরতরে মাইনাস করার জন্য ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই অতি প্রত্যুষে শ্রাবণের
বর্ষণের মধ্যে বিশাল গাড়িবহর নিয়ে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত
অসৌজন্যমূলকভাবে গ্রেপ্তার করে শেখ হাসিনাকে। তারা মনে করে, শেখ হাসিনাকে
মাইনাস করতে পারলেই তাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে। তা না হলে যেসব অভিযোগে শেখ
হাসিনাকে সেদিন গ্রেপ্তার করা হয় তার সব অভিযোগই আরো অধিক মাত্রায় প্রযোজ্য
ছিল অব্যবহিত পূর্ববর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বেলায়। শেখ
হাসিনাকে গ্রেপ্তারের প্রায় দুই মাস পর খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তখন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন সচিবালয়ের বারান্দায় কোটের বোতাম
লাগাতে লাগাতে একটু বাঁকা হাসি দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সমান করে দিলাম, তাই
এখন আর কারোর কোনো অভিযোগ থাকা ঠিক নয়। এ ছাড়া অভিযোগ আনার ক্ষেত্রে সময়ের
বিবেচনাকে ইচ্ছাকৃতভাবে একটি ব্র্যাকেটেবন্দি করা হয়। দেখা গেল, ১৯৯৬
সালের পরবর্তী সরকারগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে। শেখ হাসিনাই যে তাদের
অভিযানের একমাত্র লক্ষ্য ছিল তা বোঝা যায় শুধু একটি প্রশ্ন করলে। ১৯৯১ সাল
থেকে বা তারও আগে ১৯৮২ সালের এরশাদের আমল থেকে প্রক্রিয়াটি শুরু হলো না
কেন? কেন সেটা ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু হবে। এর কি কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে
পারে? কিন্তু শেষ কথা হলো, গধহ ঢ়ৎড়ঢ়ড়ংবং, এড়ফ ফরংঢ়ড়ংবং.. এত কিছু করেও
ষড়যন্ত্রকারীরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলেন না। শেখ হাসিনার প্রজ্বলিত বাতিঘরই
সেদিন বাংলাদেশকে রক্ষা করে। পথিমধ্যে দুটি বছর শুধু হারিয়ে গেল না,
রাষ্ট্র ও রাজনীতির যে সর্বনাশ তাঁরা করে গেলেন তার পরিণতি থেকে আমরা এখনো
মুক্ত হতে পারছি না।
গত ১২ বছর একনাগাড়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে পথ
দেখাচ্ছেন বলেই বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিশ্বের বড় বড় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান
বলছে, এই ধারা ও পথে যাত্রা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ
পৃথিবীর ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে। তখন মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড থেকে
বাংলাদেশ এগিয়ে থাকবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য বিশাল সম্ভাবনার
হাতছানি। পাতাল সড়ক, পাতালরেল বাংলাদেশের জন্য এখন আর স্বপ্ন নয়। বিদ্যুৎ ও
সড়ক নেটওয়ার্কের সঙ্গে আজ বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম সংযুক্ত। ডিজিটাল
বাংলাদেশ আমাদের কিভাবে রক্ষা করেছে সেটি আমরা সবাই এই করোনাকালে উপলব্ধি
করেছি। শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র সেদিন সফল হয়নি বলেই আজ বাংলাদেশ
এই জায়গায় পৌঁছেছে। ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন-বিসর্জনের সমীকরণ করে
দেখুন, বুঝবেন শেখ হাসিনার বিকল্প কোনো নেতৃত্ব তখনো ছিল না, এখনো নেই।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ২০০৭-০৮ সময়ের সেই একই গোষ্ঠী সেই একই ষড়যন্ত্র
করে যাচ্ছে। ২০১৫-১৬ সালের সেই দুঃসময়ে তারা আইএস এসেছে, আইএস এসেছে বলে
চিৎকার শুরু করল। বলল, আইএস দমনের জন্য বড় শক্তির সরাসরি সাহায্য নেওয়া
প্রয়োজন। উদ্দেশ্য, তাতে শেখ হাসিনার ক্ষমতা খর্ব হবে এবং একই সময়ে হয়তো
সুযোগ বুঝে মাইনাস করে দেওয়া যাবে। কিন্তু এ যাত্রায়ও তারা সফল হয়নি। কারণ
রাজনৈতিক সাহস, আত্মবিশ্বাস ও যেকোনো ত্যাগ স্বীকারের জন্য যিনি সর্বদা
প্রস্তুত থাকেন তাঁকে মাইনাস করা সহজ নয়। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান
বঙ্গবন্ধুকে মাইনাস করতে গিয়ে নিজেরাই মাইনাস হয়ে যান।
ইতিহাস থেকে
শিক্ষা না নিলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। শেখ হাসিনাকে যাঁরা মাইনাস করতে
চেয়েছিলেন তাঁরাই আজ জনগণ থেকে মাইনাস হয়ে গেছেন। মন্দের ভালো, ২০০৭-০৮
মেয়াদে সবাই দেখেছেন—ভয় দেখিয়ে, জেল-জুলুমের হুমকি দিয়ে শেখ হাসিনাকে কেউ
পিছু হটাতে পারবে না। ২০০৭-০৮ মেয়াদে যাঁরা এই অপচেষ্টা করেছেন তাঁরা
নিজেদের ওজনটা নিজেরাই বুঝতে পারেননি। জনগণের শক্তিকে তাঁরা ছোট করে
দেখেছেন। শুদ্ধ পথ, সম্মুখ পথে না পেরে যারা আকাঙ্ক্ষা পূরণে অশুদ্ধ ও
পেছনের অন্ধকার রাস্তা বেছে নেয় তাদের পরিণতি ভালো হয় না। একাত্তর থেকে
দেখে আসছি, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছু ব্যক্তি ও পক্ষ
রয়েছে, যাদের লক্ষ্যটাই অশুদ্ধ, অপবিত্র। তারা মুখে মুক্তিযুদ্ধ,
গণতন্ত্রের কথা বললেও অন্তরে প্রতিহিংসা ও শর্টকাট পথে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য
রাষ্ট্রকে বিকিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না। সে চেষ্টাই তখন তারা করেছে।
এরা অশুভ শক্তি। এই অশুভ শক্তি বাংলাদেশের শেষ বাতিঘরটি নিভিয়ে দেওয়ার
চেষ্টা করে ২০০৭-০৮ মেয়াদে।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক