ভিশন-২০৩০ এর আওতায় সৌদি আরবে শ্রম আইন সংস্কার করা হয়েছে। এখন থেকে দেশটিতে কাজ করা নারী শ্রমিকেরা পুরোনো চাকরিদাতার অনুমতি ছাড়াই নতুন জায়গায় কাজে যোগ দিতে পারবেন।
আগের আইনে গৃহকর্মীদের না জানিয়েই মালিকানা পরিবর্তন করা হতো। গৃহকর্মী নতুন জায়গায় যেতে না চাইলেও উপায় ছিল না। এখন নতুন আইনের তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। নারী শ্রমিকরা না চাইলে সেখানে তাকে পাঠানো যাবে না। আইনের এই পরিবর্তনের ফলে কতটা সুবিধা পাবে বাংলাদেশের নারী কর্মীরা?
বাংলাদেশের অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা আইনের এই পরিবর্তনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও সুবিধা পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, শুধু আইন পরিবর্তন হলেই হবে না। আইন বাস্তবায়নে তারা কতটা মনোযোগী সেটাও দেখতে হবে। বাংলাদেশ থেকে নারীদের পাঠানোর আগে এই বিষয়গুলোতে সম্যক ধারণা দিতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের দূতাবাস ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকেও ইতিবাচক হতে হবে।
সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীদের নির্যাতনের বিষয়টি বিশ্বজুড়েই আলোচিত। বিভিন্ন দেশ থেকে গৃহকর্মী হিসেবে যারা কাজ করতে দেশটিতে যান, তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন। অনেকে যৌন নির্যাতনের শিকারও হন। তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ফিলিপাইন্সসহ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশের দরিদ্র নারী।
ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরীফুল হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘সৌদি আরবে গত কয়েক বছর ধরেই আইনের সংস্কার হচ্ছে। আইনের এই সুবিধা পেতে আমাদের কর্মীদের বেশ সময় লাগছে। সৌদি আরবে আগেও বলা হয়েছে, পুরুষ কর্মীরা চাইলে তাদেরও কাজ পরিবর্তন করতে পারবেন। এই পরিবর্তনটা কিন্তু খুব জটিল প্রক্রিয়া। আমাদের নারী কর্মীরা যারা যান তাদের পক্ষে আগের নিয়োগকর্তাকে ছেড়ে নতুন নিয়োগকর্তাকে খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। কারণ তার শিক্ষা, যোগ্যতা, দক্ষতা খুব বেশি থাকে না। ফলে এর পুরোটাই নিয়োগকর্তা বা এজেন্সি নির্ভর। আইনে সুবিধা দেখালেও আমাদের নারীরা এই আইনের সুবিধা নিয়ে রাতারাতি বিরাট কোনো পরির্তন চলে আসবে বলে আমার কাছে মনে হয় না।’
ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের বাইরে প্রায় ৯ লাখের মতো নারী কাজ করছেন। এদের অর্ধেকই সৌদি আরবে। ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশের নারীরা কাজ করতে সৌদি আরবে যাওয়া শুরু করেছেন। সে হিসেবে গত ৭ বছরে ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ নারী বর্তমানে সৌদি আরবে কাজ করছেন।
সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজের সভাপতি অধ্যাপক ইসরাত শামীম বলেন, ‘সত্যি সত্যি কী তারা আইনের বাস্তবায়ন করবে? আমাদের নারী কর্মীরা কী একজনের কাজ ছেড়ে অন্য জায়গায় চাকরি নিতে পারবে? এটা দেখতে হবে। না দেখা পর্যন্ত আমরা এটা নিয়ে কিছু বলতে পারবো না। কত কিছুই তো আইনে আছে, বাস্তবে কী তারা সেই সুযোগ পাচ্ছে?’
‘এমওইউতে যা লেখা আছে, সেটাই তো তারা মান্য করে না। যদি বাস্তবায়ন করে তাহলে খুব ভালো। মধ্যপ্রচ্য আন্তর্জাতিক কনভেনশনেই তো স্বাক্ষর করে না। তারা কোনো কমিটমেন্ট রাখে না। দেখেন জাপানে আমাদের নারীরা যাচ্ছে, তারা আইনটা কীভাবে ফলো করছে। কোরিয়ায় যাচ্ছে, কত সুন্দর ব্যবস্থা। সেখান থেকে যে ফিরে আসছে, সেটাও কত সুন্দরভাবে। এক হাউস থেকে অন্য জায়গায় গেলে যে আবারও নির্যাতনের শিকার হবে না, সেটা কে বলবে? এই যে তারা পাসপোর্ট নিয়ে নেয়, এটা কোন আইনে তারা নেয়?’
সৌদি গ্যাজেটের খবরে বলা হয়েছে, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ভিশন-২০৩০ আওতায় দেশটির নানা খাতে সংস্কারের নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন। শ্রম আইনে পরিবর্তনও এর অংশ। সৌদি আরবের শ্রম মন্ত্রণালয় আইনে যে যে পরিবর্তন এনেছে, তার আওতায়, ঠিকমতো বেতন-ভাতা না দিলে বা বিপজ্জনক কাজে নিয়োজিত করলে গৃহকর্মীরা এটা নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগও করতে পারবেন। এছাড়া কর্মীর অনুমতি ছাড়াই চাকরিদাতা যদি তাকে অন্য ব্যক্তির কাজে নিয়োজিত করেন এবং শিক্ষানবিশ সময়ে যদি চাকরির চুক্তি বাতিল করেন, তাহলে কর্তৃপক্ষ ওই নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, সৌদি আরবে আইনে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে সেটাতে আমাদের নারী কর্মীদের সুরক্ষা করবে কি-না সেটা এখন বড় আলোচনার বিষয়, কারণ সেখানে চাকরির স্থান বদলের সুযোগ নারীরা পেলেও চাকরি দাতাদের মানসিকতার বদল না হলে কোথাও তারা শাস্তিতে কাজ করতে পারবেন না। আগের আইনই তো চাকরিদাতারা মানেন না। আমাদের নারীদের ভাষাগত সমস্যা রয়েছে। ফলে আইনে তাকে যে সুবিধা দেবে সেটা সে নিতে পারবে কি-না সেটাও বড় প্রশ্ন।
সৌদি আরবের মানবাধিকার কমিশনের (এইচআরসি) প্রেসিডেন্ট এবং জাতীয় মানবপাচার প্রতিরোধ বিষয়ক জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান আওয়াদ আলাওয়াদ গত সোমবার বলেছেন, ‘ভিশন-২০৩০ এর আওতায় এসব সংস্কার করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে সৌদিতে বিদেশি কর্মীদের চাকরি বদল ও চলাচলের স্বাধীনতা আরও বাড়বে।’
সৌদি আরবের আইনের আওতায় গৃহকর্মীদের সুরক্ষা দেওয়া হবে। এদিকে এইচআরসি এক বিবৃতিতে বলেছে, এসব সংস্কারের উদ্যোগ সৌদি আরবের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দীর্ঘস্থায়ী মনোযোগের প্রতিফলিত।
বিদেশে যাওয়া নারীদের নিয়ে কাজ করা সবুজের অভিযান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মাকসুদা বেগম বলেন, শুধু আইন করলে তো হবে না, এটা আমাদের সরকারের মাধ্যমে জানাতে হবে। আমাদের জনশক্তি, কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মাধ্যমে সবগুলো এজেন্সিকে জানাতে হবে। দেশে একটা প্রচারণা থাকতে হবে। তাহলে যারা ফিরে এসেছেন তারা আবার নতুন করে যাওয়ার ইচ্ছা দেখাতে পারে। নতুন করে যারা যাবে তাদের এই আইন সম্পর্কে জানাতে হবে।
‘যারা পাঠায় তারা তো আইনের কথা বলে না। এসব আইনের বিষয়ে শুধু আমরা যারা কাজ করি তারাই জানি। ফলে আইন হলেই যে নারী কর্মীরা উপকার পাবেন সেটা ঠিক না। তাদের সেভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, ভাষা শেখাতে হবে তারপরই তারা সুবিধা পাবেন। পাশাপাশি আমরা বিদেশ থেকে ফিরে আসা নারী কর্মীদের নিয়ে গবেষণা করে দেখেছি, ৮০ ভাগ নারী জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো-বিএমইটিকে না জানিয়েই দালালের মাধ্যমে বিদেশে যাচ্ছে, ফলে তারা নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছেন। কল্যাণপুরের একটি বস্তিতে আমরা গবেষণা করে দেখেছি, সেখানে গত ৬ মাসে যত নারী বিদেশে গেছেন তাদের ৯৫ ভাগই দেশে ফিরে এসেছেন।
সূত্র: ডয়চে ভেলে