ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
মুক্তিযুদ্ধচলাকালে অস্থায়ী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষন ক্যাম্প ‘নলআরা’য় ‘স্মৃতিস্তম্ভ’
এবিএম আতিকুর রহমান বাশার
Published : Saturday, 23 January, 2021 at 4:53 PM
মুক্তিযুদ্ধচলাকালে অস্থায়ী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষন ক্যাম্প ‘নলআরা’য় ‘স্মৃতিস্তম্ভ’মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষায় দেবীদ্বার উপজেলার পূর্ব ফতেহাবাদ গ্রামের ‘নলআরা’য় (এক সময়ের গভীর জঙ্গল) প্রতিষ্ঠা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের অস্থায়ী প্রশিক্ষন ক্যাম্পের স্থানে ‘স্মৃতিস্তম্ভ’। কুমিল্লা-৪ দেবীদ্বার নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের সহযোগীতায় এবং উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রায় ৬ লক্ষ টাকা প্রাক্কলন ব্যয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ‘অনিক এন্টার প্রাইজ’ ওই ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মান করতে যাচ্ছেন।
            
স্থানীয়রা জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লা দেবীদ্বার উপজেলার ৬নং ফতেহাবাদ ইউনিয়নের ফতেহাবাদ গ্রামের জমাদার বাড়ি সংলগ্ন ‘নল আরা’য় (এক সময়ের গভীর জঙ্গলে) অস্থায়ী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষন ক্যাম্প’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী-পরিষদ সচিব সফিউল আজমের একান্ত সচিব আবদুল মান্নান সরকারের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে পর্যায়ক্রমে প্রায় ৪/৫ শত মুক্তিকামী জনতা এয়ারগান আর লাঠি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষন শেষে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে চুড়ান্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ে ঝাপিয়ে পড়েন। ওই প্রশিক্ষন শিবিরের প্রশিক্ষক ছিলেন সেনাবাহিনীর (অবঃ) সদস্য আবু মিয়া এবং মুকবল আহমেদ।

মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের সীমান্ত এলাকা সন্নিকটে থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্ত পাড়াপাড়ে যেমন সহজ ছিল, তেমনি তৎকালিন পূর্বপাকিস্তানের প্রধান সেনাছাউনী কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনম্যান্ট সন্নিকটে থাকায় মাত্মক ঝুকিতে ছিলেন এ এলাকার মানুষ। মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ ও নির্জন এলাকা হওয়ায় ওই ‘নলআরা’ নামক গভীর জঙ্গল’টিকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন ক্যাম্প হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন ¯’ানীয় মুক্তিকামী যোদ্ধারা। এখান থেকে প্রাথমিক প্রশিক্ষন শেষে যোদ্ধারা ভাতের ত্রীপুরা রাজ্যের বক্সনগর, আগড়তলার পালাটোনা ক্যাম্প ও আসামের লোহারবন তেজপুর প্রশিক্ষন শিবিরে যোগদান করতেন। আফসু রাজাকার’র নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনী সক্রিয় হওয়ায় পরবর্তীতে উক্ত অ¯’ায়ী প্রশিক্ষণ শিবিরটি পরিত্যাক্ত ঘোষনা করা হয়। তবে ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্রইউনিয়ন কর্তৃক গঠিত আসামের (ভারত) লোহারবন তেজপুর মুক্তিযুদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরের শাখা এলাহাবাদ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পটি মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও কিছুদিন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল।
 
একসময় দিনের বেলায় দেবীদ্বার উপজেলার পূর্ব ফতেহাবাদ গ্রামের ওই নলআরায় অর্থাৎ গভীর জঙ্গলে একা যেতে কেউ সাহস পেতেন না স্বাধীনতা যুদ্ধের পর গত ৪৯ বছরে এ জঙ্গলের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে, জঙ্গল কেটে আবাসন ও আবাদী জমি তৈরী হয়েছে। আর্টিফিশিয়াল বনায়ন করা হয়েছে।

এ ¯’ানটিকে স্মরনীয় করে রাখতে দেবীদ্বার উপজেলা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে ২০১০ সালের ১২ মার্চ ওই ¯’ানে ‘৭১’র চিঠি পাঠ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলনী’র আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও কলামিষ্ট মোনায়েম সরকার’র সভাপতিত্বে এবং সাংবাদিক, লেখক, কলামিষ্ট, রাজনীতিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক এ,বি,এম আতিকুর রহমান বাশার’র সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপ¯ি’ত ছিলেন কুমিল্লা-৪ (দেবীদ্বার) নির্বাচনী এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য, সরকারী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কীত সংসদীয় ¯’ায়ী কমিটির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী, সচিব ও জাতীয় সংসদের প্যানাল স্পিকার এবিএম গোলাম মোস্তফা, চিঠিপাঠ অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ.আ.ম.স আরেফিন সিদ্দিক, বিশেষ অতিথি ছিলেন কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং-ব্রাক্ষনপাড়া) নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য ও সাবেক আইন মন্ত্রী এডভোকেট মতিন খসরু, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় উপদেষ্টামন্ডুলীর সদস্য এএফএম ফখরুল ইসলাম মূন্সী, দেবীদ্বার উপজেলা পরিষদ’র সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান কুমিল্লা-৪ (দেবীদ্বার) নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হুমায়ুন কবির, সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মামুনুর রশীদ ভূইয়া সহ দেশবরেণ্য ব্যাক্তিবর্গরা উপ¯ি’ত ছিলেন।
 
ওই অনুষ্ঠানের পর সরকার ও প্রশাসনের নজরে আসায় জেলা পরিষদের তত্বাবধানে নলআরায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানের উদ্যোগ নেয়া হয়।
 
স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে ভারত ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অ¯’ায়ী প্রশিক্ষন ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। দেবীদ্বার উপজেলায় ওই সময় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গঠিত প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা মন্ডুলীর সদস্য ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নিজ গ্রাম এলাহাবাদ, ফতেহাবাদ গ্রামের নলআরায় এবং শুভপুর গ্রামে আরো একটি সেটেলাইট মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প সহ তিনটি অ¯’ায়ী প্রশিক্ষন ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। তারই একটি ‘নলআরা’, এ ¯’ানটি স্মরণীয় করে রাখতে জেলা পরিষদের অর্থায়নে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

২০১১ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে ‘নলআরা’য় মুক্তিযুদ্ধের অ¯’ায়ী প্রশিক্ষন ক্যাম্পে একটি ‘স্মৃতিফলক’ নির্মাণ করা হয়। ২০১১ সালের ৪ এপ্রিল দেবীদ্বার ডাক বাংলোতে কুমিল্লা-৪ (দেবীদ্বার) নির্বাচনী এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক সরকারী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কীত সংসদীয় ¯’ায়ী কমিটির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী, সচিব ও জাতীয় সংসদের প্যানাল স্পিকার এবিএম গোলাম মোস্তফার সভাপতিত্বে এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মামুনুর রশীদ ভূইয়া, মুক্তিযোদ্ধা, গন্যমান্য ব্যাক্তি ও গনমাধ্যম কর্মীদের উপ¯ি’তিতে এক সভায় ‘নলআরা’ মুক্তিযুদ্ধের অ¯’ায়ী প্রশিক্ষন ক্যাম্পের স্মৃতিফলক নির্মান কমিটি গঠন করা হয়।

ওই বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিফলক নির্মানের লক্ষ্যে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুস সামাদ’কে আহবায়ক করে ৫ সদস্যের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিফলক নির্মাণ কমিটি করা হয়েছিল। ওই কমিটির সদস্য ছিলেন, ¯’ানীয় মুক্তিযোদ্ধা সুলতান আহমেদ, ¯’ানীয় সমাজ সেবক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম জমাদার, উপজেলা প্রকৌশলী এবং দেবীদ্বার উপজেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, সাংবাদিক, লেখক, কলামিষ্ট, রাজনীতিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক এবিএম আতিকুর রহমান বাশার। ওই সালে জেলাপরিষদ কর্তৃক প্রাপ্ত বরাদ্ধ ৫০ হাজার টাকায় একটি ‘স্মৃতি ফলক নির্মান করা হয়েছিল।