জুলফিকার নিউটন ||
শিল্পী মুর্তজা বশীরের ৯০তম জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ
আমার প্রিয় শিক্ষক ও শিল্পী মুর্তজা বশীর (১৭ আগষ্ট ১৯৩২- ১৫ আগষ্ট ২০২০) প্রধানত ইউরোপিয়ান ঐতিহ্যের মধ্যে কাজ করেছেন। পৃথিবীর শিল্পের ইতিহাসে ইউরোপিয়ান পেইন্টিং রেনেসাঁ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত, শরীর সম্বন্ধীয়। এর একটা দিক হচ্ছে ইন্দ্রিয়ঘনতা, অন্য একটা দিক হচ্ছে জীবনের মধ্যে শরীর খোঁজা। পেইন্টিংয়ের এই ভাষার জন্ম হয়েছে ইতালিয়ান রেনেসাঁর বৈজ্ঞানিক কৌতূহল থেকে এবং হল্যান্ড বেলজিয়ামের ব্যবসায়িক বাস্তবতা থেকে। এ ভাষা নির্মিত হয়েছে স্বাভাবিক প্রতিভাসের বিশ্বাসযোগ্যতা ঘিরে এবং ত্রি-আয়তনিক বাস্তবতা ঘিরে। মর্তুজা বশীর এসবের মধ্য দিয়ে শরীর সম্বন্ধীয় মানবতাবাদের দিকে অগ্রসর হয়েছেন। জীবন্ত মানুষী শরীর জিজ্ঞাসার কেন্দ্র, এ জিজ্ঞাসার চারপাশে মর্তুজা বশীর তার বিষয় খুঁজেছেন। মর্তুজা বশীরের ভিশন গঠিত হয়েছে ইতালিয়ান অভিজ্ঞতা থেকে। মর্তুজা বশীর এ অভিজ্ঞতা ব্যবহার করেছেন বাংলাদেশের মতো অভাবী দেশে। পেইন্টিংয়ের ভাষার অমিতাচারের পরিপ্রেক্ষিত হচ্ছে একটি গরিব দেশ। এই বৈপরীত্য তীব্র তীক্ষ, মর্তুজা বশীরের রাজনৈতিক সচেতনতাও এ বৈপরীত্য দূর করতে পারেনি। এ হচ্ছে এক বিষন্ন দেশ, এক গরিব দেশ, এ বিষন্ন দেশের আত্মাও গরিব। ইতালিয়ান পেইন্টিংয়ের অমিতাচার ও অতিরঞ্জনের মুখোমুখি করেছেন একটি গরিব দেশের বিষন্নতাকে, এখান থেকে তৈরি হয়েছে। মর্তুজা বশীরের নিজস্ব ভাষা, এই ভাষার মধ্যে আখ্যান আছে, থিয়েটার আছে এবং আছে। একটি, আরম্ভ ও একটি সমাপ্তি। তার দিক থেকে পেইন্টিং উপস্থাপিত করে স্বচ্ছ, অকল্পিত, ধারাবাহিক শারীরিকতা। শরীর যেমন প্রত্যক্ষ, তেমন ইন্দ্রিয়ঘন। শরীর, বিশেষ করে নারী-শরীর মর্তুজা বশীর উপস্থিত করেছেন কখনও প্যাসিভ সেক্স অবজেক্ট হিসেবে, কখনও সক্রিয় যৌনসঙ্গী হিসেবে, কখনও এমন কেউ, যাকে ভয় করা যায়, কখনও ঈশ্বরী হিসেবে কিংবা ভালোবাসার মানুষ হিসেবে। মর্তুজা বশীর পেইন্টিংয়ের আর্ট ব্যবহার করেছেন গভীর অতল ইন্দ্রিয়ঘন কাজ হিসেবে। তার দিক থেকে পেইন্টিং হচ্ছে একটি ইন্দ্রিয়ঘন শক। ইন্দ্রিঘন: যেখানে মানুষী শরীর এবং মানুষী কল্পনা একত্র এবং এখান থেকে শুরু হয় রহস্যময়তা। দৃশ্যমানতার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ মানুষ, পশু এবং পতঙ্গের যৌনজীবনে। রঙ, আকার এবং দৃশ্যমান ভঙ্গি সতর্ক ও আকর্ষণ করে বিপরীত লিঙ্গকে। মর্তুজা বশীরের প্রজাপতি সিরিজ তাই নয় কি? মানুষ কিংবা পশু কিংবা পতঙ্গের ক্ষেত্রে দৃশ্যমানতা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সংকেতের লক্ষ্য রিফ্লেকশন শুধু নয়, কল্পনাও।
