অনিয়মের কারণে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনাররা। বর্তমান কমিশনের সিদ্ধান্তকে সঠিক উল্লেখ করে তারা বলেন, কমিশন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঠিকই নিয়েছে। আইনের মধ্যে থেকেই তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের চোখের সামনে কারচুপি ধরা পড়ছে। তারা নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছে।
বুধবার (১৯ অক্টোবর) বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মতবিনিয়ে অংশ নিয়ে তারা এসব কথা বলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত এই মতবিনিময়ে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ, কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ, কে এম নূরুল হুদা, সাবেক কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম শাখাওয়াত হোসেন, শাহ নেওয়াজ রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম, সাবেক ইসি ড. মুহম্মদ সাদিক, সিরাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ, এম এ রেজা, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমান ও জেসমিন টুলী অংশ নেন। আমন্ত্রিত ২৮ জনের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন ১৪ জন।
তাদের মধ্যে তিন ঘণ্টার মতবিনিময়ে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার ও জাতীয় পরিচয়পত্র সরকারের কাছে নিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা হয়।
মতবিনিময় শেষে গাইবান্ধা-৫ আসনের ভোট বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রশ্নে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবদুর রউফ সাংবাদিকদের বলেন, ‘যখন ভোটাররা ভোট দিতে পারে না। একজনের ভোট আরেকজন দেয়, তখন নির্বাচন কমিশন বসে থাকবে কেন? স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের এই অধিকার আছে। তাদের চোখের সামনে ধরা পড়ছে। ভোট দিতে পারছে না। কারচুপি হচ্ছে। তারা নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা বলেছি, দরকার হলে বারে বারে বন্ধ করবেন। জাতিকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেন।’
আপনি সিইসি থাকার সময় অনুষ্ঠিত মাগুরা উপনির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম হলেও তখন কেন ব্যবস্থা নিতে পারেননি প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা সামনের দিকে তাকাতে চাই। পেছনেরটা টেনে এনে জাতিকে আর অন্ধকারের মধ্যে ফেলবেন না।’
ইভিএম প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কমিশন চেষ্টা করতে থাকুক। মানুষ যদি শিক্ষিত হয় তাহলে হবে।’
সাবেক সিইসি কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক বডি। সংবিধান ও আইন মোতাবেক তারা কাজ করে যাবে, আমরা এই পরামর্শ দিয়েছি।’
কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ ইভিএম প্রসঙ্গে জনগণকে সচেতন করা ও ব্যাপক প্রচার করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে প্রচার-প্রচারণা করতে হবে। এর সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে। উনারা বলেছেন, নতুন ইভিএমটি খুবই উন্নতমানের। অলমোস্ট ডিজিটাল। কিন্তু এটা তো লোকজনকে জানতে হবে। এটা নিয়ে ইতিবাচক প্রচারণার দরকার আছে।’
গাইবান্ধা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে উল্লেখ করে সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন যেটা নিয়েছে ঠিকই নিয়েছে। বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছে এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার এই ক্ষমতা আছে। তারা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে নতুনভাবে আর তথ্য-উপাত্ত যোগাড় করার দরকার নেই।’
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সময় যেভাবে রিপোর্ট আসতো, সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হতো। রিপোর্টের ভিত্তিতে নির্বাচন বন্ধ করা হয়েছে। এই কমিশন সিসিটিভিতে পর্যবেক্ষণ করেছে। তার আলোকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়ে সাবেক এই সিইসি বলেন, ‘ইভিএম যেসব জায়গায় ভোট হয়েছে, সেখানে ৬০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে ভোটাররা কোনও প্রশ্ন তোলেননি। প্রিসাইডিং অফিসারসহ নির্বাচনি কর্মকর্তারা কোনও আপত্তি করেননি। বিজয়ী ও বিজিত প্রার্থীরাও কোনও আপত্তি করেননি। যেখানে ইভিএম ব্যবহার হয়েছে, সেখানকার ভোটাররা জানেন এটা কী? যারা ব্যবহার করেননি তাদের পক্ষে ইভিএম বুঝাটা একটু কঠিন। আমি বলেছি, যতদূর পারা যায়, আগামী জাতীয় সংসদে ইভিএম ব্যবহার করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে ভোটের পরিবেশ ভালো থাকে না। কেন্দ্র দখল হয়। ভোট ডাকাতি হয়। এখানে ১০০ ভাগ ভোট হয়। কাজেই এখানে ব্যালটে নির্বাচনের চেয়ে ইভিএম ব্যবহারের মাধ্যমে নির্বাচনি সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মাঠ প্রশাসনে ভালো একটি সমন্বয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করতে হবে। তাদেরকে নির্বাচনি কাজে সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।’
জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহার না করে সিসিটিভি ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। ভালো হোক মন্দ হোক— আপনাদের ইভিএম নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। যে বাজেটে ১৫০ আসনের জন্য ইভিএম কিনবেন, তার থেকে বেটার যতখানি পারেন সিসিটিভি ব্যবহার করেন।’
তিনি বলেন, ‘গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার জন্য কমিশনকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। যেটা করেছেন সেটা ঠিক আছে। তবে পরের ধাপগুলোতে যেন স্লিপ না করেন। যদি স্লিপ করেন, তাহলে জাতির কাছে অন্য রকমের মেসেজ যাবে যে, আপনারা দেখানোর জন্য করেছেন, বাকিটুকু করলেন না। আইন শক্ত অবস্থানে। প্লিজ ডু ইট। নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে— পরিবেশ ঠিক নেই তাহলে নির্বাচন বন্ধ করতে পারেন। যতক্ষণ পর্যন্ত মনে করবেন, পরিবেশ ঠিক নেই, ততক্ষণই বন্ধ রাখতে পারবেন। আইনে কোথা বাধা নেই।’
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে এর আগে কোনও কমিশন কিন্তু এটা করতে পারেনি। ১৯৯৪ সালে যদি এটা করা হতো, তাহলে আজকে পলিটিকালল ফিল্ডটি অন্যরকম হতো। হতে পারতো ইতিহাস।’
স্বস্তি পেলো বর্তমান ইসি
গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধ প্রশ্নে সাবেক কমিশনারদের পক্ষ থেকে ইতিবাচক মন্তব্য পেয়ে স্বস্তিতে বর্তমান কমিশন। সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘গাইবান্ধায় আমরা যে অ্যাকশনটা নিয়েছি, উনারা বলেছেন— এটা সঠিক হয়েছে। আইনগতভাবে ও সাংবিধানিকভাবে ঠিক হয়েছে। উনারা আমাদের মুরব্বিজন, গুরুজন হিসেবে পরামর্শ দিয়েছেন— সততার সঙ্গে, সাহসিকতার সঙ্গে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে।’
বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত বৈঠকের বিষয়ে সিইসি বলেন, ‘আজ আমাদের পক্ষ থেকে আমরা কোনও বক্তব্যই দিইনি, তাদেরকে শুনেছি। সার্বিক কথা হয়েছে। আমরা তাদের ডেকেছিলাম— এটা সত্য গাইবান্ধাতে যে একটা ঘটনা ঘটে গেলো, আমাদের প্রয়োজন ছিল আরও এনলাইটেন্ড হওয়া। উনাদের তরফ থেকে কোনও গাইডেন্স আছে কিনা, কীভাবে মূল্যায়ন করেছেন অতটুকু জেনেছি।’
সিইসির মতে, এটা ক্রিটিক্যাল ছিল। প্রথমবারের মতো বড় ধরনের কোনও পদক্ষেপ নির্বাচন কমিশন নিয়েছে এবং এটা যথেষ্ট সেনসেশন ক্রিয়েট করেছে সর্বমহলে। এটা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য হয়েছে।’
বন্ধ করার পর সাবেকদের কাছ থেকে নতুন করে মূল্যায়ন কেন? এমন প্রশ্নের বিষয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘মূল্যায়নের খুবই প্রয়োজন রয়েছে। যেকোনও বিষয়ে বিচারক হিসেবে আমরা সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করি যে,বিষয়টা ঠিক হয়েছে কিনা। ... আমরা শুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিয়েছি কী নেইনি, আমরা আমাদের অভিমতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারপরেও এটা সঠিক নাও হতে পারে। কোর্টে গিয়ে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। উনারা যদি বলতেন— সঠিক সিদ্ধান্ত নেননি, তখন আমাদের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার প্রয়োজন হতো।’
আইনি জটিলতা দেখা না দেওয়ায় এবং সাবেকদের পাশে পেয়ে নিজেদের সক্ষমতা দেখাতেও উজ্জীবিত হন সিইসি। তিনি বলেন, ‘উনারা (সাবেক সিইসি ও ইসি) সবাই একমত পোষণ করেছেন— আমাদের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে। বলেছেন এগিয়ে যান।...বলতে চাই, আমরা উনাদের কাছে যে গাইডেন্স, পরামর্শ পেয়েছি, বক্তব্য শুনেছি— আমাদের এডুকেটেড করেছেন, ইন্সপায়ার করেছেন।’
‘গাইবান্ধায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে আপনাদের উদ্দেশ্য প্রশ্ন বিদ্ধ হবে’— সাবেক একজন সহকর্মীর এমন পরামর্শের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সিইসি বলেন, ‘অপেক্ষা করেন। আমরা তদন্ত কমিটি করেছি। রিপোর্টটা আসুক। তারপরে আপনারা দেখেন, আমরা কোনও পদক্ষেপ নেই কিনা। ওয়েট অ্যান্ড সি। কাজেই একটু অপেক্ষা করতে হবে।’