
সৈয়দ ফারুক হোসেন ||
পৃথিবীর
৪৫টি দেশ এখন ‘দুর্ভিক্ষের দরজায় কড়া’ নাড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চোখে
আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, যুদ্ধের কারণে খাদ্য ঘাটতি কতটা খারাপ হতে
পারে। এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে খাদ্য সংকটের আরও অবনতি হতে পারে। করোনা,
যুদ্ধ এবং নানাবিধ সংঘাত খাদ্য ঘাটতির জন্য একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিশ্বজুড়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ যখন দিশাহারা তখন আরও খারাপ
খবরের আভাস মিলছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য
কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এরই মধ্যে সতর্ক করে বলেছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি
দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এবং ২০ কোটি মানুষের জন্য জরুরি
সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। এফএও এবং ডব্লিউএফপির যৌথ রিপোর্টে বলা হয়েছে,
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রবল। কৃষির ওপর নদীভাঙন ও ভূমি
ক্ষয়ের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। পৃথিবীতে যত মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগছে তার
মধ্যে ৬০ শতাংশ বসবাস করে যুদ্ধ-বিগ্রহকবলিত এলাকায়। পৃথিবীর অনেক দেশ হয়তো
বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে, নয়তো খরায় পুড়ছে। এর ফলেও খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত
হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। করোনা ভাইরাস মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক
প্রভাব ফেলেছে সেটি এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে
খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ হলো যুদ্ধ এবং সারের সংকট। নানা
চ্যাঞ্জেল সত্ত্বেও ‘পূর্ব সতর্কতা ব্যবস্থার উন্নয়ন, অবাধ তথ্য সরবরাহ,
প্রয়োজনীয় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ’ এবং ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা প্রস্তুতি
ও সাড়াদান কর্মসূচিতে স্বেচ্ছাসেবীদের সক্রিয় ও নিবেদিত অংশগ্রহণের ফলে
বাংলাদেশ দুর্যোগে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির হার ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনতে
পেরেছে যা সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের জাতীয় সক্ষমতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
পরিবর্তিত জলবায়ুতে বাংলাদেশের কৃষি ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং হুমকির
মুখে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা।
বৈশ্বিক বাজারে রাশিয়া ও বেলারুশের সারেরও
বিকল্প নেই। খাদ্যদ্রব্যের বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়াতে খাদ্যদ্রব্যসহ অর্থনীতিতে যে বৈশ্বিক
সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে বাংলাদেশে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
পরিস্থিতির পর্যালোচনায় বিশেষজ্ঞরা খাদ্য সংকট তৈরির আশঙ্কা করছেন এবং এ
বিষয়ে তারা সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিচ্ছেন। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে
রপ্তানি স্বাভাবিক না হলে বিশ্ব দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে পারে। এ
সংক্রান্ত যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে সরকার আগে থেকেই
সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। সম্প্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়তে থাকায়
সরকারের নীতিনির্ধারকরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে
চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন। বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে পারে এ
আশঙ্কা থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো তৎপরতা শুরু করেছে।
এই সংকটের প্রভাব যাতে না পড়ে সেজন্য করণীয় কী হবেÑ সে বিষয় নিয়ে
পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ ব্যাপারে জরুরি
নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। খাবারের দাম গত বছরে গড়ে ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
এর জেরে আগের সময়ের তুলনায় বিশ্বের আরও ২৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ চরম
দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই জনসংখ্যা
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও স্পেনের মোট জনসংখ্যার সমান। আর চলতি
বছরের মধ্যেই ৮৬ কোটি মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাপনের ব্যয় ১ দশমিক ৯০
ডলারের নিচে চলে যেতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয়
পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং ডলার সংকট মোকাবিলাসহ বাজার পরিস্থিতি
বিশ্লেষণে অর্থ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট
দপ্তরগুলোকে জরুরি সমন্বয় বৈঠকের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা।
যুদ্ধ ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া গুরুত্ব দিচ্ছে
নিজস্ব চাহিদার দিকে। ফলে রাশিয়া থেকেও শস্য রপ্তানি হচ্ছে না। অথচ দেশ
দুটির গম ও ভুট্টার প্রধান আমদানিকারক ইউরোপের দেশগুলো। বৈশ্বিক গম
রপ্তানির ৩০ শতাংশই হয় দেশ দুটি থেকে। এমনকি মোট সয়াবিনের ৮০ শতাংশই সরবরাহ
করে ইউক্রেন ও রাশিয়া। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের কারণে বন্ধ রয়েছে দেশটি
থেকে গম ও ভুট্টা রপ্তানি। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে তাতে ভাটা
পড়েছে। খাদ্য এবং জ্বালানির ঘাটতি আর অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছেন বিশ্বের অন্তত
১৭০ কোটি মানুষ, যাদের এক-তৃতীয়াংশই এখন দারিদ্র্যে দিন কাটাচ্ছেন।
বিশ্বের অনেক দেশের আমদানি করা খাদ্যশস্যের কমবেশি ৫০ শতাংশ আসে ইউক্রেন
থেকে। ইয়েমেন, সিরিয়া, তিউনিসিয়াÑ এ রকম আরও অনেক দেশ রয়েছে। এসব দেশ তাদের
খাদ্যের জন্য ইউক্রেনের ওপর নির্ভর করে। বর্তমান সংকটের কারণে কিছু দেশ
বিশেষভাবে সমস্যায় পড়ছে। কারণ এসব দেশে কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকে বেশ
উচ্চমাত্রায় খাদ্যশস্য আমদানি করে থাকে। বিশ্বের অনেক দেশ রাশিয়া এবং
ইউক্রেন থেকে আমদানি করা খাদ্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। ইউক্রেন যুদ্ধের
কারণে দেখা দেওয়া খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের কারণে বিশেষ করে দেশগুলোতে
‘পারফেক্ট স্ট্রম’, অর্থাৎ ভয়াবহ ঝড়ের আভাস দেখছে জাতিসংঘ। ইউক্রেনের
যুদ্ধের কারণে খাদ্যের দাম এতটাই বেড়ে যেতে পারে যে, তা বিশ্বের দরিদ্র
মানুষদের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। ইউক্রেন এবং রাশিয়াÑ দুটি দেশই প্রধান
খাদ্যশস্যের বড় রপ্তানিকারক। যুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে খাদ্য উৎপাদন
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং খাদ্যের দাম বাড়ছে। এর ফলে এখন বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষ
অনাহারের ঝুঁকিতে। ইউক্রেন এবং রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে পৃথিবীর সামগ্রিক
পরিস্থিতি খারাপের দিকে মোড় নিচ্ছে। রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকেই বিশ্বের মোট
