ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
রবিবাসরীয়.............
Published : Sunday, 17 July, 2022 at 12:00 AM, Update: 17.07.2022 1:07:59 AM
রবিবাসরীয়.............













গল্প

মূর্খতার পুরুষবাদী  মিথ




রবিবাসরীয়.............কাজী মোহাম্মদ আলমগীর ||


তিনি বলেছিলেন, কাউকে মূর্খ মনে করো না।
তার লোকেরা এ কথার অর্থ বুঝতে অনেক দিন অতিবাহিত করে । তারা ছিল সংখ্যায় কম। সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। মূর্খ’ বুঝার জন্য তারা মস্তক অবনত করে দাঁড়িয়ে ছিল ।  তাদের দৃষ্টির ভিতর মূখর্’ না বুঝার বেদনা লুকিয়ে ছিল। ইহাই ছিল আশার কথা। কোন কিছু না বুঝলে ব্যাথিত না হলে ব্যক্তি ওই বিষয়ে বুঝতে পারে না । ব্যাথিত হওয়াই মূল কথা।
মূর্খতা না বুঝার কারনে তিনি তার লোকজনের অবস্থা নিয়ে চিন্তিত হলেন।  তিনি বললেন, ঠিক আছে তোমরা চলার পথে  শিখতে থাকো। মূল হলো মূর্খতা টের পাওয়া। তখনো তারা কিছু বুঝলো না। তিনি এক বিন্দু বিচিলিত না হয়ে তাদের বললেন, তোমরা  তোমাদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ো। তখন বুঝতে পারবে আমি কী বলেছি।
অনেকদিন পর তারা সত্যি পরস্পরকে মূর্খ বলা শিখে  নিলো। তাতে মুখ কালো হওয়া, মনে দুঃখ পাওয়া, পরস্পর ঝগড়া করা শিখে তাদের দিন বেশ চলছিল। অপর সকল অশ্লিল গালির চেয়ে মূর্খ’ বলার ভিতর একটা উচ্চতর ব্যাপর ছিল। যদিও এমন বলাও ন্যায়সঙ্গত না।
একদিন তিনি তাদের একত্রে করলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কী কেউ কাউকে মূর্খ বলো ? প্রশ্ন শোনে তারা স্বীকার করলো তারা পরস্পরকে মূর্খ বলে। মূর্খ বললে মনের রাগ কমে । মূর্খ বললে নিজকে শিক্ষিত মনে হয়। যাকে বলা হয় সে ছোট হয়। নিজেকে বড় মনে হয়। তাই তারা প্রয়োজনে মূর্খ বলে। অপ্রয়োজনে বলে না। বললেও পেছনে বলে। মূর্খ বিষয়ে এই হলো তাদের বক্তব্য। তবে ব্যতিক্রম হলো একটি ছেলে একটি মেয়ে। তাদের মূর্খ বললে তারা হাসে। আর কেহ হাসে না। শব্দটির অন্তস্থ অর্থ ছেলে মেয়ে দুজনকে স্পর্শ করে না।
তিনি হুকুম দিলেন ওদেরকে নিয়ে আসতে। তার হুকুমে ছেলে মেয়ে দুজনকে হাজির করা হলো। তিনি তাকিয়ে দেখলেন ছেলে মেয়ে দুজন পরস্পরকে ভালোবাসে । তাই দুজনকে কেউ মূর্খ বললে দুজনে রাগ করে না। তিনি তাদের মধ্যে সৃষ্টির বীজ লক্ষ্য করলেন। তিনি দুজনকে রেখে বাকিদের চলে যেতে বললেন। অন্য সকলে চলে গেলে তিনি তাদের বললেন, তোমাদের কোন ভয়  নেই? তারা দুজন বললো ভয় কী আমরা বুঝি না। দয়া করে আমাদের ভয় বুঝিয়ে দেন।
তিনি তৎক্ষণাৎ দুজনের সামনে বাঘ সিংহ নেকড়ে শাপ হাজির করলেন।
