শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
প্রবাদ বাক্য-‘বোবার শক্র নাই’। কারণ, বোবা প্রথাগত কথা বলতে পারে না। বোবা নাকি কানেও শুনেনা, বধির। কান দিয়ে মানুষ ভালো কথা শুনে, মন্দ কথা শুনে, সু-কথা শুনে, কু-কথা শুনে। ফলে কান দিয়ে এতসব শোনার পর মনে প্রতিক্রিয়া হয়। এ প্রতিক্রিয়ায় যেমন স্বস্তি লাভ ঘটে, আবার অস্বস্তিও দেখা দেয়। সুতরাং বধির ব্যক্তির জন্য তা ইতিবাচক হলেও তারপরও মানুষের যেহেতু কান আছে, তাই শুনতে চায়, শুনতে অদম্য ইচ্ছে হয়। কান তো বেছে বেছে ভাল কথা শুনে না, মন্দ কথাই বেশি শুনে। কারণ, মন্দ কথাই বেশি বলা হয়, মন্দ লোকের মাতৃভাষা হলো মন্দকথা।
যারা বোবা, তারা কথা বলতে পারে না। সুতরাং সে ব্যক্তি ভালকথাও বলতে পারে না, মন্দ কথাও নয়। সুতরাং তার কোনো শত্রু নাই। তাহলে কি কথা বলাটা অন্যায়? কথা বললেই শত্রু বা মিত্র হওয়া যায়? মিত্র হতে হলে অনেক ধৈর্য-ধরতে হয়, মন যুগিয়ে কথা বলতে হয়, অন্যকে তোষামোদ করে কথা বলতে হয়। কারো দোষের বিষয়টি কিছুতেই বলা যায় না। দূষিত বা মন্দ ব্যক্তিটি তার বিরুদ্ধে কোনো নেতিবাচক কথা শুনতে চায় না, মানতে চায় না, সহ্য করতে পারে না। হিং¯্র হয়ে ওঠে। কারণ, সে যে আপন জগতে সার্বভৌম। প্রশংসা না শুনলে মাথা গরম হয়ে যায়, কেউ প্রশংসা বা তোয়াজ করে কথা না বললে সে শত্রু বা বিরোধী। সুতরাং শাস্তি পেতে হবে। এভাবে অপকর্ম করে করে যখন পাপিয়া-সাহিদ-এরশাদ সিকদার হয়ে উঠে, তখন কথাপ্রবণ ব্যক্তিরা অজানা ভয়ে ‘বোবা’ হয়ে যায়। তারা জেনে যায়-‘বোবার শত্রু নাই।’
কথা বলার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যখন ‘বোবা’ থাকতে বাধ্য হয়, তখনই একটি প্রশ্ন জাগে-বাকস্বাধীনতা বিষয়টি। কথা বলার অধিকার সার্বজনীন, জন্মগত অধিকার। বাকস্বাধীনতা হরণ কেউ করতে পারে না। তারপর লক্ষ্য করা গেছে, ইতিহাসের আলোকে প্রাণের ভয়ে, সম্মানরক্ষার খাতিরে যাপিত কথাটি যদি কারো দাপটে স্তব্ধ হয়ে যায়, তবে ইতিহাস বলে-বাকস্বাধীনতা যেখানে নেই, এটা জালিমের রাজত্ব। জালিমের রাজত্বে বাস করা অনিরাপদ, ঝুঁকিপূর্ণ, অনিশ্চিত। আর বোবা হওয়া এককথা, বোবা হয়ে থাকা অন্যকথা। কথা বলার শক্তি আছে, অথচ ভয়ে-আতংকে কথা বলা থেকে বিরত থাকা, তা কতটা কষ্টের তা ভুক্তভোগীরাই জানে।
কোনো কোনো রোগী যখন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে, তখন কথা বলতে না পারার কষ্টে চোখ দিয়ে জল ফেলে। এই চোখের জলের প্রতিটি ফোঁটা অগ্নিকণা। দৃশ্যত এই অগ্নিকণা কাউকে আঘাত করে না, কিন্তু করে, তা দেখা যায় না। তাই কোনো কারণে, কারো দাপটে যদি বাকস্বাধীনতা হরিত হয়, তখন চোখের জলের অগ্নিকণা কোনো শক্তি দিয়েই প্রদমিত করতে পারে না। এই অগ্নিকণা কালক্রমে উৎসমূলকে জ্বালিয়ে দিবেই। একটু সময় ধৈর্য বা অপেক্ষা করতে হয়। মানুষ মুখে হাসে, তা দৃশ্যমান বা প্রত্যক্ষ। অন্তরের হাসিটি কেউ দেখতে পায় না। তদ্রƒপ কান্না দেখা গেলেও ভিতরের ক্ষরণ দেখা যায় না, বুঝা যায় না। দাপুটেরা বুঝতে চায় না-
জন্ম দিল পিতা-মাতা, কেউ বা দিল নাম।
সবটাই তোর পরের দয়ায় কি আছে তোর দাম?
আদপ কায়দা, বলার ভাষা সব অপরের ধারা
গুরুর কাছে শিক্ষা দীক্ষা গর্বটা বল কার?
মরবি যখন যাবি শ্মশান, পরের কাঁধই পাবি।
এ সংসারে কি আছে তোর, কিই বা দিয়ে যাবি।
এ পরিক্রমায় পিছনের দিকে তাকাতে হয়। কারণ, প্রতিটি নির্মাণই একটি শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। একজন মানুষ গৌরবের যে শিখরেই দাঁড়িয়ে থাকুন না কেন, তার ভিত্তি হলো পূর্বপুরুষ। সেই পূর্বপুরুষের পরিচয় হয়ত ততটা উল্লেখ্যযোগ্য নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে-তিনি ছিলেন বলেই ‘আমি’ হয়েছি। তাঁকে অস্বীকার করলে আমার পরিচয় যে প্রশ্নবিদ্ধ। যাদের বাপ-দাদার পরিচয় নেই, তাদেরকে অভিধানে একটি শব্দ দিয়ে পরিচয় দেয়া আছে-‘জারজ’, (হারামজাদা), অবৈধ। ক্ষমতার মোহে, শক্তিমত্তার অন্ধ দাপটে, অহমিকার আস্ফালনে, চাটুকারের স্তুতির প্রবাহে অতি উচ্চাভিলাসী লোভী মানুষ পরম্পরাকে স্বীকার করতে চায় না, মানতে চায় না। তাতে ব্যক্তিটির লাভ-ক্ষতি কতটুকু হয়েছে বা হবে তা বিচার্য বিষয় নয়-বিচার্য বিষয় হলো-সে সময়টা ‘অন্ধকার’ যুগ হিসেবে চিহ্নিত বা পরিচিত হয়। ভবিষ্যতে ঐ ব্যক্তিটি কলঙ্কিত নায়ক হিসেবেই উল্লেখ্যযোগ্য হয়ে থাকবে।
ইতিহাস সব সময় নিমর্ম, সে সত্য কথা বলে। যেহেতু ইতিহাস, সেজন্য সে বর্তমান নিয়ে মাথা ঘামায় না। বর্তমান যখন অতীত হয়, তখনই ইতিহাস লেখা যায়। তখন ইতিহাস হয় একসময়ের দর্পণ। স্বচ্ছভাবে সব দেখা যায়। কিন্তু ক্ষতিটা পোষানো যায় না। স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭৫-১৯৯৬ অর্থাৎ ২১ বছরের দায় মুছতে কম করে হলেও ৫০ বছর কেটে যাবে, যদি না পুনরাবৃত্তি আর ঘটে। আবার এমন সব বিষয়-আশয় আছে, তা কখনো ফিরিয়ে আনা যায় না।
যেমন ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজকে তাড়ানোর জন্য স্বদেশী আন্দোলনে যাঁরা আত্মত্যাগ করেছেন, তাঁরা ইতিহাসের মহানায়ক। ঐতিহাসিক ঘটনা আজ গৌরবোজ্জ্বল ঠিকানা। যেমন চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ১৯৩১-৩৩ সালে যে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সস্মুখ যুদ্ধ এবং প্রাণ বিসর্জন, তা ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত। এটা চট্টগ্রামবাসীর গর্বের ও ঐতিহ্যের স্মারক। বঙ্গবন্ধু সেখানে স্মারক স্থাপন করেছিলেন। ১৯২৩ সালে কুমিল্লায় গান্ধীবাদী স্বদেশী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠান ‘অভয় আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ইতিহাসে কুমিল্লার এই প্রতিষ্ঠানটি ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে উল্লেখের দাবি রাখে। এখন তা হারিয়ে গেছে। যে অভয় আশ্রমে রবীন্দ্রনাথ-গান্ধী-সীমান্তগান্ধী-সুভাসবসু-চিত্তরঞ্জন দাশ-থেকে শুরু করে তখনকার জাতীয় নেতারা এই অভয় আশ্রমে এসেছিলেন, থেকেছিলেন। বঙ্গবন্ধুও স্বাধীনতোত্তর