শাহীন আলম, দেবিদ্বার ||
গোপাল
চন্দ্রের বয়স এখন প্রায় বাষট্টি। তাঁর যখন ৮-১০ বছর তখন বাবা-মায়ের সাথে
যুক্ত হন এ পেশায়। বাবার সাথে কাঁধে করে পাটি, খাঁচা, কুলা, মাচা, মাছ
ধরার আনতা, চাই, মই, চাটাই, ঢোল, গোলা, ওড়া, বাউনি, ঝুঁড়ি, মাছ রাখার ডুলা,
মোড়া নিয়ে বিভিন্ন হাটবাজারের যেতেন গোপাল। তখন বাজারে বাঁশের পণ্যের
চাহিদাও ছিল। সারাদিন বেচাবিক্রি শেষ করে সন্ধ্যায় ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে
আসত গোপালের বাবা। বাজার থেকে বাবার পিছনে পিছনে আনন্দে দৌড়িয়ে আসত গোপালও।
বাবা মা মারা যাওয়ার পর গোপাল এখনও ধরে রেখেছেন বাবা-মার রেখে যাওয়া সেই
পেশা।
গোপাল চন্দ্র নম দেবিদ্বার উপজেলার বড়শালঘর ইউনিয়নের
ইস্টগ্রামের বাসিন্দা। ছোট বেলায় বাবার সাথে বাজারে বেতের পন্য বেঁচার
স্মৃতি বর্ণনা করছিলেন তিনি। গোপাল চন্দ্রের বয়স বেঁড়েছে, চোখে তেমন একটা
দেখেন না। বেতের পন্যের চাহিদা কম থাকায় অভাবে অনটনে চলছে তাঁর সংসার।
গোপালের মত ইস্টগ্রামে আরও কয়েকটি পরিবার আছে যারা বাঁশের বেতের আসবাবপত্র
বেঁচে এখনও কোন রকম লড়াই করে টিকে আছেন।
গোপাল চন্দ্র নম বলেন, এখন
আর বাঁশ-বেত শিল্পের কদর নেই, বাঁশের দাম অনেক। কাঁচামাল পাওয়া যায়না।
এরপরও কিছু পন্য বানিয়ে বাজারে নিয়ে গেলে কেউ দামদর জানতে চায়না। সারাদিন
বসে থেকেও ২০০ টাকাও বিক্রি করা যায়না। তাই এ পেশা ছেড়ে যাচ্ছে অনেকেই।
একটা সময় ছিল, দিনরাত কাজ করেও শেষ করা যেত না, পাইকারেরা অগ্রিম টাকা নিয়ে
বাড়িতে এসে বসে থাকত, বিদেশেও বেতের বানানো অনেক আসবাব পাঠিয়েছি। এ
ইস্টগ্রামকে বেত শিল্পের এক নামে চিনত।
গাঁয়ে ছিড়াঁফাঁড়া কাপড় নিয়ে
প্রতিবেদকের কাছে আসেন পুষ্প রানী নম। বয়স আনুমানিক ৫৭ হবে। থাকেন
ইস্টগ্রামেই। এক ছেলে নিয়ে তার সংসার। ৩০ বছর আগে স্বামী সচিন্দ্র নম বাড়ি
ছেড়ে চলে যান, এরপর থেকে তার আর খোঁজ মেলেনি। ভিটেমাটি বলতে এক টুকরো জমিও
রেখে যায়নি হারিয়ে যাওয়া স্বামী। ছেলেকে নিয়ে অন্যের ঘরে ভাড়া থাকেন।
পুষ্প বলেন, ডুলা বেঁচে ভাত খেতেই পারি না, গাঁয়ের কাপড় পাব কোথায়?
ঝুঁড়ি-ডুলা বানিয়ে জীবন আর চলে না। দিনে চার-পাঁচটা ঝুঁড়ি,ওড়া বানাতে পারি।
এতে আর কয় টাকা পাই। বাজারে বাঁশ পাওয়া যায় না, গুনার দাম বাড়ছে। কষ্ট
করে সংসার চালাই।
বেত শিল্পের কারিগর মানিক নম, প্রদীপ, বাদল,
দিলীপ, হরিবল ও বাবুল জানান, ‘ছোটবেলায় বাবা-মায়ের কাছ থেকে বাঁশের এসব
পণ্য তৈরির কৌশল শিখেছি। তাঁরাও শিখেছেন বংশ পরম্পরায়। কুটির শিল্পে তাদের
অনেক সুনাম ছিলো আমাদের। কিন্তু আমাদের আর পেট চলেনা। দু’বেলা আহারের
যোগাতেও দিন রাত খাটতে হয়। যে কারণে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করানো সম্ভব
হয়না।
তাঁরা আরও বলেন, বেঁতের একটি পণ্যের বানাতে খরচ ১৫ থেকে ২০০
টাকা। আর বিক্রয়মূল্য ২০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। কখনও কখনও জেলার বাইরে
থেকে তাঁদের কাঁচামাল সংগ্রহ করতে হয়। কাঁচামালের অপ্রতুলতা ও মূল্য বেশি
হওয়ায় দিন দিন এ শিল্প ঐতিহ্য হারাচ্ছে। দেশে এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে
হলে বাঁশ ও বেত চাষ প্রয়োজন।
ইস্টগ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিন
ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নারী-পুরুষ কুটির শিল্পীরা ঘরের উঠোনে বসে
বাঁশের বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র তৈরি করছেন। কেউ বাঁশের শলাকা তুলছেন, কেউ
বুনছেন নান্দনিক তৈজসপত্র। এ পণ্য পাশ^বর্তী কুটিবাজার, কসবা, কোম্পানীগঞ্জ
বাজারসহ আশপাশের লোকজন তাদের সংসারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজসপত্র সস্তায়
কেনার জন্য এখানে আসেন। প্রতিটি বাড়ি ঘুরে আরও দেখা যায়, বাঁশ-বেতের পাটি,
খাঁচা, মাচা, মই, চাটাই, ঢোল, গোলা, ওড়া, বাউনি, ঝুড়ি, ডুলা, মোড়াসহ
বিভিন্ন ঘরের কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র বানাতে ব্যস্ত শিল্পীরা। যা
গ্রাম-বাংলায় এখন আর এমন দৃশ্য চোখে পড়ে না। বিলুপ্তির পথে এক সময়ের
ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত শিল্প। এ শিল্পকে গ্রামীণ লোকশিল্পও বলা হয়।