হিমাদ্রিশেখর সরকার ||
‘সাধনা না করিয়া আত্মপ্রকাশ করিতে নাই। আর সাধনা যাহা করিবেন নীরবে নীরবেই করিবেন। আগুন কখনো ছাই ঢাকা থাকে না। আপনার প্রতিভাও একদিন নিশ্চিত সুধীজন সমাজে আদৃত হইবে।'-উদ্ধৃতিটি একটি মতামতধর্মী চিঠির অংশবিশেষ। চিঠিটি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন তারিখে গোকনঘাট, জেলা ত্রিপুরা থেকে লেখা হয়। পত্রলেখক পরবর্তীকালের ব্রাত্যজীবনের মহান কথাকার, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-খ্যাত ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-৫১)। তখন তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে একাদশ শ্রেণীর ছাত্র আর পত্রপ্রাপক উদীয়মান কবি মতিউল ইসলাম (১৯১৪-৮৪) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জর্জ হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। প্রায় সমবয়সী দুজনেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান। মতিউল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থের পান্ডুলিপি পাঠ করে অদ্বৈত মল্লবর্মণ উপর্যুক্ত মন্তব্য করেন।
পরবর্তীকালে দুজনেই সাহিত্য-সাধনা করেছিলেন। দুজনেই তাদের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন বলা যায়। দুজনের প্রতিভাই সুধীজন সমাজে আদৃত হয়েছিল। তার কবিকৃতির জন্য কবি মতিউল ইসলাম ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ পেয়েছিলেন। তবে জীবৎকালে অদ্বৈতের কোন খ্যাতির কথা শোনা যায়নি। মৃত্যুর ৫ বছর পর তার মহাকাব্যিক গ্রন্থ ‘তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৫৬ খ্রি.) প্রকাশিত হলে পর তার সাহিত্য-খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তখনি তিনি সুধীজনের নজরে আসেন।
আজ দেশে-বিদেশে অদ্বৈতর খ্যাতি। তার ‘তিতাস’ একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। হয়েছে সিনেমা, নাটক, কলেজপাঠ্য। অদ্বৈতর সাহিত্যকর্ম নিয়ে গবেষণা হচ্ছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়সহ ব্যক্তিগত পর্যায়ে। লেখা হয়েছে একাধিক জীবনীগ্রন্থ। তার প্রথম জীবনীগ্রন্থ (প্রকাশকাল- ১৯৮৭, বাংলা একাডেমি) লিখে এদেশে অদ্বৈতকে জনসমক্ষে আনার কৃতিত্ব যার তিনি হলেন চাঁদপুরের কৃতীসন্তান বিশিষ্ট লেখক-গবেষক অধ্যাপক শান্তনু কায়সার (১৯৫০-২০১৭)। আর বাংলাদেশে সম্প্রতি অদ্বৈত-এর জীবনকে কেন্দ্র করে তাকে নিয়ে প্রথম জীবনোপন্যাস লিখলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরেক কৃতীলেখক মানিকরতন শর্মা। উপন্যাসটির সাদামাটা নাম ‘অদ্বৈত’। অবশ্য এর আগেও শর্মাজী অদ্বৈতকে নিয়ে ‘অদ্বৈত অন্বেষণ’ নামে একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ প্রকাশ করেন ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জয়দুল হোসেন, মনজুরুল আলম, সাজেদুল আউয়াল-এর মত মানিকরতন শর্মাও একজন অদ্বৈত-গবেষক।
মানিকরতন তার ‘অদ্বৈত’ উপন্যাসটিতে অদ্বৈতের জীবনকে তিনটি পর্বে ভাগ করে দেখিয়েছেন। প্রথম পর্বটিকে বলা যায় ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া-পর্ব বা গোকনঘাট-পর্ব’। যেখানে অদ্বৈতর জন্ম-লেখাপড়া ও বেড়ে উঠা। ১৯১৪ থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ অদ্বৈতর জীবনের এই ২০ বছর ধরা আছে প্রথমপর্বে। ১১২ পৃষ্ঠার নাতিদীর্ঘ উপন্যাসে ৭৩ পৃষ্ঠা পর্যন্ত এর বিস্তৃতি । মাত্র ৩৭ বছরের জীবনে অদ্বৈতর ২০ বছর কাটে তিতাসপাড়ের নিজগ্রাম গোকর্ণঘাট ও নিজ মহকুমাশহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। মাত্র এক বছরেরও কম সময় তিনি কুমিল্লা শহরে অবস্থান করেন ভিক্টোরিয়া কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন। গৃহশিক্ষক অদ্বৈতকে জীবিকার তাগিদে পড়াশুনা অসমাপ্ত রেখে কলকাতায় পাড়ি জমাতে হয় ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে। এই কাজে তাকে সাহায্য করেন শ্রীকাইলের কৃতীসন্তান ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৪-১৯৪৯)। কলকাতাতেই অদ্বৈতের জীবনাবসান হয় ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল, আত্মীয়স্বজনহীন নিঃসঙ্গ পরিবেশে। তার কলকাতা-জীবন মাত্র ১৬ বছরের। তিনি যা কিছু লিখেছেন ও প্রকাশ করেছেন তা কলকাতা বসেই। এই সময়েই তিনি লিখেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’(১৯৪১), ‘শাদা হাওয়া’ (১৯৪৮), ‘রাঙামাটি’(১৯৬৪), ‘জীবনতৃষা’ (১৯৫০), ‘ভারতের চিঠি, পার্ল বার্ককে (১৯৪৪)। এছাড়াও কিছু ছোটগল্প ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেন।