এ অভয় আশ্রম প্রাঙ্গণে জনসভায় ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেছিলেন। সেই স্মৃতি ও প্রতিষ্ঠান এখন আর নেই। তাতে কী ক্ষতি হয়েছে, মূর্খেরা বুঝে নাই, বুঝবে না। কিন্তু কুমিল্লার ঐতিহ্যের গৌরবের একটি ঠিকানা মুছে গিয়েছে। এখন আর কুমিল্লাবাসী কেউ কেউ বলতে পারলেও স্মারকটি দেখাতে পারবে না। কারণ, স্বদেশী আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল এই অভয় আশ্রম। তা হারিয়ে গেছে। গর্ব বা অহংকারের বিষয়টি মুছে দেয়া হয়েছে। তার পিছনে কী উদ্দেশ্য ছিল তা জানি না। তেমনি চর্থার শচীনকর্তার বাড়িটির কথা উল্লেখ করা যায়। নানা প্রতিকূলতায় সামান্য অংশ উদ্ধার করা গেলেও হাঁসমুরগির খামার কথাটি বা পরিচিতি মুছে ফেলা যায়নি, যাবে কীনা তাও জানি না। এই উপমহাদেশের সঙ্গীতজগতের কিংবদন্তি শচীনকর্তা বেঁচে থাকলেও তাঁর জন্মভিটা বা কুমিল্লা তা বলতে গিয়ে একটি খামারই দৃশ্যমান হবে। আবেগে অনেকেই বলেছেন-শচীনকর্তার পুত্রবধূ আশা ভোঁসলেকে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে আসবেন। বিস্তৃতভাবে বলার চেয়ে শুধু একটি প্রশ্ন-কোথায়?
কুমিল্লা গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে আধুনিকতার উদ্দেশ্য-যাপিত কারিশমার অর্থ কী ব্যক্তিস্বার্থ, না সাম্প্রদায়িকতার নিষ্ঠুর দাবা খেলা? এ কেমন অগ্রগতি? মাতাপিতা বৃদ্ধ হয়ে গেলে, ভগ্নস্বাস্থ্য প্রাপ্ত হলে কী তাঁদেরকে মেরে ফেলতে হবে? তারা কী জানে না-
ভোলা যায় না স্মৃতি
বাঁধা যায় না সময়
জানা যায় না ভবিষ্যৎ
চেনা যায় না মানুষ
কেনা যায় না মন
ফিরে পাওয়া যায় না অতীত।
তাই স্মৃতিকে ভুললে নিজকেই ভোলার সায়রে সহসা বিসর্জিত হতে হয়। ‘অহংকার পতনের মূল’ এটি শুধু প্রবাদ বাক্য নয়, আপ্তবাক্য। একটি রাস্তা দিয়ে একজনই চলাচল করে না। যখন একটি রাস্তা কেউ তৈরি করেন, তিনি সকলের চলাচলের জন্যই করেন। যিনি একটি পুকুর খনন করেন, সর্ব সাধারণের উপকারের জন্যই করেন, যিনি বা যারা বৃক্ষরোপণ করেন, শুধু নিজেরা ফলভোগের জন্য করেন না। এই সার্বজনীনতা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এখন রাস্তা তৈরি হয়, এই রাস্তা দিয়ে একজনই চলতে চায়, এরূপ অনেক বিষয়-আশয়।
ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। ক্ষমতার দাপট ব্যক্তিকে সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ করে ফেলে। সে অধিক দূর দেখতে পায় না। পৃথিবীটা এতটাই ছোট হয়ে যায় ক্ষমতাবানের কাছে, তাকে তখন শাসন করতে যেন কষ্ট হয় না। এসব কিছুর যোগানদার হলো চাটুকাররা, সুসময়ের সঙ্গী, আপদকালের বেইমান।
