মাতৃভাষা শেখার জন্য অতটা কাঠ-খড় পোড়াতে হয় না, পরিবারের সদস্য থেকেই
শিশুরা প্রথমে মাতৃভাষায় শিক্ষা নেয়। তথাপি চারপাশের পরিবেশ বিদ্যালয়
ইত্যাদি হতে সংস্কৃতি এবং দেশের ইতিহাস খুব সহজেই বেসিক জানতে পারে। এতে
তেমন একটা পড়ালেখার প্রয়োজন হয় না এবং পরবর্তীতে অক্ষরজ্ঞান হলে তখন আরও
বিশদ জানতে পারে।
কিন্তু বড় বিপত্তি হচ্ছে আমরা যারা পরিবার নিয়ে বিদেশে থাকি; বাবা মার
মুখ থেকে শিশুরা কিছু বাংলা ভাষা আয়ত্ত করতে পারে কিন্তু তা খুবই অপ্রতুল
যা কোনোভাবেই বাংলাকে পুরোটা উপস্থাপন করতে পারে না। কারণ বাবা-মা যে ঘর
গৃহস্থলীর ভাষাগুলো ব্যবহার করেন তা চার দেয়ালের মধ্যে ভাষা। অর্থাৎ
পারিবারিক কথোপকথনে গুটিকয়েক শব্দমালায় তার আয়ত্ত করতে পারে। যা বাংলা
ভাষার খুবই একটা ক্ষুদ্র অংশ।
হাজারো ইচ্ছা থাকার পরেও বাবা-মা সন্তানকে বাংলা ভাষা সংস্কৃতি এবং
দেশের ইতিহাস সম্পর্কে পুরো ধারণা দিতে পারে না। কেননা শিশুদের সাথে যে
সময়টুকু পাওয়া যায় তা খুবই অপ্রতুল। বাংলাদেশের বিশাল গৌরবের ইতিহাস,
সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এই জিনিসগুলো সম্পর্কে ধারনা দেয়ার জন্য খুবই সামান্য।
তাছাড়া ইতিহাস সংস্কৃতি সাধারণত কিছুটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন
হয়। আমাদের প্রবাসে বলতে গেলে খুব কমসংখ্যক দেশেই আছে যে বাংলায় স্কুল
তৈরি হয়েছে অথবা তৈরি হলেও তা কাগজে-কলমে রয়েছে অথবা শুরু হলেও তা স্থবির
হয়ে আছে।
পৃথিবীর ভূস্বর্গ খ্যাত সুইজারল্যান্ডের জুরিখে একদল প্রগতিশীল মানুষের
উদ্যোগ এবং শ্রমে গড়ে তুলেছেন বাংলা স্কুল জুরিখ। তাদের যাত্রা অতি পুরনো
হলেও বর্তমান মহামারীর প্রেক্ষাপটে একটি ভিন্ন রূপ লাভ করেছে। তাদের বাংলা
শিক্ষা কার্যক্রম অনলাইনে চালু করেছে ফলে জুরিখ শহরের বাইরে
সুইজারল্যান্ডের অন্যান্য শহরের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে
ছড়িয়ে পড়েছে।
বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশি শিশুরা বাংলাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখার
সুযোগ পাচ্ছে। শুধু অক্ষর জ্ঞান নয় সংস্কৃতি, দেশের গৌরবের ইতিহাস, ঐতিহ্য
ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারছে। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে
এবং শিশুদের শিক্ষাকালীন বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের মধ্যে
বাংলা ভাষাকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
আমিও পর্তুগালে ঠিক একই প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছি সন্তানকে বাংলা
শিক্ষা দিতে গিয়ে। তবে আমার প্রতিবন্ধকতাটা আরও বেড়েছে আমার সন্তানের
আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায়। ভাষা বুঝে ওঠার সাথে সাথেই বাংলার প্রতি কৌতূহল তার
বাড়তে শুরু করে। বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চাওয়া, বাংলা শেখার ইচ্ছাটাও
দিনে দিনে প্রবল হতে থাকে। দেশ মাতৃভাষার প্রতি টান একটা গৌরবের বিষয়।
যদিও আড়াই বছর বয়সে তার দেশ ছেড়ে বিদেশে অবস্থান করছে।
আমি আমার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। তবে সে চেষ্টায় পথিকৃৎ হয়ে ধরা
দিয়েছে বাংলা স্কুল জুরিখ। শুধু তাই নয় গত ১৬ ডিসেম্বর দেশ এবং মাতৃভূমি
শিক্ষার্থীর চিত্রকর্মকে মুদ্রিত করে তাদের নিকট ডাকযোগে পাঠিয়ে দেয়া
হয়েছে। বিষয়টা একদৃষ্টিতে খুবই সাধারণ মনে হলেও শিশুদের আনন্দের জোয়ার
ছিল তা মোটেও সাধারণ নয় এবং নিজের মাতৃভূমি একটা ছবি এভাবে স্বীকৃতি
পাওয়াটা আমার সন্তানের জন্য ছিল একটা বিশাল অর্জনের মত। ফলে বাংলা তার
মাঝে আরও বিশাল করে ধরা দিয়েছে। প্রতিটি কথোপকথনেই সে জানতে চায় বাংলার
উপস্থাপন যা আমাকে একজন বাংলাদেশি হিসেবে গৌরবান্বিত করে।
আমাদের সন্তানদের জন্মভূমিকে জানার এই আগ্রহ কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসার
বহিঃপ্রকাশ বলা চলে। আর এই বাংলা ভাষার প্রতি এই আকর্ষণকে প্রাতিষ্ঠানিক
রূপ দান করার জন্য বাংলা স্কুল জুরিখের সকল কলাকুশলীদেরকে অভিনন্দন এবং
প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। তথাপি আমাদের প্রচেষ্টায় বিশ্বের মাঝে লাল সবুজের আলো
ছড়াবে এবং আমরা গৌরবের ইতিহাসের প্রতিফলন বিশ্বের দরবারে সার্থকভাবে
উপস্থাপন করতে সক্ষম হব। বেঁচে থাকুক দেশপ্রেম প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে।