এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া ||
‘কবে
ভ্যাকসিন পাবে বাংলাদেশ ?’ এমন প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর এখনও পায়নি
দেশবাসী। যদিও সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের প থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ
যথাসময়েই ভ্যাকসিন পাবে। কিন্তু, তারপরও জনগণ আশ্বস্ত হতে পারে না। কারণ, এ
পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোন সফলতা জনগণ প্রত্য করে নাই। অন্যদিকে
সরাসরি ভারতের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপরে বরাত দিয়েও তা নিশ্চিত করতে পারেনি
বাংলাদেশ সরকার। ভারত ভ্যাকসিন রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেবার পর বিষয়টা আরো
বেশি অনিশ্চিত হয়ে গেল কিনা এই প্রশ্ন সকলের মনে। ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিয়ে
সম্পাদিত চুক্তিটা বাণিজ্যিক নাকি জিটুজি (সরকার থেকে সরকার), এ নিয়েও
রয়েছে বিপরীত বক্তব্য। তাই করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে ‘ধোঁয়াশা’ পরিস্থিতি
সৃষ্টি হয়েছে।
দেশবাসীর মনে প্রশ্ন করোনা ভ্যাকসিন কবে আসবে, তা নিয়ে এত
বিভ্রান্তি কেন ? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী
ও সচিব বলেছেন, ‘আমরা চুক্তি অনুযায়ী টিকা পাব’; ‘চুক্তির ভিত্তিতে কথা
বলছি’। এখন সেই চুক্তিতে কী আছে, সেটাও তো পরিষ্কার করে বলা হয়নি। জনমনে
প্রশ্ন আসলে কী আছে চুক্তিতে? চুক্তি সম্পর্কে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় বলছে
জিটুজি, আর বেক্সিমকো বলছে বাণিজ্যিক, তাহলে আসলে কোনটা? সবমিলিয়ে ভ্যাকসিন
নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। বেক্সিমকোর এমডি নাজমুল হাসান পাপন তো
বলেছেন যে, তারা যে চুক্তি করেছেন, সেই অনুযায়ী সেরাম ইনস্টিটিউট ভ্যাকসিন
দিতে বাধ্য। এখন চুক্তির পর যদি সেরামের সিইও বলেন যে, তারা এখন দিতে পারবে
না, তাহলে কি তাদের বিরুদ্ধে আইনি পপে নেয়া যাবে।
যেহেতু এটা একটা
জাতীয় সংকট, তাই চুক্তির বিষয় বস্তুটা পরিষ্কার করা উচিত। ভ্যাকসিন নিয়ে
অনেক কথাই সরকার পরিষ্কার করছে না। সরকারকে জনমনে সৃষ্টি হওয়া প্রশ্ন
পরিষ্কার করতে হবে। আমাদের দেশে ওষুধ প্রশাসন অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু,
ডব্লিউএইচও অনুমোদন না দিলে তো হবে না। কারণ, তাদের অনুমোদন ছাড়া এই
ভ্যাকসিন কেউ ব্যবহার করতে পারবে না।
করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে চলমান
বিভ্রান্তি নিরসনে বাংলাদেশ সরকার বা গণমাধ্যম সরাসরি ভারত সরকার বা
সেরামের কোনো ঊর্ধ্বতন কারো বরাত দিতে পারেনি। এ বিষয়ে এই স্বাস্থ্য
বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ‘এখানেই তো প্রশ্নটা, এখানে যদি বাধা না থাকত, তাহলে
অফিশিয়ালি স্টেটমেন্ট আসবে ভারত সরকারের প থেকে যে, বাংলাদেশের েেত্র এই
বিধি-নিষেধ কার্যকর নয়। কিন্তু, এরকম কিছু আসেনি। সেরামের সঙ্গে ভারত
সরকারে চুক্তি অনুযায়ী, তারা যা তৈরি করবে, সবটাই সরকারকে দিয়ে দিতে হবে।
তাহলে সেরামেরও তো সরাসরি বাংলাদেশে বিক্রি করার কোনো সুযোগ নেই।’
এই যে
ত্রিপীয় চুক্তিটা হলো, সেটাতো কেউ দেখেনি বা পড়ে শোনানো হয়নি কিংবা এটা
প্রকাশিত না বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যতটুকু জানি, চুক্তি অনুযায়ী ৫০
লাখ ডোজ করে করে এক মাস পর পর ছয় মাসে তারা আমাদেরকে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন
দেবে। সেই চুক্তিতে নিশ্চয়ই মূল্য নির্ধারণ, ট্রান্সপোর্টেশন-ব্যবস্থাপনা
কীভাবে হবে, কে বা কারা করবে— এসব ছিল। এসব তো আমাদেরকে বা মিডিয়ায় জানানো
হয়নি। তো এই যে বলা হচ্ছে, চুক্তি অনুযায়ী আমরা ভ্যাকসিন পাব, এগুলো তো
“ভেক” কথাবার্তা। সেই চুক্তিটা কী? চলমান জরুরি পরিস্থিতিতে চুক্তির আলোকে
বিষয়টি জনসম্মুখে পরিষ্কার করে বলা উচিত ছিল। চুক্তি তো জনগণের জন্য। এটা
তো কোনো গোপন চুক্তি না। গোপন চুক্তি হলে ধরে নিতে হবে এখানে “লুকোচুরি”র
কিছু আছে।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভ্রান্তি মোচনে ভারত ও বাংলাদেশ
সরকারের প থেকে বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা উচিত। দুই দেশের দ্বিপাকি
সম্পর্কটা হচ্ছে স্পিরিট। ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপাকি
সম্পর্কের আওতায় এই দুই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়টি
হচ্ছে। এ কারণেই জটিলতা তৈরি হয়েছে। তাই দুই সরকারের বিষয়টি পরিষ্কার করা
উচিত। অন্যথায়, বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। যা উদ্বেগের বিষয় হবে।
যাতে করে ভ্যাকসিন নিয়ে জনমনে অনাস্থা তৈরি হতে পারে। ভ্যাকসিনের মান,
ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মনে বিশ্বাস রাখা খুব জরুরি।
ভারত
কয়েক মাসের জন্য অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন রপ্তানির অনুমতি
দেবে না বলে জানিয়েছেন ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান আদর পুনাওয়াল্লা।
ফোনে বার্তা সংস্থা এপিকে দেওয়া এক সাাৎকারে এমন কথাই জানান তিনি। কিন্তু এ
বিষয়টি নিয়ে উল্টো কথা বলছেন সেরাম ইন্সটিটিউটের জনসংযোগ কর্মকর্তা
মায়াঙ্ক সেন। বিবিসি জানিয়েছে, ভারতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার
করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইন্সটিটিউটের মতে, তাদের
টিকা রপ্তানির ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। ইন্সটিটিউটের জনসংযোগ কর্মকর্তা
মায়াঙ্ক সেন জানিয়েছেন, টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার যে খবর প্রকাশিত হয়েছে,
তা পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ তাদের টিকা রপ্তানির ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
ভারতের
পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের টিকা
পাওয়ার েেত্র কোনো সমস্যা নেই। ভারতে উৎপাদিত টিকা বাংলাদেশ প্রথম থেকেই
পাবে। সেরাম-প্রধানের যে বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তা আমাদের নজরে
এসেছে। এতে প্রতিবেশি বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে
টিকা পাঠানো বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনার আওতায় হবে না। পরে ব্যাপকভিত্তিক
উৎপাদন নিশ্চিত করা গেলে বাণিজ্যিক চুক্তির আওতায় সরবরাহ করা হবে। তবে
প্রতিবেশী বাংলাদেশের জনগণ প্রথম থেকেই টিকা পাবে। বাংলাদেশ ও ভারতের
দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা আশাবাদের কথা শোনালেও বাংলাদেশের ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়ে
ধোঁয়াশা রয়েছে। দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানী, ডাক্তার এবং সাধারণ মানুষের
মধ্যে উদ্বেগ কাটছে না।
ভারতের ভ্যাকসিন না দেয়ার খবর আন্তর্জাতিক
গণমাধ্যমগুলোতে প্রচার হওয়ায় সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেছে। তবে
বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ভ্যাকসিন নিয়ে চীনের সঙ্গে
করা চুক্তি ফাইলবন্দি রেখে ভারতের মাধ্যমে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন কেনার
চুক্তি করায় বৈশ্বিক মহামারি করোনার ভ্যাকসিন বাংলাদেশের পাওয়া অনিশ্চিত
হয়ে গেছে। অথচ বিশ্বের বহু দেশে করোনাভাইরাসের টিকা প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে।
এমনকি গরিব কিছু দেশও ভ্যাকসিন পাওয়া নিশ্চিত করে ফেলেছে।
বর্তমান
পরিস্থিতিতে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন যে, ‘ভারত সরকার দুই-আড়াই ডলারে পায়,
তাহলে আমরা কেন পাঁচ ডলারে কিনব? এখানে কাউকে বাণিজ্যের সুযোগ দেওয়া হয়েছে
কি না?’ এই বিষয়গুলোও পরিষ্কার করার দায়িত্ব সরকারেরই। সরকারের যে স্বচ্ছ,
সেটা মানুষের মাঝে প্রমাণিত হতো চুক্তির বিষয়ে সবাই জানলে। কিন্তু, এগুলো
গোপন রাখার কারণে সরকার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
মনে রাখতে
হবে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা অন্য কারো স্বার্থ সংরণের জন্য তো সরকার
না। এই যে ভ্যাকসিন নিয়ে ধোঁয়াশা, মানুষের মাঝে সন্দেহ-উদ্বেগ, মিডিয়া ও
বিশেষজ্ঞদের ওপর দোষ দেওয়া হচ্ছে যে, তারা সমালোচনা করছে। এখন এই সুযোগটাই
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেন তৈরি করে দিয়েছে? তারা কেন পরিষ্কারভাবে সব তুলে
ধরছে না? জনগণ সব জানলে তো তাদের মাঝে আর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ত না।
পরোভাবে এই সুযোগটা তো তৈরিই করে দেওয়া হচ্ছে।
লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক।