কায়সার হেলাল||
এ ‘রঙওয়ালা’ কেমন রঙওয়ালা? কেমন রঙের খবর পাঠকের সামনে পেশ করেছেন কবি? সে আলোচনা পরে হবে। বরং এই ফাঁকে জানিয়ে দিই এক টুকরো ঘরের খবর। কোন এক আড্ডায় কবির জবানে কবিপতœীর শ্লেষ মাখা অনুযোগের আদি-অন্ত শুনেছিলাম আমরা। কবিপতœী নাকি কবিকে একদিন প্রশ্ন করছেন- ‘আচ্ছা, এই যে কবিরা, যারা বিষয়-আশয়ের প্রতি একদম নজর দেন না, অস্থির জীবন-যাপনে অভ্যস্থ, কেমন ভাবলেশহীন থাকেন এরা, যেন এ জগতে নয় অন্য কোথাও মন পড়ে আছে, তাঁরা এমন কেন?’ কবিও প্রশ্ন ছুঁড়লেন- ‘তুমি যখন সন্তান-সম্ভবা ছিলে, সন্তান ভুমিষ্টের দিনক্ষণ ক্রমশ আসন্ন, বিশেষ করে আট মাসের সময়ে তোমার কেমন বোধ হতো? কেমন আচরণ করতে তুমি?’ কবিপতœী যেন বিষম খেলেন। ‘তখন অল্পতেই রেগে যেতাম, কিছু খেতে ভাল্লাগতো না, অথবা এমন কিছু খেতে ইচ্ছে হতো যা হয়তো একদম নাগালের বাইরে। কোন কারন ছাড়াই বিরক্তবোধ করতাম। মনে হতো এক উন্মুল হাহাকার যেন তাড়া করে ফিরছে আমাকে।’ সামলে নিয়ে কবিপতœী যোগ করলেন। ফিরতি জবাবে কবি গভীর চিন্তামগ্ন। মিনিট পাঁচেক পর তিনি মুখ খুললেন। ‘প্রকৃত কবির চিরকালই গর্ভকালীন আট মাস, চিরকালই তাঁর গর্ভযাপন, কবি তাই গতানুগতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন। কবি মাত্রেই চির-পোয়াতি রাঙা মানব, কখনো তিনি রঙওয়ালা বনে যান, কখনো অপর মহারঙওয়ালার রঙে নিজেকে রাঙান।’ গলার স্বর খাদে নামিয়ে তিনি কথোপকথনে ইতি টানলেন।
২
প্রকৃত প্রস্তাবে নিজের অহমকে শাসন করবার মতো সাহস না জন্মালে কবি হয়ে উঠা সহজ নয়। কবি হালিম আবদুল্লাহ’র এই সাহস আছে। আছে অসম্ভব বিনয়। প্রমাণ পাই তাঁর ‘রঙওয়ালা’ কাব্যে। স্বয়ং রঙওয়ালা তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছেন। দরজায় কড়া নাড়ছেন। হাজার নির্ঘুম রাতের প্রতীক্ষার পর রঙওয়ালা এলেন। কবি নিশ্চিত জানতেন ‘তিনি আসছেন’। কবি তাঁর পদশব্দ শুনছেন, শুনছেন কন্ঠস্বর। তিনি আসছেন বলেই ‘মেঘে মেঘে উল্লাস/ আকাশে বাতাসে ওলট পালট/ পাখ-পাখালির ঘরে জমে উঠেছে নবান্নের উৎসব।’ তিনি আসছেন বলেই ‘অষ্টাদশী মেয়ের বুকে উথালি পাথালি প্রেম/ বাউলের একতারায় অপ্রাকৃত সুর।’ তিনি আসছেন বলেই কবির ‘দেহের অভ্যন্তরে মাদল বাজছে দ্রিমি দ্রিমি।’ অথচ কবি নিজের মলিন গাত্র নিয়ে তাঁর সে মনের মানুষের নিকটে যেতে লজ্জায় কুঁকড়ে আছেন। এই মহাআনন্দের দিনে তিনি নিজেকে না রাঙিয়ে কী করে রঙওয়ালার কাছে যাবেন? কিন্তু নিজেকে রাঙানোর কোন উপকরণ হাতের কাছে নেই। আছে কেবল ছুরি। তা দিয়েই নিজের গলা কেটে নৃত্যরত অবস্থায় রক্তের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে রঙওয়ালার কাছে যাবেন বলে মনঃস্থির করলেন। শেষে কী হলো? তিনি পৌঁছুলেন কী তাঁর আরাধ্য মনের মানুষের কাছে? আমরা তা জানতে পারি না। তবে কবির এই দশাকে মেলাতে পারি অপরাপর অসংখ্য কবির কবিতা বা গীতিকবিতার সাথে। ‘মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর’ গীতিকবিতায় কাজী নজরুল ইসলামও একই অভিজ্ঞতার বয়ান করছেন গানে গানে। নজরুল জানাচ্ছেন মহাআনন্দের এই ক্ষণে সেই ‘মনোহর’ তাঁর শিয়রে বসে চুপি চুপি নয়ন চুমেছেন, আর আবেশে নিজ দেহ বিকশিত হবার দাবীও করছেন। এই ‘মনোহর’কে তিনি কখনো নটবর, কখনো দেবতা নামেও ডেকেছেন। কিন্তু ‘স্বপনে কি যে কয়েছি তাই গিয়াছো চলি’ বাক্যে কবির চূড়ান্ত আক্ষেপ টের পাই আমরা। নটবরের আবেশ থেকে গেলো ঠিকই, অথচ নটবরের দেখা মিললো না। অর্থ্যাৎ হালিম আবদুল্লাহ’র ‘রঙওয়ালা’ কিংবা কাজী নজরুলের ‘নটবর’ যেন একই সত্তা। এই সত্তার আগমন টের পাওয়া যায়, কিন্তু দেখা পাওয়া কিংবা দেখা পেলেও ধরে রাখা হয়তো কখনোই যায় না। রাধা ও কৃষ্ণের সাময়িক প্রেম ও চিরবিরহের মতো আনন্দ ও আক্ষেপের যুগপৎ মিশেল যেন এই ভাবধারার কবিদেরকে জীবনভর ধাওয়া করে বেড়ায়। দুঃখবোধের এমন আন্তর্জাতিকতা আমরা আরও দেখতে পাবো ত্রয়োদশ শতকের জগৎখ্যাত সুফিধারার কবি, দার্শনিক ও সংগীতজ্ঞ আমীর খসরু’র অজস্র গজলে। ‘শাবান-এ-হিজরান দরাজ চুস জুলফ্, ওয়া রোজ-এ-ওয়াসলত চো উমের কোটাহ্। সখী, পিয়া কো জো ম্যাঁয় না দেখুঁ, তো ক্যায়সে কাঁটু আন্ধেরি রাতিয়াঁ।’ পন্ডিত আমীর খসরু এখানে জানাচ্ছেন- ‘এই বিরহের রাত কুঁচবর্ণ কেশের মতো দীর্ঘ, অথচ আমাদের মিলনপর্ব জন্ম ও মৃত্যুর অনিশ্চিত ক্ষণের মতো স্বল্প। সখী, প্রিয়তমের সঙ্গে যদি আর না হয় দেখা, কেঁদে কেঁদেদীর্ঘ অন্ধকার রাত কী করে কাটাবো!’ বলতে দ্বিধা নেই আমীর খসরু’র ‘প্রিয়তম’ ও হালিম আবদুল্লাহ’র ‘রঙওয়ালা’ ভিন্ন কেউ নন।
সম্ভবত কবি হালিম আবদুল্লাহ ‘রঙওয়ালা’ নামটি গ্রহণের ক্ষেত্রে সুফি আমীর খসরু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকবেন। কথিত আছে যুবক আমীর খসরু প্রথমবারের মতো তাঁর পীর বিখ্যাত সুফি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সাক্ষাৎ পাবার পর অনুপ্রাণিত হয়ে ‘আজ রাং হে রি মা’ নামের অনন্য এক কালাম লিখেছিলেন। পরম আনন্দিত অবস্থায় বাড়ি ফিরে এসে আমীর খসরু তাঁর মাকে বর্ণনা করছিলেন নিজামুদ্দিনের দরবারে সদ্যপ্রাপ্ত অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেছিলেন ‘জগৎ জুড়ে বইছে স্বর্গীয় আলোকচ্ছটা’ কারন যে ব্যক্তিকে আমি এতোকাল সন্ধান করেছি তাঁর দেখা আজ পেয়েছি। ঐ সময় থেকেই এই কালাম কাওয়ালী হিসেবে এতোটাই জনপ্রিয়তা পায় যে বিভিন্ন খানকা ও দরগায় এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি কোন কোন সুফি অনুসারিদের বিধানেও এটি জায়গা করে নেয় পালনীয় কর্তব্য হিসেবে। কী আছে সেই গীতিকবিতায়? আছে রঙের অতুলনীয় কথন। সুফি আমীর খসরু তাঁর মাকে বলছেন, ‘সেখানে কেবল রঙের খেলা, সর্বত্র কেবল রঙ, সবার উত্তরীয়তে রঙের ছটা, মাহবুবের রঙে তামাম দুনিয়া উদ্ভাসিত। আমার উত্তরীয়ই শুধু ময়লা।’ এমন রঙের রশ্মি তো কখনো খসরু দেখেন নি। ‘আমাকেও তোমার রঙে রাঙিয়ে দাও হে নিজামুদ্দিন। আর বিনিময়ে কী দেবো আমি? তুমি বরং আমার এই উদীয়মান যৌবন গ্রহণ করো।’-পীর নিজামুদ্দিনকে এভাবেই বন্দিত করেছেন আমীর খসরু তাঁর উল্লেখিত গীতিকবিতায়। কবি হালিম আবদুল্লাহ’র রঙওয়ালা ও রঙের ধারণাও সুফিমতের একই উৎস হতে আগত বলে ধারনা করা যায়। এবং বলা যায় একই ভাবধারা ধরে রেখেছেন তিনি তাঁর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায়। যেমন ‘আগুন হয়ে গেলাম’ কবিতায় ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও যৌনতার অধীন মানুষের উদ্দেশ্যে কবি রুপকের আবরণে দিয়েছেন মুক্তির সুফি নিদান। ‘রঙ’ লেগেছে এই কবিতায়ও। ‘আমি আর আমার সঙ্গী আগুনের প্রত্যাশায় পাহাড় চূড়ার অনুগামী হই।/ আমরা ক্ষুধার্ত ছিলাম এবং আমাদের তীব্র যৌনতৃষ্ণা ছিল।/ চূড়ায় উঠে দেখি একজন সবুজ গাত্রবর্ণের যুবা পুরুষ/ তাঁর গায়ে আগুন জ্বলছে এবং তিনি পুড়ছেন না/ তিনি আমাদের বললেন, আস আগুন নিয়ে যাও।/ আমরা তাঁর কাছে আগুন আনতে গেলাম এবং আগুন হয়ে গেলাম/ আমাদের ক্ষুধা ও যৌন তৃষ্ণা উধাও হয়ে গেল।/ এখন আমাদের গাত্রবর্ণ সবুজ/ আমাদের চারদিক সবুজময়/ আমাদের নারীরা সবুজ।/ উজ্জ্বল এক আগুন জ্বলছে আমাদের কেন্দ্র করে/ আমরা পুড়ছি না।’
পাঠকের সঙ্গে কবিতায় সদ্য সাক্ষাৎ মেলা ‘সবুজ গাত্রবর্ণের যুবা পুরুষ’ই কী কবি কথিত রঙওয়ালা? মরমতৃষ্ণা যাকে পায় সে এমন রঙের খোঁজ করে বলেই রঙওয়ালার দেখা পায় এবং রঙওয়ালার রঙে ক্রমশ রাঙা হয়ে যায়। কবি দূর্গম এ পথের রুপরেখা পেশ করেছেন মাত্র। কিন্তু জানান নি ঠিকুজি কিংবা যানবাহনের বৃত্তান্ত। বাকী দায়িত্ব পাঠকের। যে যেভাবে বুঝবে সে সেভাবেই আলোর মিছিলে যাবে। কবি অবশ্য নিশ্চিত তাঁর বর্তমান অবস্থান নিয়ে। তিনি তাই দৃঢ়তার সাথে বলতে পারেন- ‘আলোর মিছিলে আছি/ প্রগতির বৃষ্টিতে নিত্য করি স্নান/ ওরা ভয় দেখাতে চায়, ভয় পাই না/ মৃত্যুকে যে ভয় পায় সে হয় আজন্ম কাপুরুষ।’ কবি নির্দেশিত এই ‘আলোর মিছিল’ কী খ্যাতিমান ফার্সী সুফি কবি শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তারের ‘মানতিকে তাইয়ার’ গ্রন্থের সেই সী-মোরগের সন্ধানে সমবেত হওয়া পাখিদের মিছিল? যারা হুদহুদ নামের আরেক প্রাজ্ঞ ও কষ্টসহিষ্ণু পাখির নেতৃত্বে সী-মোরগের খোঁজে পাড়ি দিয়েছিলো বহু দূর্গম গিরি-কান্তার মরু? সেসব পাখিরা যারা অভিযান শেষে প্রত্যেকেই নিজেদেরকে আবিষ্কার করেছিলো একেকজন সী-মোরগ হিসেবে? হতেও পারে। কেননা মরমের কোন ভূগোল হয় না। কেবল বদলায় অনুষঙ্গ, প্রকৃতি কিংবা প্রাধান্য পায় বয়ানের আঞ্চলিক রেশ। তাই বলা যায় আত্তারের পাখিদের সী-মোরগে পরিণত হওয়া এবং হালিমের কবিতার নর-নারীদের সবুজ রঙধারী আগুন হয়ে যাওয়া একই রুপকের ভিন্ন ভিন্ন ভৌগলিক প্রয়োগ।
রঙওয়ালা ছাড়াও কবি হালিম আবদুল্লাহ’র আরেক অভিন্ন সত্তার নাম ‘সুলতানা’। সুলতানা কখনো প্রেমাস্পদ, কখনো রঙওয়ালা, কখনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু মন মুরশিদ। সী-মোরগ খুঁজতে গিয়ে সকল পাখিদের সী-মোরগে রুপান্তরিত হবার গল্পের মতো কবি নিজেও তাঁর মন মুরশিদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে থাকবেন। সে যাত্রার দূর্দান্ত বর্ণনা পাওয়া যায় ‘যাত্রা’ কবিতায়। দূর্গম সে যাত্রাপথে আছে ডাকাতের আক্রমন, আছে কামিনী-কাঞ্চনের ভয়, আছে সবশেষে বাঘের পেটে যাবার তথ্যও। অতঃপর তিনি জানালেন ‘দেহহীন যাচ্ছি মন মুরশিদের বাড়ি’। সেখানে তিনি অবশেষে পৌঁছেছেন, কেননা ‘রঙ’ কবিতা মারফত জানা গেলো ‘সুলতানার রঙে ইতোমধ্যে সব রঙও রঙিন হয়ে গেছে’। এমনকি ‘তুমি হয়ে গেলাম’ কবিতায় তাঁর দাবী আরো জোরালো- ‘সবচেয়ে মর্মান্তিক কথাটি বলি, গতরাত থেকে আমার মাথায় তুমি ছাড়া অন্য অবয়ব আর নেই/ জলে উবু হলে জল তোমার মুখচ্ছবি দেখায়।’ তার পরের পংক্তিতে কবি যেন আরো প্রাণবন্ত এবং সুনিশ্চিত- ‘সুলতানা, আমি বুঝি তুমি হয়ে গেলাম।’ এই তুঙ্গাবস্থা আসলে কেমন? একটু রামকৃষ্ণ পরমহংসের দ্বারস্থ হওয়া যাক। তিনি জানাচ্ছেন- ‘ছাদে অনেকক্ষণ লোকে থাকতে পারে না, আবার নেমে আসে। যাঁরা সমাধিস্থ হয়ে ব্রম্মদর্শন করেছেন, তাঁরাও নেমে এসে দেখেন যে, জীবজগৎ তিনিই হয়েছেন। সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি। নি-তে অনেকক্ষণ থাকা যায় না। ‘আমি’ যায় না; তখন দেখে, তিনিই আমি, তিনিই জীবজগৎ সব।’ তা হয়তো ঠিকই। কিন্তু ব্যক্তির এমন তুঙ্গাবস্থা কী চিরকালীন? মনে হয় না। মহাত্মা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসংখ্য গীতিকবিতায় পাই পতন ও আক্ষেপের জটিল চিত্র। ‘ক্ষনিক আলোকে আঁখির পলকে/ তোমায় যবে পাই দেখিতে ওহে/ ক্ষনিক আলোকে আঁখির পলকে/ তোমায় যবে পাই দেখিতে/ ওহে হারাই-হারাই সদা হয় ভয়/ হারাইয়া ফেলি চকিতে/ আশ না মিটিতে হারাইয়া/ পলক না পড়িতে হারাইয়া/ হৃদয় না জুড়াতে/ হারাইয়া ফেলি চকিতে/ মাঝে মাঝে তব দেখা পাই/ চিরদিন কেন পাইনা।’ তেমনি কবি হালিম আবদুল্লাহও বেদনা ও তৃপ্তির সুড়ঙ্গ খুঁড়ে চলেন ‘অনন্তবালা’ কবিতার মতো- ‘এখন হররোজ নামাজে ঢুকে পড়ে সংসারের চাল ডাল/ ইফতার কালে ক্ষুধায় কাতর হয়ে গোগ্রাসে গিলি রুপকথার রাক্ষসের মতো/ যৌন জীবনে অভ্যস্ত আমার কামুক সংসার/ অনন্তবালা, আমি তোমার কাছে যাব।’ এসব পংক্তি যেন ব্যক্তি হালিমকে ছাপিয়ে আমাদের কথা হয়ে উঠেছে ক্রমশ। আমাদের যাপিত সময়ের চাপে বিস্মৃত মরমকে উস্কে দেয় কবিতাটি। একই কবিতায় মরমী ভাবধারার পাশাপাশি কবি এঁকেছেন কোন এক অঞ্চলের বিগত অসাধারন অসাম্প্রদায়িক চিত্র, পাশাপাশি আক্ষেপের শামিয়ানায় তিনি ঢেকে দিয়েছেন সচেতন নাগরিক মন- ‘তোমার কীর্তন শুনে যতবার নামাজে দাঁড়িয়েছি/ ততবার আমার মেরাজ হয়েছে/ অনন্তবালা, কতকাল তোমার আশ্রমে যাই না/ কতকাল আমার মেরাজ হয় না।/ সারাদিন সিয়াম শেষে ইফতারে তোমার কৃষ্ণের ভোগ খেয়েছি/ অমনি স্বর্গীয় সুগন্ধে ভরে উঠেছে আমার চারদিক/ অনন্তবালা, কতকাল তোমার আশ্রমে যাই না/ কতকাল আমি সুগন্ধে ভাসি না।’
এমন অসাধারণ মরমী বিনুণীতে হালিম আবদুল্লাহ রচেছেন ‘রঙওয়ালা’ কাব্যগ্রন্থের সিংহভাগ কবিতা। সহযাত্রী, প্রতীক্ষা, বৃক্ষকথা, ছোবল, না বলা কথার টান, অনুরাগ, তুমি, নাচের মুদ্রা, বদলে যাওয়া প্রাণ ইত্যাদি কবিতাগুলো অন্তত তাই বলে।
৩
ভাবনাবৃত্তের কাঠামো ভেঙ্গে কবি হালিম আবদুল্লাহ’র সাহিত্য-যাত্রা। মরমী অনুভুতি ও মেধার স্ফুরণ তাঁর কবিতার আষ্টেপৃষ্ঠে। তাঁর আছে ‘নিজস্ব নদী’। যে নদীতে নাইতে গেলে ভেজে না কেউ, ডুবসাঁতারে দম বন্ধ হয় না কারোর। সে নদীতে আছে ইচ্ছেপূরনের ঘাট। কবির সঙ্গি হলে সঙ্গিকে তিনি সেই নিজস্ব নদী দেখাবেন। দেখাবেন পুবের মাঠ। তিনি ‘নিমন্ত্রণ’ জানিয়েছেন। চাইলে কবির কন্ঠে শোনা যাবে ভাটিয়ালি কিংবা দক্ষিণ পাড়ার ওমর আলীর মুরশিদি গান। গাঁও গেরামের মানুষের মানুষের যতœ-আত্তিতে কমতি হবে না। খরের গাদায় হেলান দিয়ে নারকেল-মুড়ি কিংবা মোল্লাবাড়ির পাকা ঘাটলায় বসে পাকা জাম্বুরার ভর্তার ব্যবস্থা হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তিনি। তবে আপনি যদি তথাকথিত সেসব কবি বা সুশিল