ভারতীয় পেঁয়াজে সর্বনাশ আমদানিকারকদের
Published : Tuesday, 5 January, 2021 at 12:00 AM
জাগো নিউজ: পাঁচদিন আগেও খাতুনগঞ্জে ৪৫ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে চীন, তুরস্ক, ইউক্রেন, নেদারল্যান্ড ও মিশর থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ। কিন্তু বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ প্রবেশের খবর চাউর হতেই এক ধাক্কায় সেসব পেঁয়াজের দাম নেমে এসেছে অর্ধেকেরও নিচে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখনই যদি ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করা না হয়, তাহলে সংকটের সময় পাশে থাকা আমদানিকারকরা এবার পথে বসবেন।
সোমবার (৪ জানুয়ারি) দেশের সবচেয়ে বড় ভোগ্যপণ্যের বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি আড়তেই চীন, তুরস্ক, ইউক্রেন, নেদারল্যান্ড ও মিশর থেকে আমদানি করা হাজার হাজার বস্তা পেঁয়াজের মজুদ। ভারতীয় পেঁয়াজ বাজারে প্রবেশ করেছে এই সংবাদ পেয়ে অধিকাংশ আড়তদার লোকসান হলেও অন্য দেশ থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পেঁয়াজের দাম আরও কমবে এই আশায় খুচরা বিক্রেতারা তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
ব্যবসায়ীরা জানান, সোমবার খাতুনগঞ্জে ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৫ টাকায়। বিপরীতে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, তুরস্কের পেঁয়াজ ২০ টাকা এবং নেদারল্যান্ড ও চীনা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ টাকা কেজিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন চীন, তুরস্ক, নেদারল্যান্ড ও মিশর থেকে পেঁয়াজের আমদানিকারকরা।
মূলত মাসখানেক আগে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় এসব দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। কিন্তু গত দুই সপ্তাহ ধরে এর দাম কমে ২৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছিল। কিন্তু গতকাল রোববার (৩ জানুয়ারি) সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানির খবর খাতুনগঞ্জে পৌঁছাতেই চীন, তুরস্ক, ইউক্রেন, নেদারল্যান্ড ও মিশরের পেঁয়াজের দাম কমে ঠেকেছে ১৪ টাকায়; দেশি পেঁয়াজের দাম নেমে এসেছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়।
খাতুনগঞ্জে মেসার্স গোলাম ব্রাদার্সের ম্যানেজার মোহাম্মদ বলেন, ‘বাজারে খুব বেশি ভারতীয় পেঁয়াজ প্রবেশ করেছে তা কিন্তু নয়; তবে এ সংবাদটি বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে দিয়েছে। এখন অধিকাংশ পাইকারি বিক্রেতা দাম আরও পড়ে যাওয়ার ভয়ে কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করে দিচ্ছেন। খুচরা বিক্রেতারাও আরও কমে পেঁয়াজ পাবেন সে আশায় বাজারমুখী হচ্ছেন না। এভাবে চলতে থাকলে অধিকাংশ বিদেশি পেঁয়াজ আড়তেই পচে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘ভারতীয় পেঁয়াজ বাজারে আসার খবরে সাধারণ জনগণ ভাবছে পেঁয়াজের দাম কমে যাবে; আসলেও তাই হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ভয়ে কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করে দিচ্ছেন।’
খাতুনগঞ্জের চৌধুরী ট্রেডার্সে গিয়ে দেখা যায়, আড়তের সামনেই বেশ কয়েক বস্তা পচা পেঁয়াজ। জিজ্ঞেস করতেই প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আকবর চৌধুরী জানালেন, এসব পেঁয়াজ মিয়ানমার থেকে আমদানি করা। কিন্তু বর্তমানে বাজারে প্রায় পাঁচ দেশের পেঁয়াজ মজুদ থাকায় মিয়ানমারের পেঁয়াজ বিক্রি করা যায়নি। এখন ভারতীয় পেঁয়াজ আসতে থাকলে বাকিগুলোও বিক্রি করা যাবে না।
আকবর চৌধুরী বলেন, ‘আমরা তো জলে ভেসেছি, কৃষকরাও মরে যাবে; যারা দেশি পেঁয়াজ চাষ করেছেন। ৪৩ থেকে ৪৪ টাকায় তুরস্ক, ইউক্রেন ও নেদারল্যান্ড থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে এখন ১৪ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি করছি। আমদানিকারকরা লাখে হয়তো ৩০ হাজার টাকা পাবেন, বাকি ৭০ হাজার থাকবে না।’
তবে বাজারে ঘুরে ভারতীয় পেঁয়াজের তেমন বেচাকেনা চোখে পড়েনি। আড়তদাররা জানান, গত তিনদিনে মাত্র ২০ ট্রাক ভারতীয় পেঁয়াজ বাজারে প্রবেশ করেছে; যা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খুচরা বাজারে চলে গেছে। কিন্তু ভারতীয় পেঁয়াজ প্রবেশের খবর পুরো বাজারকে অস্থির করে তুলেছে।
প্রায় তিন মাস ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকার পর গত শনিবার পুনরায় ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়েছে । এ নিয়ে গত দুই দিনে ৩১টি ট্রাকে প্রায় ৮০০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ দেশের বাজারে প্রবেশ করেছে।
মিতালী ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মোস্তফা মিয়া বলেন, ‘এই মুহূর্তে যদি ভারতীয় পেঁয়াজটা না আসত, তাহলে যারা বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেছে তারা কিছুটা লাভে থাকত। এখন তারা যা বিক্রি করছে সব লোকসান করে বিক্রি করছে। ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় পেঁয়াজ কিনে এখন ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকায় বিক্রি করছে। আর দেশি পেঁয়াজগুলোর দাম ছিল ৫০ টাকার ওপরে; এখন সেগুলোর দাম হয়ে গেছে ৩৫ টাকা।’
খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, ‘রোববার ৫০ মেট্রিক টনের মতো ভারতীয় পেঁয়াজ খাতুনগঞ্জে এসেছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের গুদামে মজুদ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মিশর, তুরস্ক, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ এখনো চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। এই অবস্থায় স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় পেঁয়াজ আসতে থাকায় চাহিদার তুলনায় শত শত টন বেশি পেঁয়াজ গুদামে মজুদ থেকে যাবে। এতে পেঁয়াজের মূল্যে রীতিমত ধস নেমেছে, এ অবস্থায় পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে বড় ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দেবে।’
প্রসঙ্গত, অভ্যন্তরীণ বাজারে পেঁয়াজের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে গত ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয় ভারত । এতে করে দেশে প্রবেশের অপেক্ষায় ভারতের অভ্যন্তরে আটকা পড়ে ২৫০টি পেঁয়াজবাহী ট্রাক। আরও আটকা পড়ে আমদানির জন্য খোলা ১০ হাজার টনের মতো এলসি করা পেঁয়াজ।
এর পাঁচদিন পর ১৯ সেপ্টেম্বর অনুমতি সাপেক্ষে পূর্বের টেন্ডার করা ১১টি ট্রাকে ২৪৬ টন পেঁয়াজ রফতানি করে ভারত, যার অধিকাংশ পেঁয়াজ পচা ও নষ্ট হওয়ায় পুঁজি হারিয়ে ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন দেশের আমদানিকারকরা। এর ফলে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমদানিকারকরা মিয়ানমার, পাকিস্তান, মিশর, তুরস্ক, নেদারল্যান্ড, ইউক্রেন ও চীন থেকে বিপুল পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানি করেন।