অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ||
কালের
বিবর্তনে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রে নারী পুরুষ
বৈষম্য কিছুটা হলেও হ্রাস হয়েছে কিন্তু নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবার সমূহে
এখনো নারীরা নিদারুন পুষ্টিহীনতায় ভূগছে। শুধুমাত্র ঘরে থাকা নারীরা নয়
অধিকাংশ নারী উপার্জনক্ষম হলেও, পরিবারের পুরো ব্যয়বার বহন করলেও নিজেদের
স্বাস্থ্য সম্পর্কে চিন্তা করার সুযোগ হয়ে উঠে না। নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে
চিন্তা করাটাকে একরকম বিলাসিতা মনে করেন। দৈনিক ১০-১২ ঘন্টা কর্মক্ষেত্রে
পরিশ্রম করার পরও ঘরে এসে অনেক কাজ করতে হয় কিন্তু পরিবারের চাহিদা মেটাতে
যেখানে হিমসিম খেতে হয় সেখানে নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করার সুযোগই বা
থাকে কোথায়। সাধারণ যে স্বাস্থ্য সমস্যায় নারীরা ভোগেন তা হচ্ছে
রক্তশূন্যতা। এজন্য লৌহ জাতীয় খাদ্য বেশী খাওয়ার জন্য চিকিৎসকেরা পরামর্শ
দেন। অনেকক্ষেত্রে রক্ত দেয়ারও পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু এই দূর্মূল্যের
বাজারে লৌহজাতীয় পুষ্টিকর খাবার যোগাঢ় করাও অসম্ভব ব্যাপার। বেশির ভাগ
নারীরা এখন গার্মেন্টে কাজ করে। বসে বসে কাজ করতে কোমরের হাড্ডি ক্ষয় হয়ে
যায়। আবার রান্না করেও পরিবারের অন্যদের খাওয়াতে হয়। আগে কখনো পারেনি নিজে
ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’ যুক্ত খাবার খেতে। আর এখন উচু দামে চাল কিনে কখন
বা কি দিয়ে কিনবে ভিটামিন ‘ডি’ যুক্ত খাবার / পুষ্টিকর খাবার চিন্তা করাই
অসম্ভব। প্রসবকালীন সময়েও ভাল খাবার খেতে পারে না।
নারী শ্রমিকদের আয়ে
পুরো সংসার চলছে তাদের অর্থনৈতিক অবদান থাকা সত্ত্বেও চরম অপুষ্টিতে ভোগেন
রোজগারী নারীকূল। বেশির ভাগ নারীদের শরীর ভেঙ্গে পড়ে । বিভিন্ন জটিল রোগে ও
পুষ্টিহীনতায় ভূগেন তারা। এছাড়া অল্পবয়সে এবং অপরিকল্পিতভাবে
অন্ত:স্বত্ত্বা হওয়ার কারনে এ পুষ্টিহীনতার প্রভাব আরো প্রকট হয়ে উঠে।
অধিকাংশ নারী শ্রমিকের চেহারায় একটি ক্লান্তির ছাপ থাকে। এছাড়াও সেই চিরায়ত
নারী সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে স্বাভাবিক চিন্তা করতে একেবারেই নারাজ।
পরিবারের অন্য সবাই যে খাবার খায়, অভাব অনটন এবং তাদের সেই চিন্তার জন্য
তারা তার চাইতেও কম খাবার খেয়ে থাকেন। এছাড়া অতিরিক্ত পরিশ্রম থেকেও
পর্যাপ্ত খাবারের চাহিদা পূরন করতে না পারায় অতিঅল্প সময়ে দূরারোগ্য
ব্যাধিতে আক্রান্ত হন।
ভালো পানি পাওয়ার জন্য যতটুকু গভীরে টিউবওয়েল
বসানো দরকার সেটা বসানোর টাকা বা সামর্থ নারীদের নেই। পুকুর বা অন্য উপায়ে
তারা তাদের সবরকমের কাপড় চোপড় ধুতে পারে না সামাজিক কারনে। অথচ পিল খেয়ে
পিরিয়ড বন্ধ করে রাখার কারনে তাদের স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে কনডম বা পিল দেয়া হলেও
কমদামে প্যাড দেয়ার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। দেশে দেশে নারীদের জলবায়ু
পরিবর্তনের উপর প্রভাবকে আলাদা করে সমাধানের প্রতি যথেষ্ট উদাসীনতা লক্ষ্য
করা যায়। বরং পরিবেশ নিয়ে যারা কাজ করে তাদেরকে লড়াই অব্যাহত রাখতে হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনে যেহেতু নারীকেই সবচেয়ে বেশী কষ্ট ভোগ করতে হয় তাই এ
লড়াইয়ের তাৎপর্যও নারীদের কাছে অনেক। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে নারীর
সংগ্রাম আসলে আজ প্রথার বিরুদ্ধে ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে নারীর
সংগ্রাম। পরিবেশ বিপর্যয়ের মূলেই রয়েছে সামাজিক অনাচার ও ক্ষমতাশীল
প্রভাবশালীদের প্রভাব। যারা দেশে দেশে কর্পোরেট কোম্পানী স্থাপন করে, যারা
নামে বেনামে চুক্তি করে বিভিন্ন প্রকল্প স্থাপন করে পরিবেশের ধ্বংশ ডেকে
আনে। এই সকল সামাজিক অনাচার সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে একটা সুস্থ পৃথিবীর
লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে অবিরাম। পরিবেশ বাঁচলে আমরাও বাঁচবো, নয়ত একদিন
আর বাসযোগ্য থাকবে না এ পৃথিবী।
সারা বিশ্বে বর্তমানে সুইডিস কিশোরী
গ্রেটা থুনবার্গ পরিচিত জলবায়ুকর্মী। গ্রেটা মাত্র ১৫ বছর বয়সেই নেমেছিল
রাজপথে। গোটা ইউরোপের ছাত্ররা তার নেতৃত্ব মেনে ছিল সেই সময়ে। থুনবার্গ
খুবই মনযোগী এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। কখনো অন্যায়ের সাথে আপোস করেননি। যখন
সকল রাজনৈতিক কর্মী ও মিডিয়া আপস করার নতুন নতুন ফর্মূলা তৈরি করেছিল তখন
থুনবার্গ লড়াই করেছে দৃঢ়ভাবে। সকল সময় সকল অবসস্থায় মানুষের পক্ষে কথা
বলেছে। ভাল কাজের সমালোচনারুপ থুনবার্গকেও অসংখ্য সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু
হতে হয়েছে। কেউ কেউ তার সকল লড়াই সংগ্রামকে নিজের স্বার্থ বলে তাকে ছোট
করার চেষ্টা করেছে। তাকে এনজিও’র দালাল বলে মূর্তিমান করার চেষ্টা করেছে
যাতে সে ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু থুনবার্গ মনে করে একটি গুরুত্বপূর্ণ
গণআন্দোলনকে প্রচার করতে সে সাহায্য করেছেন। পরিবেশ আন্দোলন গড়ে তোলা একার
কাজ নয় লাখো মানুষের কাজ। শুধু থুনবার্গ নয় সারাবেিশ্ব নারীদের আজ নিজ
প্রয়োজনেই এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত আন্দোলন করতে
হচ্ছে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও সদস্য, কেন্দ্রিয় কাউন্সিল, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।