মর্তুজা বশীরের চোখ গল্প বলার চোখ। এই চোখ বলা নিয়ে ভাবে। যা কিছু দেখেছেন জীবনের রহস্য সম্বন্ধে তার বোধ বাড়িয়েছে: এই রহস্যের আংশিক জবাব তিনি পেয়েছেন, প্রতিটি গল্প কিংবা তার শিল্পীজীবনের প্রতিটি পর্ব একটি জবাব, একটি গল্প অন্য একটি প্রশ্ন মেলে ধরে, সেজন্য তার কৌতূহলের শেষ নেই। রহস্য ছাড়া, কৌতুহল ছাড়া, আংশিক জবাবের ফর্ম ছাড়া কোনো গল্প হয় না, পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো শিল্পচর্চা হয় না। এই হচ্ছে তার পর্ব থেকে পর্বান্তরে যাওয়ার ইতিহাস : প্রত্যেকটিতে প্রবিষ্ট স্মৃতি, আত্মজীবনীর ফ্যান্টাসির খন্ড। শিল্পী হিসেবে মুর্তজা বশীর ইউরোপিয়ান পেইন্টিংয়ের ট্রাডিশনের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। তেমনি তার মানসগঠনে একটি বড় প্রভাব এসেছে মুসলিম ঐতিহ্য থেকে। ধর্মপ্রাণ পিতার প্রচĐ প্রভাব তার ওপর আছে যে প্রভাব থেকে তিনি ইসলামিক ক্যালিগ্রাফির দিকে অগ্রসর হয়েছেন। তিনি ইসলামিক ক্যালিগ্রাফির মধ্যে দেখেছেন বালুর ওপর আকাশের ভার কিংবা বালুতে পর্যবসিত হওয়ার অপেক্ষায় প্রস্তর। মরুভূমিতে মানুষ নিজের কাছে একা। আর আকাশ ও বালুর দিগন্ত প্রসারিত একই ভঙ্গিমার মধ্যে, তিনি নিজে কিন্তু নন, একেবারেই নন। এই বোধ থেকে তিনি ক্যালিগ্রাফির দিকে গেছেন এবং যে ইউরোপিয়ান পেইন্টিংয়ের ট্র্যাডিশনের মধ্যে মানুষের মহিমা দেখেছেন, সেই দেখা শূন্য হয় যখন মরুভূমির মধ্যে আকাশ ও জমির ঘনিষ্ঠতা থেকে মহাবিশ্বকে উপলব্ধি করা যায়। থাকে তখন অক্ষর, এই অক্ষরের সাক্ষী শিল্পী নিজেই এবং এই অক্ষরের শিকার তিনি নিজেই। এই চেতনার মধ্যে নিয়তির বোধ এবং আবেগের বোধ দুই-ই আছে। ক্যালিগ্রাফির মধ্যে লুকানোর জায়গা নেই, প্রত্যক্ষতা থেকে তৈরি হয় আবেগের অসহায়তা। ক্যালিগ্রাফির দিকে, মর্তুজা বশীর, অসহায় হয়ে তাকিয়ে যখন তিনি মিলিয়ে যাবেন মাটির ভেতর। তখন থাকবে কি তার অক্ষর? তার বন্দনা?
নিসর্গ মর্তুজা বশীরকে টানেনি। যেভাবে টেনেছে জয়নুল আবেদিনদের। এর অর্থ খুব, সম্ভব মর্তুজা বশীরের দিক থেকে নিসর্গের দিকে তাকানোর মানে হয় না। কিংবা কোনো দিক থেকেই নিসর্গের দিকে তাকানো যায় না। নিসর্গ ঘিরে রাখে কিন্তু কখনও সম্মুখীন হয় না। তার কাছে নিসর্গের কোনো ফোকাস পয়েন্ট নেই যার কোনো ফোকাস পয়েন্ট নেই- সে হচ্ছে স্তব্ধতার মতো। নিসর্গ থেকে নিঃসঙ্গতা তৈরি হয়: এই বোধ তাড়িত হয়ে মর্তুজা বশীর নিসর্গের ফাঁদ থেকে দূরে সরে এসেছেন। মানুষ কাঁদে, পশুপাখি কাঁদে, পতঙ্গ কাঁদে তার কোনো আকর্ষণ নেই। তিনি যখন মানুষ দেখেন কিংবা পশুপাখি কিংবা পতঙ্গ, তখন এসবই দেখেন- এসবের বাইরে কোনো কিছু তার দেখার ফোকাসকে বিশৃঙ্খল করে না। তিনি দেখেন একাগ্র হয়ে, দেখার একাগ্রতাই তার পেইন্টিং।
অন্যদিক থেকে তার আখ্যানের মধ্যে এক ধরনের ধোঁয়াটেপনা আছে। যেন একটা জাহাজ বন্দর ছেড়ে বেরিয়েছে। এই বের হওয়া কি অ্যাডভেঞ্চার কিংবা বিদায়? বন্দরের দিক থেকে মুড প্যাসিভ; জাহাজের মুখ থেকে মুড অ্যাকটিভ। প্রথমত, ধোঁয়াটেপনা, পরে প্রত্যয়দীপ্ত। মর্তুজা বশীর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে। এভাবে তিনি ধোয়াটেপনা ছেড়ে আসেন। এভাবে একটি সংলাপ তৈরি হয়।
