প্রভাষ আমিন ||
সোমবার বিকেলে ব্রিটিশ রানির শেষকৃত্য চলছিল। অধিকাংশ গণমাধ্যম ব্যস্ত ছিল সেটা নিয়েই। সুকান্তের কবিতার মতো হঠাৎ গোটা বাংলাদেশ দখল করে নিল নারীরা। ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ’-এর মতো সেই হিমালয়ের দেশেই বাংলাদেশের ফুটবলের নতুন সূর্য উঠল। ব্রিটিশ রানির বিদায়ের দিনেই বাংলাদেশ পেল একঝাঁক নতুন রানি। সেই রানিদের নামগুলো একটু দেখে নিন- রূপনা চাকমা, ইতি রানী, সাথী বিশ্বাস, মাসুরা পারভীন, আঁখি খাতুন, শামসুন্নাহার, শিউলি আজিম, নিলুফা ইয়াসমিন নীলা, আনাই মগিনি, মারিয়া মান্ডা, মনিকা চাকমা, সোহাগী কিসকু, স্বপ্না রানী, ঋতুপর্ণা চাকমা, সানজিদা আক্তার, মার্জিয়া, সাবিনা খাতুন, কৃষ্ণা রানী সরকার, সিরাত জাহান স্বপ্না, তহুরা খাতুন, আনুচিং মোগিনি ও সাজেদা খাতুন। কী যে থোকা থোকা মন ভালো করা নাম।
বাংলাদেশের মেয়েরা প্রথমবারের মতো সাফ ফুটবলের চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তাদের হিমালয় জয়ের পেছনের সংগ্রামের গল্পটা জানলে বাঁধভাঙা কান্না আমাদের ভাসিয়ে নেয়। সাফ ফুটবল আসলে ভারতের টুর্নামেন্ট। আগের পাঁচটি আসরেরই চ্যাম্পিয়ন ভারত। বাংলাদেশ কেবল একবার ফাইনাল খেলতে পেরেছিল। বাকি সব বার ফাইনালে ভারতের প্রতিপক্ষ ছিল নেপাল। এবার বাংলাদেশ ভারতকে উড়িয়ে দিয়েছে আগেই। ফাইনালের প্রতিপক্ষ ছিল নেপাল। আর খেলাটা হচ্ছিল নেপালের কাঠমান্ডুতে। আগে কখনো নেপালের সঙ্গে জিততে পারেনি বাংলাদেশ। আর মাঠে নেপালের খেলোয়াড়রা তো ছিলই, ছিল স্টেডিয়ামভর্তি নেপালের সমর্থকরাও। সব বাধা উড়িয়ে দিয়ে যোগ্যতর দল হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। ফাইনালের পথে বাংলাদেশ মালদ্বীপকে হারিয়েছে ৩-০ গোলে, ভারতকে ৩-০, পাকিস্তানকে ৬-০, আর সেমিফাইনালে ভুটানকে ৮-০ গোলে। পুরো টুর্নামেন্টে রূপনা চাকমাকে একবারই ফাঁকি দিতে পেরেছে বল, আর সেটি ফাইনালে। কৃষ্ণা সরকারের একটি ড্রিবলিঙের ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে, যেটি দেখে অনেকেই রোনালদিনহোর কথা মনে করছেন। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং সেরা খেলোয়াড় বাংলাদেশের রানিদের নেতা সাবিনা খাতুন।
তবে ফুটবল সামর্থ্য দিয়ে এই জয়ের মাহাত্ম্য বিবেচনা করা যাবে না। বাংলাদেশের নারীদের এই জয় ফুটবলের চেয়েও বেশি কিছু। ফাইনালের আগে সানজিদা আক্তার তার ফেসবুক স্ট্যটাস দিয়ে জয় করে নিয়েছেন ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়। সানজিদার পুরো স্ট্যাটাসটি তুলে দিতে মন চাইছে। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। তবু কিছু অংশ উদ্ধৃত না করলে এই জয়ের মাহাত্ম্যটা বোঝানো যাবে না। সানজিদা লিখেছেন, ‘যারা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সব স্বপ্নসারথীর জন্য এটি আমরা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতিদান আমরা দিতে চাই। ছাদ খোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে এক পাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই। আমাদের এই সাফল্য হয়তো আরও নতুন কিছু সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া পেতে সাহায্য করবে। অনুজদের বন্ধুর এই রাস্তাটুকু কিছু হলেও সহজ করে দিয়ে যেতে চাই। পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রামবাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতিটি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আমার। ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধা দল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে।’ এটুকুতেই সানজিদা কী অসাধারণভাবে তুলে আনল তাদের সব কথা, ভালোবাসা, আবেগ, লড়াই আর সংগ্রামের গল্প।
বাংলাদেশের নারীদের ফুটবল খেলার ইতিহাসটা বেশি দিনের নয়। ফিফার বাধ্যবাধকতার কারণেই নারীদের দল বানাতে হয়েছে বাফুফেকে। কিন্তু ফুটবল এমনিতেই বাংলাদেশের দুয়োরানি। আর নারীরা আরও বৈষম্যের শিকার। তাই ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ নিছক নেপাল নয়; ছিল পাহাড় সমান বৈষম্য, সমাজের ভ্রুকুটি, টিপ্পনী, মৌলবাদীদের হুমকি, আর দারিদ্র্য। এই রূপকথার গল্পের শুরুটা গারো পাহাড়ের কোলঘেঁষা ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার কলসিন্দুর গ্রাম থেকে। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়নশিপের ১৮ সদস্যের দলের ১০ জনই ছিল কলসিন্দুরের। সাংবাদিকরা যখন কলসিন্দুরের মেয়েদের কাছে জানতে চেয়েছেন তারা কী চায়, তখন তারা বলেছে, পেটভরে খেতে চায়। আর কী চায়? জানতে চাইলে তারা বলেছিল, একটু বেশি খাবার, যাতে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারে। একটি পত্রিকা যখন কলসিন্দুরের মেয়েদের নিয়ে ডকুমেন্টারি বানাল, তখন তারা বলেছে, সেটা দেখার কোনো উপায় তাদের নেই। কারণ তাদের গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। তারপর কলসিন্দুরের ৮০০ ঘরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুতের আলো। আর সেই আলোয় এখন ঝলমলে গোটা বাংলাদেশ।
এই নতুন রানিদের লড়াইটা অনেক কঠিন ছিল। কারণ বাংলাদেশে এখন সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে গেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নারীরা টিপ পরে রাস্তায় বেরোলে হেনস্তার শিকার হতে হয়। পছন্দের পোশাক পরলে রেলস্টেশনে প্রকাশ্যে ধাওয়া খেতে হয়। সাম্প্রদায়িকদের সঙ্গে সুর মেলান হাইকোর্টের বিচারপতিরাও। বোরকাকে ফরমাল পোশাক ঘোষণার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন হয়। লোকাল বাসে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে বাসে কলসিন্দুরের মেয়েদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়। নারীদের ফুটবল বন্ধের দাবিতে বাংলাদেশে মিছিল হয়। মাঠে খেলতে নামলে নারীদের মাথায় রাখতে হয়, শর্টসটা বেশি ছোট হয়ে গেল না তো! এত সব প্রতিবন্ধকতা ঠেলে জিততে হয়েছে নারীদের। তাই এই জয় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে অনেক জয়। এই জয় তাই নিছক একটি জয় নয়, নারীমুক্তির পথে বড় এক অগ্রগতি।
নারীদের এই বিশাল ও ব্যাপক জয়ের পর ছড়াকার ব্রত রায় লিখেছেন, ‘গোল দিয়েছে ভারত, নেপাল, পাকিস্তানের জালে/ গোল না ওটা, চড় ছিল ঠিক অনেক লোকের গালে।’ আসলে বাংলাদেশের নারীদের প্রতিটি গোল, প্রতিটি আক্রমণ ছিল সেই সব সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো, জবাব দিয়েছে তাদের যারা নারীদের পিছিয়ে রাখতে চায়। এমনিতে নারীরা এখন আমাদের অর্থনীতির বড় শক্তি, উন্নয়নের পথে তারা সবার সঙ্গে পা মিলিয়ে চলছে। শিক্ষায় নারীরা পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে। নারীদের পেশা, পুরুষদের পেশা বলে আলাদা কিছু নেই। সংসদ থেকে হাইকোর্ট, বিমান থেকে স্কুটি, যুদ্ধের ময়দান থেকে অপারেশনের টেবিল, গার্মেন্ট থেকে কাঁচাবাজার- সর্বত্র এখন নারীদের জয়জয়কার, তাদের প্রবল এবং দাপুটে উপস্থিতি। এত কিছু প্রমাণ করার পরও আমরা তাদের ঘরে আটকে রাখতে চাই। বাংলাদেশের জনপ্রিয় ধর্মীয় নেতা প্রয়াত আল্লামা শফি একবার নারীদের তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, ‘মেয়ে মানুষ হচ্ছে তেঁতুলের মতো। ছোট্ট একটা ছেলে তেঁতুল খাইতেছে, তা দেখলে আপনার মুখ দিয়া লালা ঝরবে। তেঁতুলগাছের নিচ দিয়া আপনি হাঁইটা যান তাইলেও আপনার লালা ঝরবে। দোকানে তেঁতুল বিক্রি হইতে দেখলেও আপনার লালা ঝরবে। ঠিক তেমনি মহিলাদের দেখলে দিলের মাঝে লালা ঝরে।’ আল্লামা শফির পরামর্শ ছিল মেয়েদের ক্লাস ফোর/ফাইভ পর্যন্ত হবে, যাতে তারা স্বামীর টাকা-পয়সার হিসাব রাখতে পারে। এই মানসিকতা এখনো বাংলাদেশের অনেকে লালন করেন। নারীদের ফুটবল খেলা নিয়ে, খেলোয়াড়দের পোশাক নিয়ে তাদের প্রবল আপত্তি। সাফ জয়ের পর সেই অন্ধকার শক্তি এখন মুখ লুকিয়েছে বটে; তবে সাবিনা, কৃষ্ণা, রূপনাদের লড়াইটা কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। আমি জানি, সাফল্যের চেয়ে বড় কোনো প্রতিশোধ নেই। একটার পর একটা অর্জন দিয়েই তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে, বাংলার নারীরা অদম্য, তাদের আটকে রাখা যাবে না।
শুরুতে যে একঝাঁক রানির নাম লিখেছি। ভালো করে মিলিয়ে দেখুন, এই তালিকায় রূপনা চাকমা যেমন আছে, মাসুরা পারভীনও আছে, আনাই মগিনি আছে, মারিয়া মান্ডা আছে, আছে সাবিনা খাতুনও। এটাই আসল বাংলাদেশ। বৈচিত্র্যেই যে সৌন্দর্য, সেটা আমরা ভুলতে বসেছিলাম। আমরা নারীদের, আদিবাসীদের, সংখ্যালঘুদের দমিয়ে রেখে একটা এককেন্দ্রিক সমাজ গড়তে চাই। কিন্তু একটা দেশকে এগিয় যেতে হলে নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-আদিবাসী সবাইকে নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই এগোতে হবে।
বাংলাদেশের নারীদের এই জয় যেন সব নারীর জন্য খুলে দেয় সম্ভাবনার সব দুয়ার। সানজিদা যে অনুজদের বন্ধুর এই রাস্তাটুকু কিছু হলেও সহজ করে দিতে চেয়েছিল, আশা করি এই জয় সেই পথ অনেকটাই সহজ করে দেবে। নারীদের প্রতি, নারী ফুটবলারদের প্রতি আমাদের, সমাজের যে অবহেলা; আশা করি এই জয় তা উড়িয়ে দেবে।
নতুন রানিদের জন্য প্রাণঢালা অভিনন্দন আর বুকভরা ভালোবাসার সঙ্গে সুকান্তের একটি কবিতা দিয়ে শেষ করছি আজকের অর্ঘ্য-
‘সাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়,
জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়!’
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।