দুজন বললো, এই প্রাণী সমূহ আমাদের হত্যা করতে পারে। এই যদি হয় ভয় তাহলে আমরা এই পর্যায় অতিক্রম করেছি। দেখুন, এই বলে দুজনে বাঘ নেকড়ে এবং সিংহের সঙ্গে কিছুক্ষণ খেলাধুলা করলো। বাঘ সিংহ নেকড়ে দুজনকে জিব দিয়ে হাত পা গলা চেটে দিলো। প্রাণী সমূহ গলা বাড়িয়ে আদর নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলো। গলায় গম্ভীর স্বর তোলে জানান দিলো প্রাণীগুলো কৃতজ্ঞ। শাপ তাদের শরীর প্যাঁচিয়ে রাখলো কিন্তু কামড় দিলো না। মাথার উপর ফনা তোলে নিজের সাহস ও সৌন্দির্য প্রকাশ করলো।
তিনি বুঝলেন এই প্রাণীরা দুই জনের পূর্ব পরিচিত। যেহেতু তারা দুজনকে ভালোবেসে বনে বাদাড়ে পাহাড়ে উপত্যাকায় ছুটে  বেড়ায়, তাদের শরীরের গন্ধ প্রাণী সমূহের স্মৃতিতে জমে আছে।
তাদের এই অবস্থা দেখে তিনি আনন্দ অনুভব করলেন।  তিনি দুজনকে বিভিন্ন রঙিন ফল খেতে দিলেন। ফল ভক্ষণ শেষে তারা ফলের রঙে পরস্পরকে রাঙিয়ে নিলো।
তিনি আরো আনন্দ অনুভব করলেন।  তিনি ভাবলেন এরা দুজন দুজনকে ভালোবাসতে গিয়ে শিল্প সত্তা আবিস্কার করে নিয়েছে।  এ শিল্পসত্তা সংজ্ঞায়ীত করার উপযুক্ত সময় এটা না। ভাষা এখনো দুর্বল। ভাষার চেয়ে নীরবতা বেশ শক্তিশালী। তিনি বললেন, তোমরা যেতে পারো তবে সাবধানে থেকো। ছেলে মেয়ে দুজন পরস্পর হাতে হাত রেখে চকিত চলতে শুরু করলে তিনি বুঝতে পারেন তারা সাবধানতা কী জানে না। এ বিষয়ে তাদের জ্ঞান থাকা  দরকার। জ্ঞানের চরিত্র হলো ওষ্টুম। হোঁচট না খেলে বিষয়টি প্রস্তুরিভূত থাকে।
কিছুদিন পর ছেলে মেয়ে দুজন কোন এক বৃষ্টির দিনে উঁচু পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে বৃষ্টি পতনের শব্দ শুনছিল। তারা অনুভব করলো বৃষ্টি পতনের শব্দের সঙ্গে রক্তের ভিতর নৃত্যের যোগ রয়েছে এবং উষ্ণ হওয়ার আবেদন রয়েছে। তারা পাহাড়ের আরো ভিতরে  গেলো এবং অন্ধকার অনুভব করলো। তারা বুঝতে পারলো অন্ধকারের গভীরে টান রয়েছে। বৃষ্টি শেষ হলে দুজনে পাহাড়ের মুখ থেকে সূর্যের আলোতে বর্ণীল রঙধনু দেখে চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করলো । তারা সেখানে রাত্রী যাপন করলো। খুব ভোরে  ছেলেটি মেয়ের আগে ঘুম  থেকে জেগে ওঠলো। জেগে দেখে মেয়েটি তার পাশে নেই। মেয়েটিকে খুঁজতে শুরু করলো সে। খুঁজতে খুঁজতে শেষে মেয়েটিকে পাহাড়ের অন্য প্রান্তে  পেলো। মেয়েটি মৃত।
মৃত মেয়েটির শিয়রে বসে একজন পুরুষ রোদন করছিল।
ছেলেটি হত্যাকারীকে চিনতে পারলো। মেয়ের পিতাই মেয়ের হত্যাকারী।
তখন তাদের মধ্যে তখন কথোপকথন হয়।
‘আপনি আপনার মেয়েকে হত্যার মধ্যে দিয়ে কী অর্জন করলেন?’
পিতা বলে, ‘আমার উচিত হয়নি কন্যাকে হত্যা করা। কিন্তু এই অভিজ্ঞতার বিকল্প ছিল না। এখন তুমি আমাকে যে শাস্তি দিবে আমি তা মাথা পেতে নেবো।’
‘আপনি নিজের শাস্তি নিজে গ্রহণ করেছেন। আপনাকে কী শাস্তি দেব!’ ‘আগে বলুন এই হত্যা কাণ্ড আপনাকে কী শিক্ষা দিয়েছে।’
‘আমি আমার মেয়েকে মূর্খ মনে করতাম।’
‘এখন কী মনে হয়?’
‘এখন মনে হয় আমার মেয়ে মূর্খ ছিল না।’
‘আগের অনুভূতি এবং পরের অনুভূতির তফাৎ বলতে পারবেন?’
 ‘ এ আমি বুঝাতে পারবো না। তুমি যেদিন আপন কন্যা সন্তান হত্য করবে সেদিন বুঝতে পারবে।’
‘মূর্খতা বুঝতে মানুষকে এত নীচ হতে হবে? এতোটা নিষ্ঠুর হতে হবে!’

তখন বালু রাশিতে ঝড় ওঠে।  ধুলিঝড় দুজনকে ঘিরে রাখে। এখানে এমন ধুলি ঝড়ে মানুষের প্রাণও যায়। তারা ভয় পেয়ে পরস্পরের শরীরে পরস্পর মাথা গুঁজে। তারপর এভাবে প্রেমিক এবং ঘাতক  রক্ষা পায়।
একসময় ঝড় থামে।

তখন একত্রে বসবাসকারী অন্যরা তাদের দুজনকে ধরে নিয়ে সেই ব্যক্তির নিকট যায়। যিনি তাদের বলেছিলেন তোমরা কেউ কাউকে মূর্খ বলো না।
সমস্ত ঘটনা তার কাছে খুলে বলার পর তিনি দুজনকে রেখে বাকিদের চলে যেতে বলেন। সকলে চলে গেলে তিনি দুজনকেও মুক্ত করে দেন।

সেই থেকে মেয়ে প্রেমে পতিত হলে বাবা মেয়েকে মূর্খ বলে।
সেই থেকে মেয়েকে অস্বিকার করার পর বাবা মেয়েকে মূর্খ বলে না।
সেই থেকে পুরুষরা মনে করে মূর্খতা ছাড়া প্রেম হয় না।


প্রবন্ধ



মহর্ষি মনোমোহন দত্ত
আত্মজ্ঞানসম্পন্ন মানবতাবাদি এক সিদ্ধভক্ত




মানিকরতন শর্মা ||
আবহমান বাংলার শাশ্বত-সংস্কৃতি হচ্ছে সঙ্গীত। এই সঙ্গীত বাঙালির মননে, চেতনায়, সংগ্রামে, মুক্তিতে, ঐতিহ্যে পরিব্যাপ্তভাবে জড়িয়ে রয়েছে। গান শোনেনি এমন কোনো ব্যক্তি নেই। বাঙালিমানেই সঙ্গীত প্রিয় জাতি। গানের বাণী ও সুরে আন্দোলিত হয় মানুষের মন ও চেতনাবোধ।
সপ্তদশ শতকের দীন ভবানন্দ থেকে শুরু করে পাগলা কানাই, রাধারমণ দত্ত, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, দ্বিজ দাস, হাসান রাজা, উকিল মুনশি, দুর্বিন শাহ, রজ্জব আলী দেওয়ান, দীন শরৎ, লালন শাহ, পাঞ্জু শাহ, শাহ আব্দুল করিম, মহর্ষি মনোমোহন দত্তসহ অসংখ্য আধ্যাত্মিক ভাবধারার গীতিকার ও সুরস্রষ্টাকে আমাদের সঙ্গীতভুবনে দেখতে পাই। তাদের অমর সৃষ্টি সমৃদ্ধি করেছে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গীতভাণ্ডারকে। কী নেই তাদের গানেÑ মনশিক্ষা, দেহতত্ত্ব, বাউলতত্ত্ব, রাধা-কৃষ্ণ, ভক্তিমূলক তথা আত্মজ্ঞানমূলক ভাবের সমাহার। সঙ্গীত হচ্ছে এক রসময় সিন্ধু। সেই সিন্ধুতে নব-নব ভাবের উদ্গীরিত হয়। শ্রোতাও নব-নব ভাবে সঞ্চারিত হয়।
প্রখ্যাত সঙ্গীত গবেষক প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত তাঁর ‘মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’ গ্রন্থে বলেছেন, “গান কিংবা সঙ্গীত, শব্দ দুটি শুনলেই যেন মনের ভিতরে নানান রকম সুর বয়ে যায়। কারোর মধ্যে সুর ব্যাপারটি নিজের অজান্তে নেচে ওঠে। আবার কারো মধ্যে নদীর মতো তির তির করে বয়ে যায়। তাহলে সুর আর গান একই বস্তু! এ তর্কের চেয়ে বড় কথা হল, কোথায় থেকে আসে এই সুরÑ সুর কি তবে মানুষের প্রকৃতিজাত! বলা হয়ে থাকে সঙ্গীতের জন্মই হয়েছে ধর্মের আঁতুড়ঘর থেকে।
ধর্মের মূল উপাদানের সঙ্গে সঙ্গীতের একটি অবিভাজ্য সম্পর্ক তাতে স্থাপিত হয়ে যায়। কারণ ধর্মের ভাষ্য ও বাণী মানুষের মর্মে প্রোথিত করার জন্য আচার হিসেবে এসব বাণী সুর করে গাওয়া হত। সে কারনে সৃষ্টির আদি থেকে ধর্ম আর সঙ্গীত একনিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে আছে।
মানুষের চিন্তা ও মননের বিকাশের দীর্ঘ পথে ধর্মীয় সঙ্গীতের রয়েছে বিশাল প্রভাব। একইভাবে সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশে দেশে ধর্মীয় সঙ্গীতের ধারা মানুষের সাধনা, ভক্তি পরমানন্দের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
যদি প্রশ্ন করা হয় সঙ্গীত বলতে কী বুঝায়, এক কথায় তা বলা মুশকিল। কারণ সঙ্গীত কি শুধুই বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ, সনাতনি শ্লোকবিন্যাস অথবা উপনিষদ এর শ্রুতিযোগ? নাকি আউল-বাউল লোকসঙ্গীত-লোরচন্দ্রাণী, কবিরের দোঁহার কুয়াশা অথবা রবীন্দ্রনাথের শেষ পাড়ানির কড়ি?
তাতেও সঙ্গীতের প্রকৃত মর্মার্থ বোঝানো যাবে না। এর জবাব অন্য জায়গায় পাওয়া যেতে পারে। তিনি মনে করেন, এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে আমাদেরই সত্তায়। এ এক প্রাকৃত সম্পর্ক।”
আধ্যাত্মিকসঙ্গীতের পরিমণ্ডলে আমরা মনোমোহন দত্তকে চিনি মলয়া সঙ্গীতের জনক, মরমী সাধক, কবি, বাউল, সমাজ সংস্কারক ও অসংখ্য অসাধারণ গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক হিসেবে।
১২৮৪ বঙ্গাব্দের ১০ মাঘ নবীনগর উপজেলার সাতমোড়া গ্রামে মনোমোহন দত্ত জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম পদ্মনাথ দত্ত, তিনি শান্ত সরল-সাধু প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি ভক্তিভরে ‘মালসী’ গাইতেন। (মালসী হচ্ছে শ্যামাসঙ্গীত বিশেষ। শক্তিউপাসক ভক্তরা এই সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকেন। এইটি সঙ্গীতের রাগিনী বিশেষও।) পদ্মনাথ দত্তের পিতা বৈদ্যনাথ দত্তও শ্যামা সঙ্গীত লিখতেন, নিজেও গাইতেন। সজ্জন, সৎ, ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসেবে মনোমোহনের পিতামহ বৈদ্যনাথ দত্তের সুনাম ছিলো। অসাধারণ শ্রুতিধর ছিলেন তিনি। তাঁর মাতার নাম হরমৌহিনি। তাঁদের পারিবারিক পেশা ছিল কবিরাজি। মনোমোহন দত্তের পূর্বপুরুষরা সোনারগাঁও ভট্টগ্রামের জমিদার ও এ অঞ্চলের প্রধান সাঁজওয়াল ছিলেন। সাঁজওয়াল বলতে সে সময় যারা বাদশাদের সৈন্য সামন্ত যোগান দিত তাদের বোঝায়। পরে ঐ বংশের একটা অংশ সাতমোড়া গ্রামে বসতি স্থাপন করে।