এক আখ্যান থেকে অন্য আখ্যানের মধ্যে বেজে ওঠে তার কণ্ঠস্বর, তার বাক্য তার কাজ সম্বন্ধে। তার ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে তার কাজ ভাবা যায় না। একটা সম্পূর্ণ টেক্সট তৈরি হয়। যেন তার কাজটি কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করা। এক্ষেত্রে লেখক মর্তুজা বশীর তার জীবনের অভিজ্ঞতাকে প্রোগ্রাম করে তোলেন। তিনি তার লেখার সহজাতবোধ থেকে পেইন্টিংয়ের স্পেসকে ভরাট করেন। তার পেইন্টিং তার লেখার দিকে (কখনো কখনো বলার দিকে) তাকিয়ে থাকে, কখনো কখনো তার লেখা (এবং বলা) তার পেইন্টিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেজন্য তার কাজ তার ব্যাখ্যার অপেক্ষায় থাকে।
লেখক মর্তুজা বশীর শব্দের মহিমা উচ্চারণ করেন, তেমনি পেইন্টার মর্তুজা বশীর পেইন্টিংয়ের মহিমা উদ্দীপ্ত করেন। তার অভিজ্ঞতা লেখার মধ্যে ক্রিয়াশীল এবং তার অভিজ্ঞতার কল্পনা পেইন্টিংয়ে ক্রিয়াশীল। শব্দের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং রঙের বিশ্বাসযোগ্যতার যোগসূত্র তার অভিজ্ঞতা। বলা যায়, সাহিত্য হচ্ছে তার পেইন্টিং। আর পেইন্টিং হচ্ছে তার সাহিত্য। দু’দিক থেকেই তার অভিজ্ঞতাকে বিশ্বাসযোগ্য করার প্রয়াস ভাববার মতো। সেজন্য একটা থিমকে নিঃশেষ করার পর আর একটা থিমে তিনি প্রবেশ করেন।
মর্তুজা বশীর কি রিয়্যালিস্ট? বোধহয় নয়। তিনি তার পেইন্টিংয়ে ফিগরকে চতুষ্পর্শ্বের সঙ্গে যুক্ত করেছেন তার ব্রাশ স্ট্রোকের এনার্জি দিয়ে। এই এনার্জি তিনি রিলিজ করেছেন বিষয়ের সঙ্গে তার নিবিড় সহানুভূতির মধ্য দিয়ে। ফলে তার পেইন্টিং হয়ে উঠেছে তার ব্যক্তিক ভিশন। এই ভিশনে এক্সপ্রেসনিজম অবাধ। তিনি প্রকাশ করেছেন তার ব্যক্তিক ভিশন ব্যক্তি, বস্তু, বিষয় অবলম্বন করে। এই ধারার সেরা কাজ তার দেয়াল সিরিজ। এখানে কোনো প্রথাগত বাস্তব নেই, প্রথাগত বস্তু নেই, প্রথাগত ব্যক্তি নেই। বিভিন্ন অবজেক্টের সারফেস তিনি স্ট্যাডি করেছেন এবং বিবৃত করেছেন প্রবল আবেগ এবং প্রত্যক্ষতায়। সারফেস বর্ণিত হয়েছে। প্রতিভাস নেই এবং প্রতিভাসের মধ্য দিয়ে দেখার কিছু নেই, কারণ তার পেছনে দেখার কিছু নেই। কোনো মায়াভাস ছাড়া দৃশ্যমানকে দৃশ্যমান হিসেবে দেখা। সত্যি অন্য কোথাও আছে। ব্যাখ্যার অপেক্ষায় আছে।
মর্তুজাবশীরআমাদের দাঁড়করিয়েছেনতার চোখেরদিকে। তার চোখ, তার চোখ। মর্তুজাবশীরসবকিছুআমাদের সঙ্গে শেয়ারকরতেচান। এই শেয়ারকরারতাগিদ থেকে তার পেইন্টিংহয়ে ওঠে বিস্ফোরণ, বারুদ। আমরাবিস্ফোরিতহই, আমরাতাজাবারুদে পরিণতহই। আমাদের বদলেদিয়েতিনি দর্শকহয়েযান। তিনিআমাদের দেখান। আমরাতার চোখেতাকে দেখি। এভাবেতারকাজউন্মােচিতকরে। প্রতিভাসের পেছনকারউপস্থিতি। আমরা ও মর্তুজাবশীর, এক হয়েযাই।