আমাদের চিন্তা-চেতনায় অনেক ঘাটতি আছে। তার প্রধান কারণ আমরা সকলেই অন্তর্মুখি, চিন্তায় স্বচ্ছতা নেই, অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতি হিসাবটা প্রগাঢ়। যেমন কুমিল্লা শহরে আগে ব্যাংক-ট্যাং ছিল, ইতিহাসে-ঐতিহ্যে এই কথাটি এখনও প্রচলিত। এখন কুমিল্লায় অপরিকল্পিত নগরখাঁচা অর্থাৎ সুউচ্চ অট্টালিকা আর দোকানঘর। কান্দিরপাড়ে প্রবেশ মুখে চৌদ্দতলা দোকান, তার দক্ষিণে দু’পাশে যতই দক্ষিণে যাওয়া যায়, কেবল দোকান আর দোকান। পূর্বদিকে যেতে সাত্তার-খন্দকার-জুনাব আলী সাহেবের জায়গায়-ফাইন্ড কমপ্লেক্স। এখন কুমিল্লা শহরের জন্য প্রবাদ বাক্যটি হলো-‘থাকার জন্য নগর-খাঁচা, পয়সার জন্য দোকান বেচা।’
আমাদের প্রবণতা হলো-আমিই ইতিহাস, আমিই ঐতিহ্য, আমিই রাজা। সুতরাং অতীত বলে কিছু নেই, থাকতে পারে না, ভবিষ্যৎ মিথ্যা স্বপ্ন। বর্তমানই সব। এই পূবালী চত্বরে ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে আটজনকে পাকহানার বাহিনী হত্যা করে ফেলে রেখেছিল, এখানে একটি মুক্তিযুদ্ধের স্মারক নির্মিত হলে একটি ইতিহাস স্থাপন করা যেতো। এখানে টেলিভিশন বসানো হয়েছে। রাজগঞ্জ চৌমোহনীতে ২৭ মার্চ ১৯৭১ পাঁচজনকে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছিল, এখানে বৎসরান্তে বসানো হয় বালখিল্য স্থাপনা। কুমিল্লা শহরে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক আছে কি, আলেকারচরে একটি স্মারক স্থাপন করা হয়েছে। ছাতিপট্টি-দিগম্বরীতলায় ২৬ মার্চের রাতে সুপারিবাগান থেকে কে,ডি রায়, গুপ্ত জগন্নাথবাড়ি থেকে প্রিয়লাল ঘোষ-কানাইলাল ধর, গোয়ালপট্টি থেকে নিহাররঞ্জন সরকার, দিগম্বরী তলা থেকে নিতাই সাহা, নানুয়াদিঘির উত্তরপাড় থেকে মনমোহন সাহা, অনাথবন্ধু কর্মকারের জ্যেষ্ঠ ছেলেসহ অনেককে পাক হানাদার বাহিনী তুলে নিয়ে যায় সেনানিবাসে, তাঁদেরকে হত্যা করা হয় নিমর্মভাবে, একমাত্র প্রিয়লাল ঘোষ ছাত্রলীগ করত, ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক ছিল, অন্যান্য সব ব্যবসায়ী, রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের নাম উচ্চারণ করতে শুনিনি, ছাত্রলীগ ভুলেও প্রিয়লাল ঘোষের নাম উচ্চারণ করতে শুনিনি। সে সময় তাঁদের একটিই দোষ ছিল, তাঁরা ছিলেন হিন্দু, সম্ভ্রান্ত হিন্দু। পূবালী চত্বর-রাজগঞ্জ চৌমোহনীতে যাঁদের হত্যা করা হয়, তাঁরা সকলেই হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাঁদের সম্মানে একটি স্মারক বা সম্মিলিত রাস্তার নামকরণ করলেও ইতিহাসের অংশ হিসেবে স্মরণ করা যেত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে চাই-
কথা কও, কথা কও,
অনাদি অতীত, অনন্ত রাতে কেন চেয়ে রও?
কথা কও, কথা কও।
হে অতীত, তুমি ভুবনে ভুবনে
কাজ করে যাও গোপনে গোপনে
মুখর দিনের চপলতা মাঝে স্থির হয়ে তুমি রও।
হে অতীত, তুমি গোপনে হৃদয়ে কথা কও, কথা দও।
তুমি জীবনের পাতায় পাতায় অদৃশ্য লিপি দিয়া
পিতামহদের কাহিনী লিখিছ মজ্জায় মিশাইয়া।
যাহাদের কথা ভুলেছে সবাই
তুমি তাহাদের কিছু ভোল নাই,
বিস্মৃত যত নীরব কাহিনী স্তম্ভিত হয়ে বও।
ভাষা দাও তারে, হে মুনি অতীত, কথা কও, কথা কও ॥