মনোমোহন দত্তের শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের রামজীবন চক্রবর্তী নামক এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের পাঠশালায় এবং পরে গ্রামের স্কুল থেকে মাইনর (পঞ্চম শ্রেণি) পাস করেন। পরবর্তীতে কলকাতার প্রখ্যাত আইন ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম খাঁ এর ভগ্নীপতি মনোমোহনের পিতা পদ্মনাথ দত্তের নিকট চিকিৎসার্থে সাতমোড়া আসেন। তিনিই মনোমোহনকে মোক্তারী পড়ার পরামর্শ দিলেন।
পরামর্শ অনুযায়ী পিতা পদ্মনাথ দত্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আইনগ্রন্থের তালিকা সংগ্রহ করে আনার ব্যবস্থা করেন। মনোমোহন পুনর্বার পড়াশোনা শুরু করেন। তারপর সাতমোড়া গ্রামেরই মোক্তার যজ্ঞেশ্বর পালের ব্রাহ্মণবাড়িয়াস্থ বাসভবনে থাকার ব্যবস্থা হলো তাঁর। বিনিময়ে মুহুরির সকল দায়িত্বই পালন করতে হতো মনোমোহনকে। মোক্তার মহাশয়ের হুকুমজারী তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না।
যা হোক পরে ঢাকাস্থ আনন্দ পালের বাসায় থেকে মোক্তার পরীক্ষায় দুটো কবিতা লিখে দিয়ে যথারীতি ফেল করেন।
এর পর মনোমোহন পুনরায় ওকালতি পড়বার জন্যে রাজধানী আগরতলাতেও গিয়েছিলেন। বইপত্রও সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। জীবিকার্জনের উপায় হিসেবে মোক্তারী অথবা ওকালতি পড়ার এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে।
মনোমোহন দত্ত একজন অতি সাধারণ মানুষ ছিলেন। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষও যে কর্মের দ্বারা অসাধারণে রূপান্তরিত হতে পারেন, মহাঋষিতে পরিণত হতে পারেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মনোমোহন। একজন মানুষ হৃদয়ে কেবল “ গুরুসত্য” ও “জয় দয়াময়” অমঘ বাণী হৃদয়ে ধারণ করে সাধন ভজনের মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে একটির পর একটি স্তর অতিক্রম করে একজন মহামানবে পরিণত হয়েছেন, ব্রহ্মজ্ঞানে জ্ঞান লাভ করেছেন, জ্যোতিষ্মান হয়েছেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মানুষ যে যে ধর্মই পালন করে থাকুক তা একই স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। তাই তিনি ধর্ম বিভেদ ঘুচাতে সর্বধর্মকে সমন্বয় করে “জয় দয়াময়” জপ প্রচার করে গেছেন। মনোমোহন সাধুর জীবন ছিল বড়ই বৈচিত্র্যময়। পরিবার স্বচ্ছল ছিল না। ফলে জীবিকা অর্জনের জন্য ছুটে বেরিয়েছেন ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত। কিন্তু কোথাও কিছু হয় নি।
১৩০৩ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে মনোমোহন প্রথম ছন্দোবদ্ধ কবিতা রচনা করলেন। “মনোমোহন দত্ত জীবন ও কর্ম” গ্রন্থে গবেষক সুকুমার বিশ্বাস উল্লেখ করেছেনÑ

