তথ্যপ্রযুক্তির এ সময়ে পুরো বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। গুগল ম্যাপসের মাধ্যমে বিশ্বের প্রায় সব জায়গা দেখা যায়। ঘরে বসে যে কেউ ঘুরে আসতে পারেন পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত। কোথাও যাওয়ার রুট, অপরিচিত এলাকা, ঐতিহাসিক ল্যান্ডস্কেপসহ একাধিক তথ্যের আঁতুরঘর গুগল ম্যাপস। ২০০৫ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত মুঠোফোনেই তামাম দুনিয়া দেখার সুযোগ দিচ্ছে গুগল। কিন্তু এই যাত্রা অতটাও সহজ ছিল না, যতটা আমরা সহজভাবে গুগল ম্যাপস নেভিগেট করে থাকি। শুরুটা হয়েছিল ৫০ জনের সদস্য নিয়ে। সে সময় গুগল ম্যাপসের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল হাতেগোনা কয়েকজন।
যদিও গুগল ম্যাপস আসার প্রায় ১০ বছর আগে বিশ্বে প্রথম অনলাইন ম্যাপিংয়ের সূচনা করেন স্যার টিম বার্নার্স-লি। ১৯৯৩ সালে তার ন্যাসেন্ট ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবে ডিজিটাল মানচিত্র প্রকাশ হয়। যা ছিল মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় প্রথম ডিজিটাল ম্যাপস।
তারপর ২০০৪ সালে দুই ড্যানিস ভাই লার্স এবং জেনস ইলস্ট্রুপ রাসমুসেন একটি আইডিয়া নিয়ে গুগলের দফতরে পৌঁছায়। এই আইডিয়া ছিল একটি ওয়েব অ্যাপ যা শুধুমাত্র স্থির মানচিত্র প্রদর্শন করবে না, একটি অনুসন্ধানযোগ্য, স্ক্রলিং ও জুম করা যায় এমন মানচিত্র প্রদান করবে।
এই দুই ভাইয়ের কোম্পানির নাম ছিল ‘হোয়্যার টু টেকনোলজি’; যা অধিগ্রহণ করে গুগল। এর সঙ্গে ‘কিহোল’ নামের আরো একটি কোম্পানি কিনে নেয় তারা, সেটি একটি ভৌগোলিক ভিজ্যুয়ালাইজেশন সফ্টওয়্যার ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হফস্ট্রা ইউনিভার্সিটির জিওটেকনোলজি বিশেষজ্ঞ ক্রেগ জানান, এই দুই কোম্পানি অধিগ্রহণের ফলে গুগলের ম্যাপিং পরিষেবা আরও মজবুত হয়েছিল।
একদিকে হোয়্যার টু টেকনোলজির সহজলোভ্য ওয়েব ইন্টারফেস এবং কিহোলের ভৌগোলিক ভিজ্যুয়ালাইজেশন সফ্টওয়্যার। দুই প্রযুক্তির সমন্বয়ে এক যুগান্তকারী প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটিয়েছিল গুগল। কিন্তু উপগ্রহ থেকে সরাসরি মোবাইল ফোনে চিত্র তুলে ধরতে অনেক কাটখড় পোড়াতে হয়েছে গুগলকে।
জিওটেকনোলজি বিশেষজ্ঞ ক্রেগের মতে, ওই সময় স্যাটেলাইটে ছবির সঙ্গে তেমন কেউ পরিচিত ছিল না। ব্রাউজারে সবাই গিয়ে প্রথমে নিজের বাড়ির ছবিই খুঁজছিলেন। রঙিন ছবি হওয়ায় উন্মাদনা অনেকটাই বেশি ছিল। তবে এই প্রযুক্তি ছিল এক নতুনের ডাক, যা গুগল ম্যাপ করে দেখিয়েছিল।
বর্তমানে গুগল ম্যাপসে সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১ বিলিয়নের বেশি। যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ গুগল ম্যাপসে মরুভূমি থেকে বরফে মোড়া প্রান্তিক অঞ্চল সবই দেখা যায়। তবে এর পিছনে একটি বড় অবদান রয়েছে বিভিন্ন সরকার ও কমিউনিটির। প্রতিনিয়ত কোটি কোটি ডেটা সরবরাহ হয় তাদের পক্ষ থেকে। যা সংগঠিত করে স্যাটেলাইটে প্রযুক্তির মাধ্যমে এক নির্ভুল ম্যাপিং পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে গুগল।
স্ট্রিট ভিউ
স্ট্রিট ভিউ হল গুগল ম্যাপসের অন্যতম বিতর্কিত এবং জনপ্রিয় একটি ফিচার। ২০০৬ সালে নির্বাচিত মার্কিন শহরগুলোতে এটি চালু করা হয়েছিল। পরে ২০০৮ সালে ইউরোপ, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ায় চালু করা হয়। স্ট্রিট ভিউ অর্থাৎ ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ দেওয়ার জন্য একটি গাড়িতে বিশেষভাবে সজ্জিত একটি ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছিল প্রথম দিকে।
প্রতিটি গাড়িতে জিপিএসসহ বিভিন্ন সেন্সর লাগানো ছিল, যা গুগলকে রুট শনাক্ত করতে সাহায্য করত। এর উদ্দেশ্য ছিল তৃতীয় পক্ষের ডেটার ওপর নির্ভরশীলতা কমানো। ক্যামেরাগুলো রাস্তার চিহ্ন, বাড়ির নম্বর এবং আকাশ থেকে দৃশ্যমান নয় এমন অন্যান্য ডেটাও ক্যাপচার করেছে; এই মানচিত্রগুলো নো-টার্ন, গতিসীমা এবং রাস্তার অন্যান্য নিয়ম সম্পর্কে স্থানীয় ধারণা প্রদান করত।
বর্তমানে ২৫০ টির বেশি দেশ ও অঞ্চল গুগলের ম্যাপসে পরিসীমায় অন্তর্ভুক্ত। ধীরে ধীরে প্রযুক্তির বিবর্তনের সঙ্গে আরও সহজলোভ্য হয়ে উঠছে ম্যাপিং পরিষেবা। বর্তমানে ঘরে বসেই বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের ঐতিহাসিক স্থাপত্য, রেস্তোরাঁ, রাস্তা ইত্যাদি ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ-এ দেখা যায়।
ম্যাপস পরিষেবা উন্নত হলেও এর সঙ্গেও জড়িয়ে গোপনীয়তা। কারণ গুগল ম্যাপসে প্রদর্শিত বিভিন্ন তথ্যের অধীন থাকে কারও বাড়ি অথবা অফিসের ঠিকানা, ওয়াইফাই নেটওয়ার্কসহ একাধিক সংবেদনশীল তথ্য। যা নিয়ে বহুবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে গুগল।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, যে কোনো ম্যাপিং পরিষেবার ক্ষেত্রে এই একটি ঝুঁকি থাকে। আর তা যতটা সম্ভব কমানোর জন্য আনা হয়েছে ডিফারেনশিয়াল প্রাইভেসি সিস্টেম। এখানে উক্ত ব্যক্তি ও তার কার্যকলাপকে পৃথক করতে সাহায্য করে। এর সঙ্গে গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য রয়েছে ইনকগনিটো মোড।
গুগল জানিয়েছে, তারা সংবেদনশীল তথ্য কোনো তৃতীয় পক্ষকে বিক্রি করে না। সুতরাং সামগ্রিক দিক থেকে দেখলে গুগল ম্যাপসের এই ভাবনা ও প্রযুক্তি এক বিরাট পরিবর্তন এনেছে মানুষের জীবনে তা অস্বীকার করার জায়গা নেই।