গমের ২৫ শতাংশ রপ্তানি হয়। সানফ্লাওয়ার বীজ এবং তেলেরও অর্ধেক এই দুটি দেশে
উৎপাদিত হয়। ইউক্রেন সারাবিশ্বের কাছে অনেক ভুট্টাও বিক্রি করে। এই
যুদ্ধের ফলে খাদ্যশস্যের উৎপাদনের ওপর প্রভাব পড়ছে, এমনকি বিশ্বে গমের দাম
দ্বিগুণ হয়েছে।
বিশ্বের প্রাকৃতিক গ্যাসের ১৭ শতাংশ উৎপাদন করে রাশিয়া।
আর এই গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল ইউরোপীয় দেশগুলো। ইউরোপীয়
ইউনিয়নের তথ্যমতে, ১৯৭০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ইউরোপ প্রাকৃতিক
গ্যাস আমদানি শুরু করে। সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে সেই নির্ভরতা আরও বেড়েছে।
তবে ইউক্রেন আগ্রাসনের পর ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে ভাটা পড়েছে
রাশিয়ার। এরই জেরে জার্মানিতে বেড়ে গেছে সব পণ্যের দাম। বিভিন্ন বড় বড়
সুপারশপ ঘুরেও ভোজ্যতেল খুঁজে পাচ্ছেন না ক্রেতারা। শুধু তাই নয়, দাম
বেড়েছে অন্যান্য পণ্যেরও। শ্রীলংকার অভ্যন্তরীণ জটিলতার কারণে দেশটির
অর্থনীতি এখন বেসামাল। নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শ্রীলংকা পর্যটন খাতেও।
দেশটির পর্যটনের সম্ভাব্য বাজার হলো বাংলাদেশ, ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য ও
জার্মানি। কিন্তু পর্যটন পুনরায় চালু হওয়ার পর থেকে বহু দর্শনার্থী
পূর্বাঞ্চল থেকেও যায় দেশটিতে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা যেমন সুইফট
থেকে লেনদেনে বাদ পড়ার প্রভাবও ফেলেছে দেশটির পর্যটনে। বিশ্বের বৃহত্তম গম
উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়া। রাশিয়া থেকে আমদানি নিষিদ্ধ করায় অনেক দেশে দাম
বেড়েছে এই খাদ্যপণ্যটির। তুরস্কে দেখা দিয়েছে সরবরাহ ঘাটতি। ইউক্রেন
সারাবিশ্বে প্রথম পাঁচটি গম উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় থাকলেও যুদ্ধ
পরিস্থিতিতে কৃষ্ণসাগরসংলগ্ন বন্দর দিয়ে শস্য আমদানি-রপ্তানি প্রায় অসম্ভব
হয়ে পড়েছে। ইউক্রেনে রুশ হামলার পর ইরাকের বাজারে গমের দাম এখন আকাশছোঁয়া।
শুধু গম নয়, যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি এবং বিদ্যুতের দামেও প্রভাব পড়ছে
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। বিশ্বের অন্যতম শস্য উৎপাদনকারী দুই দেশের বিরোধে
পাল্টে গেছে সব হিসাব-নিকাশ। খোদ ইউরোপের দেশগুলোতেই দেখা দিয়েছে খাদ্য
সংকট। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভেঙে গেছে গম ও ভুট্টা সরবরাহে শীর্ষে
থাকা দেশ দুটির শস্য উৎপাদন ও রপ্তানির অবকাঠামো। বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত
সারের ২৫ শতাংশই সরবরাহ করে রাশিয়া। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় এখন তাও বন্ধ। যার
প্রভাবও পড়ছে বৈশ্বিক কৃষি ব্যবস্থাপনায়। শীর্ষ গম রপ্তানিকারক দেশগুলোর
মধ্যে প্রথম অবস্থান রাশিয়ার। আর ৫ম অবস্থানে ইউক্রেন। এই দুটি দেশে
উৎপাদিত শস্যের প্রধান বাজারই ইউরোপ। যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দামের সঙ্গে
বাড়ছে শস্য উৎপাদন খরচও। দেশ দুটি থেকে রপ্তানি বন্ধ থাকায় মজুদ পণ্যের
ওপরও পড়ছে প্রভাব। এতে ভেঙে পড়েছে পুরো সাপ্লাই চেইন। এরই মধ্যে দেশগুলোতে
খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৭ শতাংশের বেশি। জাতিসংঘের শঙ্কা এটা ২০ শতাংশ
ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মতে, গত তিন বছরে বিশ্বব্যাপী গম ও
ভুট্টা রপ্তানির প্রায় ৩০ শতাংশ রাশিয়া এবং ২০ শতাংশ ইউক্রেন থেকে হয়েছে।
যদি কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তবে দ্রুতই ৩ কোটি ৮০ লাখের বেশি লোককে আরও
দুরবস্থার সম্মুখীন হতে হবে।
সৈয়দ ফারুক হোসেন : রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়