বিশ্ববাজারের
পরিস্থিতি বিবেচনায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি অনেকটা প্রত্যাশিত ছিল।
করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট উচ্চ
মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় নাগরিকদের ওপর যখন বড় চাপ
তৈরি হয়েছে, সে মুহূর্তে জ্বালানি তেলের ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির
সিদ্ধান্ত সবাইকে হতবাক করেছে।
ডিজেলের মতো জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির
প্রভাব সর্বব্যাপী। সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা পড়ে গণপরিবহন ও পণ্য পরিবহনের
ভাড়ায়। জ্বালানির দাম বাড়ানোকে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা একটা সুযোগ হিসেবে
নেন। ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে দেন ভাড়া।
৫ আগস্ট মধ্যরাতে জ্বালানির রেকর্ড
মূল্যবৃদ্ধির পরও সেই আগের হতাশাজনক চিত্রের পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ
মন্ত্রণালয় বিশ্ববাজারের সঙ্গে দাম সমন্বয়ের কথা বললেও তাদের কাছে দাম
সমন্বয়ের কোনো ফর্মুলা বা সূত্র নেই। একইভাবে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পর
পণ্য পরিবহন ও গণপরিবহনের ক্ষেত্রেও ভাড়া সমন্বয়ের বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো
সূত্র নেই।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বাসভাড়া সমন্বয়
করে। এবার জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ধারণা দেওয়া হয়েছিল, বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে
সর্বোচ্চ ২৯ পয়সা ও লঞ্চভাড়া ৪২ পয়সা বাড়তে পারে। কিন্তু বিআরটিএ
দূরপাল্লার বাসের ক্ষেত্রে এ হিসাবের চেয়ে কিলোমিটারপ্রতি ১৩ পয়সা ও নগরে ৬
পয়সা বেশি বৃদ্ধি করেছে। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, ঢাকার বাসমালিক ও
শ্রমিকেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিআরটিএর বেঁধে দেওয়া ভাড়ার চেয়েও যাত্রীদের
কাছ থেকে বেশি ভাড়া নিচ্ছেন।
এর আগে গত বছরের নভেম্বরে ডিজেলের দাম ২৩
ভাগ বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় বাস, ট্রাক, লঞ্চের ভাড়া ও পণ্য পরিবহনের খরচ
বাড়ানো হয়েছিল ২৮ থেকে ৪৩ ভাগ পর্যন্ত। অথচ বাস-ট্রাক বা পরিবহনের যে ভাড়া,
তাতে জ্বালানির অংশ মাত্র ৪০ ভাগের মতো। সে হিসাবে ভাড়া ১০ থেকে ১৫ ভাগের
বেশি বাড়ার কথা নয়।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, জ্বালানি তেলের
মূল্যবৃদ্ধির পর নানা গোঁজামিলের ব্যয় যোগ করে ভাড়া বৃদ্ধি করে বিআরটিএ।
বাসের সংস্কার, দুর্ঘটনা ঝুঁকি ব্যয়, গ্যারেজ ও টার্মিনাল ভাড়া,
রক্ষণাবেক্ষণ, ঋণের সুদ ও বিনিয়োগ, মজুরি ও বোনাসের মতো ব্যয় যুক্ত করা হয়।
ব্যয়ের
এ খাতের বাস্তবে কোনো ভিত্তি নেই। ভাড়া বাড়ানোর সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের
ক্ষেত্রে একচ্ছত্র প্রভাব থাকে পরিবহনমালিকদের। সড়ক ও নৌপথে পণ্য পরিবহনের
ক্ষেত্রেও ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকা পর্যন্ত
গাড়িপ্রতি যেখানে জ্বালানি খরচ বেড়েছে ২ হাজার ৪০ থেকে ২ হাজার ৩৮০ টাকা,
সেখানে পরিবহন কোম্পানিগুলো ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা বেশি ভাড়া
নিচ্ছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকারি কর্তৃপক্ষ ও পরিবহনমালিক মিলে
প্রকৃত ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে অতিরিক্ত ভাড়া ও ব্যয়ের বিশাল বোঝার সবটাই
ভোক্তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু চাপ সহ্য করার ক্ষমতা নিশ্চয়ই অসীম নয়।
জ্বালানি
তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং এর প্রতিক্রিয়ায় গণপরিবহন ও পণ্য
পরিবহনে ইচ্ছেমতো ভাড়া বৃদ্ধির যে নৈরাজ্যকর ও হতাশাজনক চিত্র, তাতে
সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েই বড় প্রশ্ন ওঠে। সরকারের
নিয়ন্ত্রক ও তদারকি সংস্থাগুলো তাহলে কী কাজ করছে? গণপরিবহন ও পণ্য পরিবহন
ভাড়ায় যে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, তা বন্ধে তদারকি সংস্থাগুলোকে
অবশ্যই একযোগে মাঠে নামতে হবে।