নাথ! তোমা বিনে এ ভব ভুবনে
যত কিছু কিছু নয়
তুমি মূলাধার সর্ব্ব সারৎসার
তুমি হে ব্রহ্মাণ্ডময়।
সেই বছরই গুরু আনন্দ স্বামীর কৃপায় এবং বাক্যমতে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন মহর্ষি মনোমোহন দত্ত।
মনোমোহন দত্তের অধ্যাত্ম জীবন, সাধন-ভজন, সৃষ্টি-কর্ম সবকিছুর মূলে তাঁর আরাধ্য গুরু মহারাজ আনন্দ স্বামীর অবদান। আনন্দ স্বামীর পিতা রাম দুলাল নন্দী ছিলেন ত্রিপুরা মহারাজের দেওয়ান। ত্যাগী শাক্ত রামদুলাল নন্দীর একমাত্র সন্তান ছিলেন আনন্দচন্দ্র  নন্দী বা আনন্দ স্বামী। রামদুলাল অত্যন্ত গুরুভক্তি পরায়ণ ভক্ত ছিলেন। এই আনন্দচন্দ্র নন্দী বা মহারাজ আনন্দ স্বামীই মনোমোহনের দীক্ষাগুরু । এই  গুরুকে তিনি সর্বস্বজ্ঞান করেছেন। তাঁর চরণে বার বার প্রণাম জানিয়েছেন। গুরুর কাছে অবনচিত্তে আত্মসমর্পণ করেছেন তিনি। তাঁর একাধিক সঙ্গীতে এ-পরিচয় বিধৃত :
গুরু কল্পতরু মূলেÑ আশ্রয় নিয়ে বসে থাক, ও মন আমার কুতূহলে / গুরু নিত্য গুরু সত্য গুরু হয় পরম তত্ত্ব,/ শ্রীপদে মজায়ে চিত্ত, ভাব নিত্য প্রাণ খুলে  / মায়াতে মানুষ দেহ, করো না কোন সন্দেহ / গুরুকৃপা বিনে কেহ, পায় না মুক্তি কোন কালে / জীবনের মধ্য বিন্দু, হৃদাকাশে গুরু ইন্দু / পার হইতে ভব সিন্ধু, নাই আর ভূমণ্ডলে / যা দেখ ব্রহ্মাণ্ডময়, গুরু ভিন্ন আর কেহ নয় / হলে গুরু পরিচয়, আঁধারে আলোকে জ্বলে / মনোমোহন আত্মহারা, অহঙ্কারে মাতোয়ারা,/গুরুপদ সেবা করা, হল না তারি কপালে /

কিন্তু তিনি যে “ধর্ম ধন” উপার্জন করেছেন, সে ধনের কাছে জগতের সকল বিষয় ধন পরাস্ত হয়েছে। মনোমোহন দত্তের মধ্যে একটা সহজাত গুরুভক্তি ছিল। তাঁর বাড়িতে তিনি তাঁর গুরুর নামে “ আনন্দ আশ্রম” নামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সাধন-ভজন প্রক্রিয়াছিল অনেক আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ।
আফতাবউদ্দিন ছিলেন মহর্ষি মনোমোহন দত্তের সুযোগ্য শিষ্য। তিনি দীক্ষাগ্রহণের পর মনোমোহনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন। মনোমোহন যেখানেই গেছেনÑ সেখানেই সহযাত্রী ছিলেন আফতাবউদ্দিন। আফতাবউদ্দিন মনোমোহন রচিত ‘মলয়া’ সঙ্গীতের প্রতিটিতেই সুরারোপ করেন। বস্তুত আফতাবউদ্দিনই মলয়া সঙ্গীতকে গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-মাঠে-বাটে, নগরে-বন্দরে জনপ্রিয় করে তোলেন। মনোমোহন আফতাবউদ্দিনকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কথিত আছে অনেক রাত্রেই মনোমোহন তাঁর আসন ঘরে আফতাবউদ্দিনকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমাতেন। তিনি প্রত্যেক দিন সন্ধ্যায় আরতি করতেন। ‘মলয়া’ ছাড়া অন্য কোনো সঙ্গীত তিনি গাইতেন না বলে জানা যায়।
