ড. শফিকুল ইসলাম ||
বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাংলাদেশকে অন্যান্য এশীয় দেশ থেকে এগিয়ে রেখেছে, যা গবেষণার যোগ্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত একটি শান্তিপূর্ণ, আনন্দময় ও স্থিতিশীল বাংলাদেশ কামনা করেছিলেন। বাঙালির প্রতি তার গভীর ভালোবাসা এবং একটি ঐক্যবদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও সরকারি দৃষ্টিভঙ্গিকে রূপ দেয়। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট সত্ত্বেও বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে বিস্ময়কর ধারাবাহিক অগ্রগতি লাভ করেছে এবং স্বল্পোন্নত দেশের গ্রুপ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে রয়েছে। দেশের জীবনযাত্রার মান, সম্পদ স্থাপন, অবকাঠামো এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিস্থাপকতা সবই নাটকীয়ভাবে উন্নত হয়েছে বর্তমান সরকার আমলে, যা এই সরকারের কার্যকরী পরিকল্পনার সফলতাকে বুঝিয়ে থাকে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি, কারণ দ্রব্যমূল্যের দাম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তা আমাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা অনেক জরুরি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসছে। যা অর্থনীতির জন্য হুমকি। যেখানে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। কিন্তু এখন করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনীতি কিছুটা সংকটে পড়ছে। তাই এ সংকট মোকাবিলায় সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে রেগুলার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
গত এক দশকে আর্থসামাজিক খাতে ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। শিশুমৃত্যু হার প্রতি হাজারে ২৩ দশমিক ৬৭-এ কমে এসেছে। প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যুর হার ১৭৩-এ হ্রাস পেয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর। নারীর রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৭তম। ২০২১ সালে সব আর্থিক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন সরকার সুন্দর এবং সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করছে।
পাবলিক ইউটিলিটিগুলোতে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সরকারি বিনিয়োগও শক্তিশালী হয়েছে। এই সময়ে দেশের অবকাঠামো বিশেষ করে টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ খাতে দ্রুত উন্নতি সাধন যা উল্লেখযোগ্যভাবে মানুষের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। একাধিক বিদ্যুতের উৎস শক্তি সঞ্চালন এবং বিতরণ উন্নত করেছে, যেমন টেলিকম শিল্প রয়েছে, অনেক পরিকল্পিত এবং বর্ধিত মহাসড়ক এবং রাস্তা উন্নয়নে অবদান রেখেছে শেখ হাসিনা সরকার। সরকার দেশের সবচেয়ে শ্রমঘন উৎপাদন বাজার তৈরি পোশাক খাতকে উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেওয়া অব্যাহত রেখেছে।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সেবা করার জন্য অনেক কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়েছে। এটি অনুসরণ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সবার জন্য সমর্থিত হয়, শিশুদের ওপর বিশেষ ফোকাস করে, যার ফলে স্কুলে শিক্ষার্থীদের বৃহত্তর অংশ ধরে রাখা, বাল্যবিবাহ, মা ও নবজাতকের মৃত্যু হ্রাস এবং নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে অভিযোজিত দেশগুলোর মধ্যে একটি। কৃষি, তেল এবং জলজ সম্পদে দেশীয় উপকরণ নিযুক্ত করে প্রোগ্রাম ডিজাইন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সৃজনশীলতাকে উন্নত করেছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে কার্যকরভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পরিবেশগত পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’-এ ভূষিত করা হয়। আন্তর্জাতিক দাতাদের সমর্থন ছাড়াই বৃহত্তম পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রার বাস্তব রূপ প্রতিফলিত হয়েছে। যা দেশের অর্থনৈতিক শক্তি ও সাংগঠনিক স্থায়িত্ব প্রদর্শন করে। আমরা আশা করি দেশের চলমান উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক।
জিডিপি একটি দেশের অর্থনৈতিক আউটপুট এবং আয় পরিমাপ করে। একটি দেশের অভ্যন্তরে উৎপন্ন সব উৎপাদিত পণ্য এবং পরিষেবাগুলোর জন্য মোট ব্যয় হলো মোট দেশীয় পণ্য (জিডিপি)। ১৯৭৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি মোটামুটিভাবে ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এটি ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর মাথাপিছু গড় জিডিপি বেড়েছে ৩.০৫ শতাংশ। বর্তমান জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮.০২ শতাংশ। ২০০৮ সালে এটি ছিল ৪.৮১ এবং ২০১৯ সালে এটি ৭.০৩ ছিল। ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কারণ ২০০৮ সালে জিডিপি ছিল ১০৩৯৫০.৫৩১৩ মার্কিন ডলার এবং ২০১৯ সালে এটি হয় ২০৯৯৭৪.৩৬৭৫ মার্কিন ডলার। এটি প্রায় ১০২ শতাংশ বৃদ্ধি।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে ২০১৯ সালে পণ্য ও পরিষেবার রপ্তানি ছিল ১৫.৩২ শতাংশ। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ৪৪,৯৬১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা রপ্তানি করেছে। ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পণ্য ও পরিষেবার রপ্তানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে যা আমার এক গবেষণায় দেখা যায়। ২০০৮ সালে পণ্য ও সেবা রপ্তানি ছিল ১৮২৯৪.৯৩৬২ মিলিয়ন ডলার এবং ২০১৯ সালে ৩৩০৫৭.৪১৯৯৭ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে ১৪ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধির হার এবং কোনো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ না নিয়ে স্বাধীন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন করেন এবং ২০০৯ সালে জনগণ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেন। তার পর থেকে বাংলাদেশ বাকি বিশ্বকে দেখাতে শুরু করেছে কীভাবে বেড়ে উঠতে হয়। আমার এক গবেষণায় বিশ্বব্যাংকের ডাটা ব্যাংকের তথ্য ব্যবহার করা হয়। ১৯৭৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৪৬ বছরের ডেটা সংগ্রহ করা হয়। এই গবেষণায় সাধারণ রিগ্রেশন এবং সাধারণীকৃত রিজ রিগ্রেশন কৌশল ব্যবহার করা হয়। যেখানে এঘও (এৎড়ংং ঘধঃরড়হধষ ওহপড়সব), ঈঅচঋ (ঈধঢ়রঃধষ ঋড়ৎসধঃরড়হ), ঊঢ (ঊীপযধহমব জধঃব), ওগ (ওসঢ়ড়ৎঃ) এবং ঋউও (ঋড়ৎবরমহ উরৎবপঃ ওহাবংঃসবহঃ) ইতিবাচকভাবে বৃদ্ধি করে। অন্যান্য ভেরিয়েবলের জন্য সামঞ্জস্য করার পর এঘও এবং ওগ জিডিপিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, যেখানে ঈঅচঋ, ওগ এবং ঋউও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই গবেষণায় আরও দেখতে পাই যে, ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অফিসিয়াল এক্সচেঞ্জ রেট, মোট দেশজ পণ্য, মোট জাতীয় আয়, মোট মূলধন গঠন, পণ্য ও পরিষেবার রপ্তানি, পণ্য ও পরিষেবার আমদানি, বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ গড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এর মানে বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করতে সফল হয়েছে। আর দেশ এভাবে এগিয়ে যেতে থাকলে অচিরেই উন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
বর্তমান সরকার শিক্ষা ও আইসিটি খাতে ব্যাপক উন্নতি অর্জন করছে। গত বছর শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ১১.৯২ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়ে আছে ১২.০১ শতাংশ। যদিও এটা নিয়ে কথা রয়েছে কারণ দীর্ঘদিন ধরে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোসহ দেশের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ করার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু তার প্রতিফলন ঘটছে না। তাই বর্তমান উন্নয়ন ও অগ্রগতি ধরে রাখতে বাংলাদেশ সরকারকে আরও সতর্ক হতে হবে। শিক্ষামন্ত্রীর মতে, বড় বড় মেগা প্রকল্প হচ্ছে, যেগুলো আমাদের যোগাযোগের জন্য, দেশের এগিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার। তেমনি পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষার উন্নয়ন। সেজন্য দরকার শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো। সেটিই হবে বড় মেগা প্রকল্প।’ আশা করি আগামী বাজেটে তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটবে বলে বিশ্বাস করি।
ড. শফিকুল ইসলাম : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