শিল্পমনাদের কাতারে নিজেকে ভেবে থাকেন তবে আপনার জন্য দুঃসংবাদ। কারন কবির ভাষ্যে- ‘আমার দেহ মাড়িয়ে আপনারা বাজার করতে গিয়েছেন/ বাজার ভর্তি থলে নিয়ে ফিরেছেন/ বাচ্চাকে স্কুলে নিয়েছেন/ কখনো কখনো সরকার ও রাজনীতির আলোচনা মুলতবি রেখে রবীন্দ্রনাথের কবিতা/ নিয়েও শখের বিশ্লেষণ করেছেন’ (মালিকানা)। হালিম আবদুল্লাহ তাঁর জানাজায় আসবার আগাম দাওয়াতও দিয়ে রেখেছেন, এমনকি অছিয়তও রেখেছেন অকুন্ঠ চিত্তে ‘জানাজা’ কবিতায়- ‘কোনো প্রার্থনা মন্ত্র শুনে কবর যাত্রা আমার কাম্য নয়/ আমার শরীর ঘিরে গানের তালে হোক আপনার নৃত্যময় ঘূর্ণন।’ এই নৃত্যময় ঘূর্ণনের ধারণাটি নিশ্চয়ই আরেক মহাত্মা সুফি জালালুদ্দিন রুমি থেকে প্রাপ্ত হয়ে থাকবেন কবি। রুমিও নির্বানের একই কালি-কলমে এঁকেছেন বিরহ-মিলনের অনুপম মানচিত্র- ‘ক্ষণেক হাসি, ক্ষণেক কান্দি, উলটে পড়ি হঠাৎ, অতঃপর উঠে দাঁড়াই/ হৃদয়-গভীরে প্রিয়তম আছে, কেন তবু দেখা না পাই, ঘুরতে থাকি তাই,/ এসো, হে প্রিয়, এসো, তোমার মওলানা রুমি'রে বাঁচাও সাঁই/ (আমি) শামস তাবরিজের গোলাম, কলন্দরের মতো ঘুরতে থাকি তাই।’
আবার নিমন্ত্রনের আড়ালে কৃষক-কবির দুঃখের বয়ান প্রকাশ্যে আনতে চান না হালিম আবদুল্লাহ। তিনি জানেন অতিথি নারায়ন। নিমন্ত্রিত অজানা কবির নিকট তিনি ধানের দাম না পেয়ে বিবাগী হওয়া কাছিম আলির কথা, সোলেমান গাজির জমি খোয়ানোর কথা, মধ্যপ্রাচ্যের শেখের ঘরে লাঞ্চিত ময়নার মা’র বৃত্তান্ত কিংবা গার্মেন্টসে স্বাস্থ্য খোয়ানো শাবানার তথ্য সহ আর সব দারিদ্র্য লুকিয়ে রাখবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এসব দূর্ভাগ্যের বিষয়ে তিনি সেই অজানা কবিকে কিছুই বলবেন না, কারন- ‘আপনি কবি মানুষ/ জোসনা ভালোবাসেন/ পূর্ণিমাতেই আসুন, অমাবস্যায় পথ হারাবেন।’ কবি হালিম আবদুল্লাহ’র স্বার্থকতা এখানেই যে তিনি কবিতার ভাব থেকে না সরেও বয়াণ করেছেন সাধারণ মানুষের ভেতরের কথা। কবিতায় তাঁকে কখনোই অপরিচিত মনে হয় না। তিনি যেন আমাদেরই একজন, সহস্র বর্ষ ব্যাপে যেন তিনি আকন্ঠ পান করেছেন নাগরিক ক্লেদ। সেসব ক্লেদই কী তিনি উগড়ে দিচ্ছেন শহুরে শিক্ষিত তথাকথিত আপোষকামী মধ্যবিত্ত মননে? ‘আপনি শহরের ভালো মন্দ খেয়ে দেহ পুষ্ট করেছেন/ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় টপকিয়ে ঠান্ডা ঘরে বসে রাজকার্য করেন।/ শুনেছি সব কাজ শেষ হলে পর গায়ে সুগন্ধ মেখে ল্যাপটপের কর্পোরেট স্ক্রিনে রাজিয়া/ খাতুন চৌধুরানীর অনুকরনে কৃষকের সাধনা শিরোনামে গদ্যছন্দে স্তুতিকাব্য লিখছেন।