১৩২৮ সনের দিকে লবচন্দ্র পাল, আফতাবউদ্দিন এবং মনোমোহন-পুত্র সুধীরচন্দ্র দত্ত কলকাতার ২৭ নম্বর সুখিয়া স্ট্রীটে কিছুদিন বাস করেছিলেন। এ-সময়ই আফতাবউদ্দিনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয় ঘটে। আফতাবউদ্দিন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে গান শুনিয়েছিলেন :
মন মাঝে যেন, কার ডাক শুনা যায় / কে যেন আমারে, অতি সাধ কওে / হাত দুখানা ধরে, কাছে টেনে নিতে চায় / ঈঙ্গিতে সঙ্কেতে পলকে পলকে / কোথা যে’তে নারি, পাছে থেকে ডাকে / শুনে সেই তান, চম্কে উঠে প্রাণ, বলে কথা মান / ফিরে আয় আয়।
অবহেলা করি দৌড়াইয়া যাই / চৌদিকে নেহারি, কিছু নাহি পাই / ফিরে এসে কাছে, দেখি হৃদি মাঝে দাঁড়াইয়া / আছে আমার অপেক্ষায় / হেন প্রাণবন্ধু হৃদয়ে স্বামী / কাছে রেখে আমি দূরে দূরে ভ্রমি / করি কত দোষ, নাহি করে রোষ / সুজন পুরুষ মাখা মমতায় /
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধ্যানমগ্ন হয়ে গান শুনেছিলেন। গান শেষে জিজ্ঞাসা করলেন কার গান? আফতাবউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন, আমার গুরু মনোমোহন দত্তের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি বলেছিলেন, ‘কবি কল্পনা করে সাধক চোখে দেখে।’ গান শোনার পর রবীন্দ্রনাথ প্রতি রবিবার সন্ধ্যায় আফতাবউদ্দিনকে যেতে বলেছিলেন। আফতাবউদ্দিন সন্ধ্যায় আসার অপরাগতার কথা জানিয়ে বলেছিলেনÑ‘সন্ধ্যায় আরতি না করে কোথাও যাওয়া গুরুর নিষেধ আছে।’ এরপর আফতাবউদ্দিন মাঝে মাঝেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে যেতেনÑ গান শোনাতেন।
‘মলয়া’ নামকরণ প্রশ্নে অনেক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বলেন, মনোমোহনের ‘ম’, লবচন্দ্রের ‘ল’ এবং আফতাবউদ্দিনের ‘আ’ যোগে ‘মলয়া’ নামকরণ হয়েছে। এ-তথ্য সম্পূর্ণ ভুল। আমরা জানি, মনোমোহন অধ্যাত্ম সাধনায় সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। ভাব-বিহ্বল অবস্থায় তিনি সঙ্গীতের বাণী মুখে মুখে বলতেন, শিষ্যগণ লিখে রাখতেন। আবার কখনো তিনি নিজেই লিখে রাখতেন। এভাবে দিনের পর দিন রচিত হয়েছে ‘মলয়া’ বা সদ্ভাব-সঙ্গীত।
জনৈক সমালোচক উল্লেখ করেছেন :
‘মলয়া’ শব্দের তাৎপর্য হচ্ছে বসন্তের মলয়-সমীরণ। প্রাণহীন বিবর্ণ শীতের পর বসন্তের মলয় হিল্লোল যেমন প্রকৃতিতে নূতন জীবনের সঞ্চার করে ‘মলয়া’-র সঞ্চিত ভাবও ভাবুকের চিত্তে তেমনি জাগাবে আনন্দের অপূর্ব শিহরণ।
সুতরাং এ কথা স্পষ্ট যে, ‘মলয়া’ নামকরণ কারো নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে নয়। বরং ‘মলয়া’ অপার্থিব অধ্যাত্ম চেতনায় পূর্ণ সদ্ভাব-সঙ্গীত যা পাঠে বা শ্রবণে পৃথিবীর মানুষ পরম শান্তি লাভ করতে পারে, পৌঁছতে পারে এক নতুন ভাবজগতে।