ঔপন্যাসিক মানিকরতন শর্মা অদ্বৈতের জীবনের উপর যতটুকু আলো ফেলেছেন তার চেয়েও বেশি নজর দিয়েছেন তার মালো সম্প্রদায়ের (কৈবর্ত) দারিদ্র-পীড়িত জীবনের প্রতি। উপন্যাসে তিনি তুলে এনেছেন দারিদ্রতার পাশাপাশি তিতাসপাড়ের মালোদের লোকজ-জীবন। তাদের ব্যবহৃত লোকজ শব্দাবলি ও সঙ্গীতের ব্যবহার মানিক শর্মার উপন্যাসটিকে একটি লোকজ চরিত্র দিয়েছে। যা এতদাঞ্চলের মানুষের লোকজ-জীবন ও ভাষাকে জানতে সাহায্য করবে। ‘অদ্বৈত’ উপন্যাসটিতে আমরা দেখবো অদ্বৈতের সেই বিড়ম্বিত-জীবন যেখানে গোকনঘাট থেকে কলকাতার নারকেলডাঙার ষষ্ঠীতলার সেই ভাড়া করা চিলেকোঠা-যেখানে তিনি যক্ষèারোগে আক্রান্ত হয়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। উপন্যাসে আমরা দেখি, গোকনঘাট থেকে কলকাতা সবখানেই তিনি কাঁচা মরিচ দিয়ে পান্তাভাত খাচ্ছেন। পাঠক দেখবেন, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দারিদ্রতার সঙ্গেই লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন এই অকৃতদার মানুষটি। যে অদ্বৈতকে আমরা তার আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘তিতাস’-এ খুঁজে পাই একই অদ্বৈতকে আমরা পাই মানিকরতন শর্মার ‘অদ্বৈত’ উপন্যাসেও।
‘অদ্বৈত’ মানিকরতন শর্মার প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস। তিনি প্রথম উপন্যাসটির বিষয়বস্তু করেছেন একজন লেখকের জীবন। এ ধরণের উপন্যাস লেখা সহজ কাজ নয়। আর এই কঠিন কাজটি শর্মাজী করেছেন অনেক সাহসিকতার সাথে। লেখকের ভাষা ব্যবহার ও প্রকাশভঙ্গী সাবলীল। তার গদ্যের কিছু নমুনা এখানে না দিয়ে পারছি না।- ‘নদীতে নদীতে ভাব হয়, মিল হয় কিন্তু কেউ কারো আদর্শরীতি গ্রহণ করে না। কখনো চলনে ধরনে বলে আমি শীতলক্ষ্যা, আমি গোমতী, আমি বিজয় নদী। তিতাস হচ্ছে একটিমাত্র নদী, যা মালোদের একমাত্র আশ্রয়। যার চরণে ভাসে পূজার ফুল, দুর্বা, কখনো অনাথ মালোর চোখের জল। তার বুকে কাটে চঞ্চল বালকের অবাধ সাঁতার, পাছে মায়ের বকুনি জোটে কপালে। এমন নদীতে চইয়া নাও করে বৌ-ঝিয়েরা যায় নাইয়র বেড়াতে। কিংবা দূর দূরান্ত থেকে খড়মপুর মাজারগামী ভক্তরা যায় মরমী ধ্যানে। মালোরা পুরুষ পরম্পরায় তিতাসকে পেয়েছে আত্মার জ্ঞাতি আর জীবন নির্মাণের সারথি হিসেবে।’ [পৃষ্ঠা -০৯]
উপন্যাসটি প্রমিত বাংলায় লেখা হলেও আঞ্চলিক শব্দাবলি ও ভাষার ব্যবহার এটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। যা পাঠককে খুবই টানবে। বইটি লিখতে গিয়ে লেখকের দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়েছে তা বইটি পড়লে বুঝা যায়। তবে তিনি যদি সহায়ক বইগুলোর একটি তালিকা বইয়ের শেষে দিতেন তাহলে আগ্রহী পাঠকের বইটির বিষয়বস্তু জানা-বোঝার আরো সুবিধা হতো। নতুন প্রজন্মের পড়ার আগ্রহটা আরো বেড়ে যেতো।
‘অদ্বৈত’ উপন্যাসটির হাজ্জাজ তানিন-এর করা প্রচ্ছদ মনকাড়া। বইয়ের কাগজ, ছাপা, বাঁধাই উন্নতমানের। বইটি পাঠে পাঠকের সামনে একটি নতুন চিন্তার জগৎ উন্মোচিত হবে একথা আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। আর মানিকরতন শর্মা এই বইটি লিখে যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন এ জন্য তাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।
‘অদ্বৈত’
মানিকরতন শর্মা
প্রকাশক-‘বেহুলা বাংলা’। ৬১, কনকর্ড এম্পোরিয়াম, কাঁটাবন, ঢাকা।
পরিবেশক-রকমারি ডটকম, মূল্য- ২৭৫ টাকা, ২৭৫ রুপি, পৃষ্ঠা- ১১২
.................................................................................................................
হিমাদ্রিশেখর সরকার ঃ প্রাবন্ধিক, গবেষক ও ছোটগল্পকার। পবষষ ০১৭২০২১২৮৫৬ বসধরষ ংযবশযড়ৎযরসধফৎর@মসধরষ.পড়স