জুবাইদা নূর খান ||
আমার জন্ম শহরে। সেই সুবাদে আমার শৈশব, আমার কৈশোর কেটেছে শহুরে পরিবেশে। শহরের বদ্ধ ঘরের বিজলী বাতির আলো আর বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসে আমার বেড়ে ওঠা। নামকরা বিদ্যালয়ের কড়া অনুশাসন আর গৃহে বাবা- মায়ের কঠোর নিয়ম - কানুন, এইগুলোর পাকে বাঁধা ছিলো আমায় ছেড়ে যাওয়া শৈশব, আমার কৈশোর কাল।
নিসর্গের কাছাকাছি যাওয়ার যে সুযোগ হয়নি - তা বলবোনা; বিভিন্ন ছুটিতে দাদা/ নানার বাড়ি যাওয়া হতো। চর্ম চক্ষে প্রকৃতিকে দেখেছি; তবে তাকে ভালোবাসার আগেই ফিরে এসেছি কাঠ- বালু- পাথরের শহুরে কোলাহলে। প্রকৃতিকে উপলব্ধি করার জন্য যে তৃতীয় নয়নের প্রয়োজন তা হয়তো আমার ক্ষেত্রে তখনো মুদিত অবস্থায় ছিলো ; দেখেও দেখিনি, অনুভব করিনি। আজ জীবনের মধ্যবেলায় সেই ক্ষতিটুকু পুষিয়ে দিতে নানাবিধ উপহারের ডালি নিয়ে হাজির হয়েছে আমার দখিনা বারান্দা। ছোট্ট এক চিলতে শহুরে বারান্দা। এর ঠিক সামনেই পরিত্যক্ত একটা ছোট্ট জায়গায় তিনটি মেহগনি, একটি জাম আর একটি আম গাছ তাদের ডালপালা ছড়িয়ে কেমন জড়াজড়ি করে আছে; যেনো বাবা- মা, সন্তান সমেত মায়া- মমতার বন্ধনে অটুট একটি আদর্শ পরিবার। কখনো তারা পত্রবিহীন উলঙ্গ ; কখনোবা কেমন হালকা সবুজ বড় ছাতা মেলে ধরে ; আবার কখনোবা গাঢ় কালচে সবুজ তেরপালে ছোট্ট জায়গাটাকে যেনো পরম যত্নে ঢেকে রাখতে চায়। ঝিরঝিরে বাতাসে গাছের পাতাগুলো আনন্দে কেমন শিরশির করে কাঁপতে থাকে আর মনে মনে যেনো আওড়াতে থাকে রবীন্দ্রনাথের সেই গানটি --
দখিন হাওয়া জাগো জাগো
জাগাও জাগাও জাগাও আমার সুপ্ত এ প্রাণ
আমি বেণু আমার শাখায় নীরব যে হায় - কত না গান, জাগো জাগো, দখিন হাওয়া
বিধাতার এ এক অপূর্ব চিত্র প্রদর্শনী। এপ্রিল মাসে মেহগনি গাছগুলো ছেয়ে যায় হলুদাভ সবুজ ছোট্ট ছোট্ট ফুলে। বাতাসে কিছু ফুল বারান্দায় এসে পড়ে। একটা একটা করে কুড়িয়ে নেই। মনে হয় তারা যেনো বলে -- " এই দেখো! আমরা তোমার শৈশব ; তোমার কৈশোর; তোমার কাছে ফিরে এসেছি। গ্রহণ করো। দেখবে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।" সত্যিই তো অবিকল নাক ফুলের মতো ছোট্ট ছোট্ট ফুল! আমার দিকে কেমন মিটমিট করে হাসছে ; আমার হারিয়ে যাওয়া শৈশব - কৈশোর আনন্দ যেনো আমায় ঘিরে নৃত্যের সাথে গাইছে নজরুলের সেই গানটি --
সৃজন ছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ
হে মহাকাল প্রলয়-তালে ভোলো ভোলো।
ছড়াক তব জটিল জটা
শিশু- শশীর কিরণ ছটা
উমারে বুকে ধরিয়া সুখে দোলো দোলো।
বারান্দার কাছেই একটি জামগাছ। সেটা আবার অনেক বড়! গ্রীষ্মের শুরুতে সবুজ সবুজ জাম থোকায় থোকায় ঝুলে থাকে। সেইদিকেই অপলক তাকিয়ে ছিলাম। মনে হলো, জামগাছটা যেনো আমায় বলছে, " কি গো! ওমন করে কি দেখছো? তোমরা খাবে; পশুপাখিরা খাবে। তাইতো এতো আয়োজন! উঁহু এখন কিন্তু নয়; আর ক'টা দিন পর। এদের গায়ে একটু রঙের আঁচড় লাগাই; কালো হলে পরে অনেক মিষ্টি লাগবে। তখন খেয়ো, কেমন? ভুলোনা যেনো।"