আমরা মলয়া-এর ১ম খণ্ডের ৪র্থ সংস্করণে সঙ্গীতকে ১১টি স্তরে বিন্যস্ত করা হয়েছে : ১। বিবিধ সঙ্গীত, ২. স্বরূপ নির্ণয়, ৩. শ্যামা সঙ্গীত, ৪. কৃষ্ণ-বিষয়ক সঙ্গীত, ৫. শিব সঙ্গীত, ৬. শ্রীশ্রী গৌরাঙ্গ লীলা বিষয়ক সঙ্গীত, ৭. শ্রীমদ্ আচার্য আনন্দ স্বামী মহাশয়ের তিরোভাব, ৮. পিতৃদেবের তিরোভাব বৎসরান্ত উপলক্ষে, ৯. মুসলমানী সঙ্গীত, ১০. ভাব-সঙ্গীত এবং ১১. গাথা। এই খণ্ডে মোট ২৮৭টি গান সংবলিত রয়েছে।
মলয়া ২য় খণ্ডের ৩য় সংস্করণে মোট ১৩৯টি গান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সকল সঙ্গীত সাতটি ভাগে বিন্যস্ত করা হয়েছে : ১. গুরু-তত্ত্ব, ২. কালী সঙ্গীত, ৩. কৃষ্ণ সঙ্গীত, ৪. গৌরাঙ্গ সঙ্গীত, ৫. শিব সঙ্গীত, ৬. আনন্দ সঙ্গীত এবং ৭. স্বরূপ নির্ণয়।
প্রিয় ভক্ত আফতাবউদ্দিন মূলত মলয়া’র সকল গানের সুরারোপ করেছেন।
মহারাজ আনন্দ স্বামীর প্রদর্শিত পথই ছিলো মনোমোহনের পথÑ আর সে পথ সর্বধর্ম সমন্বয় যোগ। প্রত্যেক ধর্মেই এমন কিছু নীতি আছে যা সকল ধর্ম মত ও পথের অনুসারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য। এই গ্রহণযোগ্য নীতির অন্যতম হচ্ছে মানবতাবাদ। মনোমোহনের জীবনাচরণে, মন ও মননে, কর্মে ও সাধনায় মানবতাবাদ ছিলো প্রবল। ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা বিরোধী মনোমোহনের নিকট হিন্দু বা মুসলমান নয়, আত্মজ্ঞান লাভই মূল বিষয়। তাই তো মনোমোহন গেয়েছেন Ñ
কও দেখি মন আমার কাছে, তুমি হিন্দু না মুসলমান,
আল্লা না হরি তোর ঠাকুর বটেরে, তুই কে তোর মনিব কে রে করবে ইনসান্।
তুমি আমি আদি যত কায়া আছে, কে বিরাজে বল এসব কায়ার মাঝে,
প্রাণে প্রাণে টানে টানে জাত বিচার নাই দেখি প্রমাণ।
আওরতে মরদে তামাম দুনিয়া, আলেক সাই গুরু পয়দিস করিয়া,
দিলের মাঝে আছে নিজে লুকাইয়া করিয়া দেখ সন্ধান।
জাতে ভাতে তাতে নাহি ঠেলাঠেলি, প্রাণে প্রাণে করে প্রেমের কোলাকুলি,
কেওবা হরি বলি কেওবা আল্লা বলি, বোলে, বোলে র’ল মুলেতে হয়রান,
ভেবে দেখ দিলে, যোগ দিলে সব মিলে, মনোমোহন কেন হলি পেরেসান।
জনমে মওতে আওরতে মরদে, এক ডুরিতে বাঁধা আসমানে জমিতে
আপ্তাবউদ্দিন কয়, হতে পারলে হয়, জ্ঞানী দেখে সত্য ফুটলে আত্মজ্ঞান।

বিগত বছরগুলোর ন্যায় প্রায় নিয়মিতভাবেই বৈশাখী উৎসবে সাহিত্য একাডেমি মহর্ষি মনোমোহন দত্তকে গভীরভাবে স্মরণ করে আসছে। এই প্রাজ্ঞ অনুষ্ঠানটি করার জন্য সাহিত্য একাডেমিকে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ জানাই। এই মহান মানবের জীবন ও কর্মকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই অনুষ্ঠানটি গভীর তাৎপর্য বহন করে।
প্রকৃত পক্ষে মনোমোহন ছিলেন একজন কবি, সঙ্গীতকার, যোগী অধ্যাত্ম পুরুষ। বাউল পরিমণ্ডলে লালিত, মরমী অধ্যাত্ম ভাবনায় পরিপুষ্ট মনোমোহন দত্ত সর্বধর্ম সমন্বয়কারী ও মানবতাবাদী এক সিদ্ধভক্ত। বাঙালি সংস্কৃতিতে তিনি চিরঅম্লান ও অক্ষয় হয়ে বেঁচে থাকবেন।