ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
কুমিল্লায় মসলিনের সুতা তৈরীতে কাজ করছে দুই শতাধিক নারী
তানভীর দিপু
Published : Thursday, 11 August, 2022 at 12:24 PM
কুমিল্লায় মসলিনের সুতা তৈরীতে কাজ করছে দুই শতাধিক নারীপুনর্জন্ম পাওয়া বাংলাদেশের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য মসলিন শাড়ির সুতা তৈরী হচ্ছে কুমিল্লায়। সম্প্রতি খাদির উত্তরসূরীদের হাতেই তৈরী হচ্ছে মসলিনের সুতা। ২০২০ সালে যে ঢাকাই মসলিন জিআই বা ভৌগোলিক নির্দেশক স্বত্ব হিসেবে পরিচয় পায় তার প্রধান কাঁচামাল সুতা তৈরিতে কাজ করছে কুমিল্লার চান্দিনা ও দেবিদ্বার উপজেলার দুই শতাধিক নারী। এসব সুতার কারিগরদের অধিকাংশই আগে খাদি কিংবা অন্য সুতা কাটার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন।  বাংলাদেশ পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় মসলিন সুতা তৈরীর প্রকল্পে প্রশিক্ষিত ২২৬ নারী এই মিহি সুতা তৈরী করছেন প্রতিদিন। চতুর্দশ শতকের বাংলাদেশের সোনারগাঁ অঞ্চলে তৈরী মসলিনের খ্যাতি ছিলো বিশ্বজোড়া, জানা গেছে- মসলিন এতটাই মিহি বা সূক্ষ্ম ছিলো যে একটি শাড়ি আংটির ভেতর দিয়ে সহজেই আনা নেয়া করা যেত। মোঘল আমলের এই পন্য ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে বেশ আলোচিত ও সমাদৃত ছিলো।  
‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার’ প্রকল্প পরিচালক মোঃ আইয়ুব আলী বলেন, বাংলাদেশে চরকায় হাতে সুতা কাটা হয় কোথায়- এই বিষয়টি খুঁজতে গিয়ে পেয়েছি কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার রামপুর গ্রামের নারীরা এই মিহি সুতা কাটেন। পরে স্থানীয় চান্দিনার সোনাপুর ও দেবিদ্বারের রামপুর গ্রামের নারীদের ৪০ জনকে বাছাই করে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাদের মধ্যে ৬ জনকে বাছাই করে অন্যান্যদের প্রশিক্ষনের জন্য রাখা হয়েছে।
খাদির উত্তরসূরিরাই মসলিনের সুতা তৈরী করছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প পরিচালক বলেন, তারা যে মসলিনের উত্তরসূরি নয়, তা কিভাবে বলা যাবে! কারণ একসময় ঢাকা-কুমিল্লা অঞ্চলের এসব এলাকাগুলোতে মসলিনের সুতা তৈরীর প্রচলন ছিলো। এমনও হতে পারে তারা মসলিনেরই উত্তরসূরি!
সরেজমিনে চান্দিনা উপজেলার সোনাপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশেই সোনাপুর গ্রামের চারতলা ভবনের তৃতীয় তলায় ৫০ জন নারী একসাথে চরকায় সুতা কাটছেন। প্রকল্প থেকে দেয়া ফুটি কার্পাস তুলা থেকে চরকায় সুতা কাটছেন নারীরা। তাদের সবার বাড়ি চান্দিনা ও দেবিদ্বার উপজেলার পাশাপাশি গ্রামগুলোতে। এসব নারীদের অনেকেই খাদি বা অন্য সূতা তৈরীর কাজেও নিয়োজিত ছিলেন। পরে তাদেরকে বাছাই করে যারা মিহি সুতা কাটতে পারেন তাদের নিয়ে আসা হয় প্রকল্পের আওতায়। সোনাপুর এবং তার পাশর্^বর্তী রামপুর গ্রামের ৪টি স্থানে এই সুতা উৎপাদনের কাজ চলছে।
সোনাপুর প্রকল্পের সুপারভাইজার নাজমা আক্তার বলেন, এখন যারা মসলিনের সুতা তৈরী করছেন তারা একসময় মোটা সুতা কাটতেন। ১১০/১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতেন। পরে আমরা ৬ জন আগে মসলিনের সুতা কাটতে প্রশিক্ষণ নিয়েছি, পরে তাদেরকে এনে মসলিনের সুতা কাটার কাজে লাগিয়েছি।
মসলিন সুতার কারিগর তাসলিমা আক্তার বলেন, আমি আমার মায়ের কাছ থেকে চরকায় সুতা কাটা শিখেছি। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করে আর স্কুলে যাইনি। পরে মসলিনের সুতা কাটা শিখেছি এবং এখন সুতা তৈরী করছি।
আগে টেইলার্সে কাজ করা বিলকিস আক্তার জানান, প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত আমরা কাজ করি। ঢাকা থেকে স্যাররা এসে যে তুলা দিয়ে যায়- সেই তুলা দিয়েই আমরা সুতা কাটি। শুরুতে ১০০ টাকা রোজ কাজ করতে হয়েছে, এখন ২৫০ টাকা রোজ কাজ করি।
পূর্বে খাদির সুতা তৈরীতে অভিজ্ঞ জাহানারা বেগম বলেন, এখানে যারাই কাজ করছে তারা খুব আনন্দের সাথে কাজ করছে। সবাই এখন মসলিনের সুতা তৈরী করতে পারছে। আমরাও খুশি এই তুলা থেকে সুতা তৈরী করতে পেরে।      
কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চান্দিনা ও দেবিদ্বারে মসলিনের সুতা কাটা সুপারভাইজাররা ছাড়া আর কেউই মসলিন শাড়ি নিজের চোখে দেখে নি। কিন্তু তারা খুবই আনন্দিত যে বাংলাদেশের ঐতিহ্য একসময়ের সবচেয়ে দামি ও মিহি সুতার শাড়ি তৈরীতে অবদান রাখতে পেরে। তবে তারা জানান, সরকারিভাবে যদি আরো ভালো মজুরি ও সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় তাহলে আরো অনেকেই আসবেন মসলিনের সুতা তৈরীর কাজে।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান জানান, মসলিন এবং খাদি পুনরুদ্ধারে সরকারি যে কোন নির্দেশনা প্রতিপালন করতে সচেষ্ট আছে কুমিল্লার প্রশাসন। কুমিল্লা থেকে উৎপাদিত মসলিনের সুতা দিয়ে তৈরী শাড়ি রপ্তানির সম্ভাবনাও দেখছে সরকার।
‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার ’ প্রকল্পের আওতায় ছয় বছর গবেষণার পর ২০২০ সালে ছয়টি ঢাকাই মসলিন শাড়ি তৈরি করা হয়। আগামীতে এই শাড়ি সর্বসাধারণের জন্য বাজারে আনা সম্ভব হতে পারে। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকাই মসলিনকে জিআই ( ভৌগোলিক নির্দেশক) স্বত্বের অনুমোদন দেয়া হয়।  ফুটি কার্পাস নামক তুলা থেকে প্রস্তুতকৃত অতি চিকন সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি করা হত। চড়কা দিয়ে কাটা, হাতে বোনা মসলিনের জন্য সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হত যার ফলে মসলিন হত কাচের মত স্বচ্ছ। এই মসলিন রাজকীয় পোশাক নির্মাণে ব্যবহার করা হত। মসলিন প্রায় ২৮ রকম হত যার মধ্যে জামদানী এখনও ব্যাপক আকারে প্রচলিত। নানা কারণে আঠারো শতকের শেষার্ধে বাংলায় মসলিন বন্ধ হয়ে যায়।