উঁচু উঁচু মেহগনি গাছগুলোতে আবার অনেকগুলো কাঠবিড়ালির আবাস। মেহগনি গাছের গুড়ির মতোই ধূসর তাদের রং। গাছের গুড়ির সাথে কেমন লেপ্টে থাকে; বুঝার কোনো উপায় নেই যে তারা বিশ্রাম নিচ্ছে। ওদের লেজটাও কেমন অদ্ভুত! আমরা ঘর ঝাঁটা দেই যে ফুলের ঝাড়ু দিয়ে ওদের লেজটাও ঠিক সেইরকম; ফোলা-ফোলা, ঝাড়ুর মতো। কী মায়াকাড়া চেহারা আর চাহনি তাদের! জেগে থাকলে সারাক্ষণ শুধু ছুটোছুটি। এক ডাল থেকে আর এক ডালে; এক গাছ থেকে আরেক গাছে। তারা আবার নিজেদের মধ্যে খেলতে ভালোবাসে। কে কাকে ছুঁতে পারে এমন। একটার পেছনে আরেকটা ছুটছে। কী ক্ষিপ্র গতি তাদের! কী সুন্দর কুটকুট করে গাছের ডাল থেকে পোকামাকড় খুঁটে খুঁটে খায়। আর এদিক ওদিক তাকায়।
দখিনা বারান্দা আমায় নিয়ে যায় স্বাধীন, মুক্ত নির্ভীক এমন এক পরিবেশে যেখানে প্রতিনিয়ত আনাগোনা ঘটে হরেক রকম পাখির। আমি বিস্মিত হই। শহরেও এত্তো পাখি! নিজের চোখে না দেখলে হয়তো আমি বিশ্বাসই করতামনা। মেহগনি, আমের ডালে কী স্বতঃস্ফূর্ত তাদের বিচরণ! চকিতে উড়ে এসে বসে। আবার নিমিষেই প্রস্হান। ছোট্ট টুনটুনি, চড়ুই, শালিক, কাক, বুলবুলি, দোয়েল, ফিঙে-- প্রতিদিনের অতিথি। তাদের বিচিত্র কলতানে এই জায়গাটা কেমন মুখরিত থাকে। টুই টুই শব্দ করতে করতে একটা টুনটুনি উড়ে এসে বসলো তো, সবুজাভ ধূসর ছোট্ট দেহটা নিয়ে আরেকটা টুনটুনি উড়ে গিয়ে বসলো অন্য কোনো ডালে। অস্হির পাখি! এরই মধ্যে কোত্থেকে যেনো তিনটা দোয়েল এসে হাজির।কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার নিরুদ্দেশ। শালিকের বিরতিহীন অভিযোগে তো কান ঝালাপালা! আর দাঁড় কাকের কা-কা রব তো আছেই। মাঝে মাঝে কয়েকটা কবুতর আসে। ওদের পাখসাটে মনটা কেমন বিষন্ন হয়ে পড়ে। হারিয়ে যাওয়া আত্মীয় স্বজনের স্মৃতি মনের দুয়ারে কড়া নাড়তে থাকে। কোনোদিন আবার আকাশ থাকে মেঘাচ্ছন্ন। আমার ছোট্ট বারান্দাও তখন কেমন ধূসর বর্ণ ধারণ করে। পাখির কিচিরমিচির শুনা গেলেও উড়াউড়ি নাই।বৃষ্টি হতে পারে এই ভেবে হয়তো নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। এরই মধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়া শুরু হয়। হালকা বাতাসে গাছের পাতাগুলোও কেমন অপরূপ মহিমায় দোল খায়। কী নিষ্কলুষ প্রেমময় প্রকৃতি! সে কেবল দিতেই জানে। পাওয়ার প্রত্যাশা তো সে কখনো করেনা। সকল রোগের মহৌষধ এই প্রকৃতি ; তাইতো ইংরেজিতে আছে --
ঘধঃঁৎব রং ঃযব নবংঃ ঢ়ধহধপবধ.
আমাদের উচিত প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে উপভোগ করা, তাকে ভালোবাসা, ভালো রাখতে চেষ্টা করা; বিনিময়ে প্রকৃতিও আমাদেরকে ভালো রাখবে কারণ প্রকৃতি কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করতে জানেনা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