ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
সড়ক দুর্ঘটনা ও অলৌকিকভাবে ভূমিষ্ঠ শিশু নিয়ে ভাবনা
Published : Saturday, 23 July, 2022 at 12:00 AM
সড়ক দুর্ঘটনা ও অলৌকিকভাবে ভূমিষ্ঠ শিশু নিয়ে ভাবনাজুবাইদা নূর খান ||
তলপেটে চিনচিন ব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। আমার মেয়ে পৃথিবীর আলো দেখবে। প্রারম্ভিক সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। অ্যানেসথেসিয়ার কারণে শরীরের নিচের অংশ বোধহীন হলেও ছুরি - কাঁচির খেলা আমি অনুভব করছিলাম। চিকিৎসকদের নিজেদের মধ্যে  কথোপকথন শুনছিলাম। আমার যেনো আর তর সইছিলোনা। কিছু সময় পর চিকিৎসক যখন সদ্য ভূমিষ্ঠ মেয়ের নরম তুলতুলে গাল আমার গালে লাগালেন দু'চোখ দিয়ে অজান্তেই লোনা জল গড়িয়ে পড়লো। আমার আত্মজা! সে কী স্বর্গীয় অনুভূতি!  নরম তুলতুলে হাত দুটো আবার কেমন মুষ্টিবদ্ধ!
মনে পড়ছিলো 'ছাড়পত্র ' কবিতায় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই লাইনগুলো --
    " যে শিশু ভূমিষ্ট হলো আজ রাত্রে
     তার মুখে খবর পেলুম :
     সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
     নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
     জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে
     খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত
     উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
     কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায় ---"
সড়কে জন্ম নেওয়া ত্রিশালের রত্না বেগমের শিশুটির হাত দুটোও নিশ্চয় মুষ্টিবদ্ধ ছিলো। সেও কী তার হাত দুটো উত্তোলিত করে ঘোষণা দিতে চেয়েছিল ---"এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্হান --?" কিন্তু ওর ডান হাতটা যে ভাঙা!  ব্যান্ডেজে মোড়ানো! পৃথিবীতে আসা মাত্রই এতো বড় একটা দুর্ঘটনা!  কচি হাত; হয়তো জোড়া লেগে যাবে দ্রুতই ; অপরাপর শিশুর মতো সেও হয়তো হাত দুটো উঁচিয়ে তার অস্তিত্ব, তার অধিকারের কথা জানান দিতে চাইবে সকলকে। কিন্তু ওর চোখ দুটোর ভাষা কি আমরা পড়তে সক্ষম?  অবুঝ শিশুর অপরাধটা যে কি, তা কি আমাদের পক্ষে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? উত্তর খুঁজতে গিয়ে অতুল প্রসাদ সেনের সেই লাইনটি মনের গহীনে আলোড়িত হতে থাকে।
" ওগো নিঠুর দরদী, একি খেলছো অনুক্ষণ।"
  মায়ের বুকের ওম নিয়ে যে শিশুটির পরম নিশ্চিন্তে ঘুমানোর কথা সেই মা নিজেই আজ চির ঘুমের দেশে অচেতন। একবার ঘুমিয়ে পড়লে সেই ঘুম থেকে আর কেউ জেগে উঠেনা। বাবার স্নেহ - ভালোবাসা কি জিনিস, তা  শিশুটি এই জীবনে কখনোই জানালোনা,  বুঝলোনা। মাতৃদুগ্ধের অমিয় স্বাদ সে পেলোনা। অপয়া, অলক্ষী - এ নামগুলি হয়তোবা সারাজীবন তাকে বহন করতে হবে।
ব্যতিক্রমও হতে পারে। মানবতার কোনো দূত হয়তো এগিয়ে আসবেন। পরম মমতায় শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে নেবেন। তার কপালে চুমু খেয়ে বলবেন, "আজ থেকে আমি তোমার মা।" ছোট্ট ফিডারে দুধ ভরে দেবেন আর সেটাকেই অমিয় সুধা ভেবে শিশুটি চুকচুক করে তা পান করবে। তারপর একসময় যখন সে বড় হবে, বুঝতে শিখবে অথবা জানবে যে তার মা- বাবা দুজনেই তার জন্মের দিন মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন তখন কি তার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করবেনা? তার কি মনে হবেনা যে, মা-বাবার সাথে তার নিজেরও কেনো মৃত্যু হলোনা? ট্রাক চালক কেনো তাকেও নিষ্পেষিত করে গেলোনা? এসব প্রশ্ন সে হয়তো মনে মনে আওড়াবে আর বিধাতা কি তখন বিচলিত হবেননা?  তাই কি নজরুল লিখেছিলেন --
"খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে "
করোনা মহামারীর করাল গ্রাসে আমাদের  জনজীবন বিপর্যস্ত ছিলো।  তবে, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে সড়ক দুর্ঘটনা যে করোনা মহামারীর চেয়েও ভয়াবহ তা স্পষ্ট প্রতীয়মান।  করোনা হলে রোগী টের পায়, ব্যবস্হা নিতে পারে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা! সে তো কোনো আগাম বার্তা দেয়না। মুহূর্তেই একটা পরিকল্পনা, একটা স্বপ্ন, একটা সাজানো গোছানো পরিবার তছনছ হয়ে যায়। সড়কের পিচ ঢালা পথে রক্তের গঙ্গা বয়ে যায়। পত্রিকায় খবর ছাপা হয় , টিভি-রেডিওতে সম্প্রচার হয়। চালক পালিয়ে যায় আবার কখনো কখনো ধরা পড়ে। ধরা পড়লে প্রচলিত আইনে শাস্তি হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা সড়ক অবরোধ করে রাখে; আমজনতা ভোগান্তির শিকার হয়। আবার যানবাহন ভাংচুরের ঘটনাও ঘটে। রাষ্ট্রের সম্পদ বিনষ্ট হয়। পরদিন হয়তো নতুন কোনো দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়; ততক্ষণে আবার গতদিনের দুর্ঘটনার খবর আড়াল হয়ে যায়। সড়ক যেনো এক মৃত্যুকূপ!
তাহলে কি কারোর কিছুই করার নাই?  অবশ্যই সকল সমস্যার সমাধানও আছে। ফিটনেসবিহীন যানবাহন যেনো সড়কে চলাচল করতে না পারে সে  ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। চালককে দক্ষ হতে হবে, বেপরোয়া যানবাহন চালানো যে কোনো মূল্যে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, নির্দেশিত গতিসীমা মেনে গাড়ি চালাতে হবে, ঘুমঘুম অবস্থায় গাড়ি চালানো যাবেনা, নিয়মবহির্ভূত ওভারটেকিং পরিত্যাগ করতে হবে। অন্যদিকে পথচারী হিসেবে আমাদের দায়টাও কিন্তু কম নয়। খুব নিকটেই ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও শুধু সময় বাঁচাতে গিয়ে অথবা সচেতনতার অভাবে আমরা বিপদজনক ভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পারাপার করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হই। যার পরিণতি কখনো কখনো মৃত্যু অথবা আজীবনের জন্য বিকলাঙ্গ হয়ে অভিশপ্ত জীবন যাপন করা।
আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে, আমাদের জীবন শুধু আমাদের একার জীবন নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক জীবন, মূল্যবান বিনিয়োগ, বহু অঙ্গীকার, কতো কতো  স্বপ্ন আর সেসব স্বপ্ন বাস্তবায়নের সম্ভাবনা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ।