ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
মুক্তিযুদ্ধা শিল্পী শাহাবুদ্দিন
Published : Monday, 12 September, 2022 at 12:00 AM
মুক্তিযুদ্ধা শিল্পী শাহাবুদ্দিনজুলফিকার নিউটন ||
শিল্পী শাহাবুদ্দিনের ৭২তম জন্মবার্ষিকীর শ্রদ্ধার্ঘ  
মুক্তিযুদ্ধ মনে হয় শিল্পী শাহাবুদ্দিনের (১৯৫০-) জীবনের একটি প্রধান ঘটনা। এই ঘটনা তার চোখকে বদলে দিয়েছে। তিনি দেখেছেন যুদ্ধের মধ্যে মানুষের শরীরের বিভিন্ন ভঙ্গি এবং ব্যবহার। এই মানুষটি মুক্তিযোদ্ধা, যেন তার শরীরে উদ্যত গতি, ক্ষিপ্রতা, সে শরীরকে চরাচরের মধ্যে আরোপিত করেছে, শরীরের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে চতুর্দিকে। শরীরের শত্রু যা কিছু শিল্পী শাহাবুদ্দিনের লড়াই তার বিরুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধা মানুষের মুক্তির জন্য চরাচরে দাপিয়ে বেড়ায়, সে জন্য তার মুক্তিযোদ্ধা নির্দিষ্ট শত্রুর বিরুদ্ধে যেমন উদ্যত তেমনি তার মুক্তিযোদ্ধার শত্রু অনির্দিষ্ট। এই নির্দিষ্টতা এবং অনির্দিষ্টতা মুক্তিযোদ্ধার শরীরে বেগ তৈরি করে। এই বেগ অ্যানাটমির নিয়ম মানে না।
তার কাজটি রিয়ালিস্টিক? জবাব ঃ হ্যা এবং না। তিনি আঁকছেন মানুষের শরীর, বার বার। এই শরীর, মানুষের শরীর পেইন্টিংয়ের পুরনো বিষয়। পুরনো বিষয়ের খোঁজে তিনি বার বার ফিরে গেছেন বিষয়টিকে নতুন করার জন্য। মানুষের শরীরের মতোন পুরনো কিছু নেই। মানুষের শরীরের মতোন নতুন কিছু নেই। পুরনোর মধ্যে নতুনের উদ্ভাবন শাহাবুদ্দিনের দক্ষতার ইঙ্গিতবহ। পুরনোর মধ্যে নতুনের উদ্ভাবন ডায়ালেকটিক্স তৈরি করে, সেই ডায়ালেকটিক্সের দরুন রিয়ালিজম সম্বন্ধে ধারণার বদল হয়। রিয়ালিজমের অর্থ কোনো ঘটনা কিংবা বিষয়ের যথার্থ প্রতিলিপি নয় রিয়ালিজম বরং উল্টো। যদি বাস্তব বৈপরীত্যপূর্ণ হয়, সেক্ষেত্রে শিল্পের সম্ভাব্য, বাস্তবতা হচ্ছে এসব বিষম বৈরী, সংঘাতময় সম্পর্কের সুকুশলী বয়ান। সে জন্য শিল্পী শাহাবুদ্দিন যুদ্ধের বাস্তব ঘটনা আঁকেন না, তিনি আঁকেন যুদ্ধ মধ্যকার সম্ভাব্য বাস্তবতা। যদি এভাবে দেখি তাহলে, বুঝি শিল্পী শাহাবুদ্দিন সত্য’র একটি মুহূর্তে মগ্ন, যে মুহূর্তটি একই সঙ্গে ঘটনার প্রত্যাখ্যান, প্রত্যাখ্যান থেকে তিনি তৈরি করেন মানুষের শরীরের অ্যাটমি বহির্ভূত গতি বা বেগ।
শিল্পী শাহাবুদ্দিনের কাজে একটা লড়াই দেখি প্রতিনিধিত্বতার বিষয়বস্তু বনাম এসব বিষয়বস্তু যে অর্থ তৈরি করে তার সঙ্গে (সে যুদ্ধ কিংবা ব্যক্তি বিশেষ যাই হোক না কেন)। এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় বিষয়বস্তুর সংজ্ঞার উৎপাদন, অর্থ এবং অবস্থান। সমাজ প্রতিষ্ঠিত কিংবা ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত সংকেত (মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ঘটনার কিংবা বঙ্গবন্ধু কিংবা মহাত্মা গান্ধী কিংবা দেশরত্ন শেখ হাসিনার প্রতিনিধিত্বমূলক অবয়ব) তিনি অনবরত বদলে দেন অন্য সংকেতের মধ্যে দর্শক চেনা চরিত্রের মধ্যে কিংবা জানা ঘটনার মধ্যে অন্য কিছু পাঠ করতে সক্ষম হয়। এই রূপান্তরণের মাধ্যম হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন মানুষের শরীর। যোগসূত্র হচ্ছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা। শাহাবুদ্দিনের আঁকা শরীর দেখে অবাক হই কিংবা ছুঁতে ইচ্ছা করে। এভাবে মানুষের কল্পনা উদ্দীপিত হয় শরীর থেকে। শরীর বাস্তবের দিকে যায় এবং জীবন্ত হয়ে ওঠে। তিনি মানুষকে বোঝার জন্য অন্বেষণ করছেন। এই অন্বেষণ প্রধানত কন্টুর কিংবা জেশ্চারের মাধ্যমে। কন্টুর কিংবা জেশ্চারের লক্ষ্য সলিড হওয়া। এই সলিড হওয়াটাকে শিল্পী শাহাবুদ্দিন হাতের মধ্যে ধরতে চান। তার শক্তির ঝোঁক হচ্ছে ক্যানভাসে কিংবা বোর্ডে শরীর যেন ধরার যোগ্য প্রতীয়মান হয়। শরীরের অস্তিত্ব, তার প্রতিভাস নয়, শিল্পী শাহাবুদ্দিনকে খুব সম্ভব মগ্ন করে। শরীরের উপস্থিতি, শরীর উৎসারিত বার্তা নয়। এই উপস্থিতির মধ্যে একটা টেনশন আছে। তার আশ্চর্য দক্ষতা, যখন তিনি সর্বোত্তম, কোনো একটি ফর্মের টেনশন করায়ত্ত করা যেন ভিতর থেকে অ্যানার্জি ফুটে বের হচ্ছে এবং একই সঙ্গে এই ফর্মটিকে আশ্চর্য করে তোলা। অ্যানার্জির এই প্রকাশ এবং আশ্চর্য করা তার উপস্থাপিত শেখ মুজিব, গান্ধী, শেখ হাসিনা, এসব মুক্তিযোদ্ধা কিংবা একাধিক মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে উপস্থিত । তিনি উদ্ভাবক, তার কাজে এনেছেন টেকটাইল অভিজ্ঞতার একটি নতুন দিক, আবার একই সঙ্গে তিনি ঐতিহ্যানুযায়ী। এভাবেই তিনি যা করতে চান, করতে পারছেন।
শিল্পী শাহাবুদ্দিন যা করতে চান কিংবা তার ভিতরকার দানব তাকে দিয়ে যা করিয়ে নেয়: মানুষী শরীরের ধ্রুপদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে স্পেস তৈরি করা। তিনি তা করছেন গতি, বেগ অ্যানাটমির নিয়ম না মানার মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে তার মিল লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি কিংবা মাইকেল এঞ্জেলো কিংবা পিটার পল রুবেন্সের সঙ্গে। এদের তিনজনের তিনটি কাজের উল্লেখ করছি আমার বক্তব্যের সমর্থনে। লিওনার্দোর আনগিয়ারি যুদ্ধের স্ট্যাডিজগুলো আমি উইন্ডসর ক্যাসেলের রয়েল লাইব্রেরিতে দেখেছি। এই স্ট্রাডিজগুলোতে লিওনার্দো কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুষঙ্গতা বাদ দিয়েছেন কল্পনাকে উদ্দীপিত করার জন্য, রেনগর মধ্যে স্তুত গতি এনেছেন কদমে। চলা ঘোড়ার ওপর বসা ফিগরটির ঘূর্ণায়মান ক্লোকের ইঙ্গিত স্পষ্ট করার জন্য। তার লক্ষ্য কল্পনাকে স্পেসের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া, রেখাকে দ্রুত করা, রেখার দ্রুততায় উদ্দীপিত একই সঙ্গে অশ্ব, অশ্বারোহী এবং অশ্বারোহীর ক্লোক। সে জন্য কি তিনি বলেছেন, বিষয়ের বিভ্রান্তিই উদ্দীপিত করে মন ও চোখ। অক্সফোর্ডের অ্যাসমোলিয়ান মিউজিয়ামে মাইকেল এঞ্জেলোর যুদ্ধদৃশ্য নামক একটি কাজ দেখেছি। এই কাজটিতে তিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গতির মধ্যে একটি শরীরের কাঠামোকে ধরেছেন। তাৎক্ষণিকতার মধ্যে শরীরের গতি, প্রতিটি স্ট্রোকে দীপ্ত মাইকেল এঞ্জেলোর মগ্নতা। তার হাত মানছে তার চোখের শাসন। পিটার পল রুবেন্সের হারকিউলেস এবং মিনার্ভার মারসকে প্রতিহতকরণ কাজটি আমি দেখেছি লুভ মিউজিয়ামে। ফিউরিদের পলায়নপর একটি ফিগর শুধু রেখাচিত্র, যেমন কি যুদ্ধের শিকার বিভিন্ন শরীর, জননীকে আঁকড়ে আছে একটি শিশু এবং একটি বাচ্চার মাথা। তিনি ব্যবহার করেছেন সাদা পিগমেন্ট, এই পিগমেন্ট আলোকের আভা তৈরি করেছে। সাদা রঙ নেহাৎ আভা তৈরি করছে তা নয়, ওই আভার প্রতিক্রিয়াকে রুবেন্স দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন পেইন্টিংয়ের মায়াভাস তৈরি করার জন্য। মনে হয় শিল্পী শাহাবুদ্দিনও এই তিন মহান শিল্পীদের কাছ থেকে ধার করেছেন দ্রুতগতি রেখার ব্যবহার থেকে কল্পনার উদ্বোধন, এই কল্পনার উদ্বোধন। ফিগরকে কেন্দ্র করে, এবং সাদা রঙ থেকে দ্যুতি তৈরি করার টেকনিক। এসব প্রমাণ করে তিনি পূর্বসূরিদের কাজ কি মগ্নতার সঙ্গে পাঠ করেছেন তার নিজস্ব কল্পনার বোধকে শক্তিশালী, উদ্দীপিত এবং সংক্রামক করার জন্য। তার পুরুষ ফিগরের পৌনঃপুনিকতা তার কল্পনার সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট করে, আবার পুরুষ ফিগর ও পুরুষ ফিগরের ইমেজ এক ধরনের যৌনতাও স্পষ্ট করে। কল্পনার সীমাবদ্ধতার দরুন তার গতিক্ষিপ্র, পুরুষ ফিগর একটা পুনরাবৃত্তিত আবহ তৈরি করে। এই আবহ শরীরিক, চূড়ান্ত অর্থে যৌনতা উদ্দীপক। যৌনতার একটা মোহ আছে।
শিল্পী শাহাবুদ্দিন এই মোহ বার বার ব্যবহার করে শরীরের একটা কুহক তৈরি করতে চান। আবার তার অধিকাংশ পুরুষ-ফিগর যুদ্ধ সংক্রান্ত পরিসর থেকে উত্থিত বলে, তার মধ্যে প্রতিনিধিত্বশীলতার যৌনতার রাজনীতি ক্রিয়াশীল। কলোনিয়াল কালের কিংবা বুর্জোয়া মূল্যবোধের অবদমনের বিরুদ্ধে পুরুষের শরীর উথিত, এই উত্থানের মধ্যে শিল্পী শাহাবুদ্দিন পরতে পরতে প্রবিষ্ট করিয়ে দেন শরীর বিষয়ক ফ্যান্টাসি, শারীরিক যৌনতা, সব কিছুই সক্রিয় রাজনীতির পরিসরে। মিশেল ফুকোর বক্তব্য ধার করে বলা নয় বাস্তব মানুষী জীবন এবং ইমেজ কিংবা ফ্যান্টাস্টিক প্রতিনিধিত্বশীলতা মানুষ নির্মাণ করে, এসবই কল্পনার ইতিহাসের এবং মানবের ইতিহাসের একটি মূল অংশ। শিল্পী শাহাবুদ্দিন এ কাজটা করেছেন, তার সাংস্কৃতিক সৃষ্টির মধ্যে মগ্ন অচেতন প্রক্রিয়া। তার পুরুষ এবং পুরুষতার প্রতিনিধিত্বশীলতা মানুষের ডিসকাসিড স্তরে আবদ্ধ। তিনি বাস্তবতার মধ্যে আখ্যান, আখ্যানের মধ্যে ফ্যান্টাসি, ফ্যান্টাসির মধ্যে পুরুষীয় আকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছা প্রবিষ্ট করে জীবনযাপনের একটা অর্থ তৈরি করার চেষ্টা করছেন পুরুষের নারী লালিমার বিপরীতে।
শিল্পী শাহাবুদ্দিনের আর এক ধরনের কাজ আছে। এসব নারী দেহ নিয়ে। তার নারীরা কাপড়ে আবৃত, কাপড়ের অন্তরালের তুক তিনি স্ট্যাডি করেছেন। তিনি যেন কেনো, ড্রেসড মহিলার স্বপ্ন দেখছেন। এ স্বপ্ন কি পুরুষের চোখে ঐশ্বরীর স্বপ্ন? তার নারীরা নগ্ন নয়, তিনি আঁকেন তাদের মাংস, তাদের ত্বক, মাংসে বা ত্বকে বিচ্ছুরিত আলোক। এই আলোক তার নারীদের প্রায় নগ্ন করে, চোখে তীব্র হয়ে ওঠে ত্বকের অন্তরালের শরীর। এ হচ্ছে জীবন্ত মাংস, এতো জীবন্ত যে পোশাকও এই জীবন্ততা আটকে রাখতে পারছে না। শরীরটা যেন উথলে ওঠে। আমরা তাকাই কাঁধে, বুকে, উরুতে, আমরা অবাক হই শরীরের কোমলত্ব ও উষ্ণতায়। একে কি বলব নারীত্ব? শিল্পী শাহাবুদ্দিন এভাবেই শরীরকে দু’ক্ষেত্রে আবিষ্কার করছেন গতির ক্ষেত্রে এবং কোমলতার ক্ষেত্রে। গতির ক্ষেত্রে পুরুষের শরীর, কোমলতার ক্ষেত্রে নারীর শরীর । নারী ফিগার দেখে ইচ্ছা হয় স্পর্শ করার। স্পর্শ কি ত্বককে? ত্বকের অন্তরালে অন্য কিছুকে? এই ইচ্ছা চিরকালীন। এও এক ধরনের প্যাশান। জন ডান বোধহয় এই প্যাশানের খবর জানতেন:  For I had rather owner be of thee one hour, than all else ever.  মানুষের শরীরের অপার রহস্যের এই বোধটাই আমার মধ্যে জাগে যখন আমি শিল্পী শাহাবুদ্দিনকে কাজ করতে দেখি প্যারিসে তার স্টুডিওতে কিংবা ঢাকায়।