/ দোহাই কবি, এ নাদানের মাথার কথা মনে রাখবেন/ আবেগ তাড়িত হয়ে গ্রামাঞ্চলে কবিতা শোনাতে আসবেন না।/ জেনে রাখবেন, একজন কৃষকের পায়খানার পরিমাণ একটি কাকের চেয়ে কয়েকশ/ গুন বেশি/ তারা ঠোকর দেয় না, মাথায় লাঠি মারে’ (না জেনে পড়শির কথা)। ঘৃণা নয় কিন্তু তীব্র সচেতন শ্লেষ জারী রেখে কবি হালিম আবদুল্লাহ সেসব কবি নামধারী সুশিলদের সতর্ক করেছেন এবং জানিয়ে দিচ্ছেন কৃষক শ্রমিক সর্বহারার শক্তি-সামর্থ্য। ‘প্রতিশ্রুতি’ কাব্যে মধ্যবিত্ত সঙ্কটের আরেক রুপ দেখতে পাই আমরা। মৃত্যু যাত্রার দিকে যেতে যেতে পাওনাদারের উদ্দেশ্যে তিনি ফিরে আসার এবং ফিরে এসে সব পাওনা চুকিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। স্থান কাল ও পাত্রের ধারণাকে দুমড়ে-মুচড়ে কবি এ কবিতায় হাজির করেছেন বিদ্রুপমাখা এক করুণ জাদু-বাস্তবতা। তিনি নিজেকেও ছাড় দেন না বিন্দুমাত্র। নিজেকে নিয়ে সন্দেহে ভুগেন। নিজের লুম্পেন মানস ছাপিয়ে তিনি নিজেকে ও প্রচলিত সব তথাকথিত পবিত্র মতের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েন অবলীলায়- ‘আমিও লুটেরা তুমিও লুটেরা আছ/ উপরে মেখেছি সাধু বাউলের রঙ/ পবিত্র পাঠে যে মানুষের বয়ান/ সে সব বানানো বুজরুকি আর ঢং’ (মানুষ)। একই সুর শুনতে পাবো আমরা ‘বাজিকর’ কাব্যেও।
স্যাটায়ারধর্মী প্রচুর কবিতায় কবি হালিম আবদুল্লাহ কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন অসংখ্য কপট রাজনৈতিক চরিত্রের পাশাপাশি শঠ স্বার্থপর দুমুখো বুদ্ধিজীবীদেরও। বিদ্রুপবাণে জর্জরিত করেছেন নান্দনিক তুলির আঁচড়ে। ‘দরখাস্ত’ পদ্যে বাঁদর নাচের দল, প্রধান ড্যান্স মাস্টার, ধর্মবেত্তা, দালাল কবি, রাষ্ট্রভজা বুদ্ধিজীবী, মাঝবয়সী আমলা এবং মুদ্রামন্ত্রী বিষয়ক ব্যাঞ্জনা বোদ্ধা পাঠককে দেখাবে রুপকের আড়ালে সুরম্য মোড়কে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পঁচাগলা প্রয়াস। মা, সরাসরি, বংশধারা, চিত্রনাট্য ও কুকর্ম নামের কবিতাগুলোতেও বৌদ্ধিক স্যাটায়ারের তীব্র প্রয়োগ কবিকে চিনিয়ে দিচ্ছে রাজনীতি সচেতন একজন মানুষ হিসেবে। কেবল আধ্যাত্মবাদে ঝোঁকা কোন কৌতুহলি মানুষ হিসেবে তাঁকে নজরবন্দি করবার সুযোগ নেই।
হালিম আবদুল্লাহ তাঁর কবিতার সুঁচের ন্যায় চোখা বাক্যের আঘাতে রক্তাক্ত করেছেন প্রথা ও প্রতিষ্ঠানকে। এবং সংশ্লিষ্ট ভন্ড ব্যক্তি বা ব্যক্তিগনকে নিয়ে গেছেন শিল্পিত সমালোচনার অন্য মাত্রায়। রুপান্তর, কবি, ভাবমূর্তি ইত্যাদি কাব্যে তিনি ব্যাঙ্গাত্মক ভাষায় দেখিয়েছেন সমাজের নানা অসঙ্গতি ও ব্যক্তি বিশেষের যাবতীয় আপোষকামীতা।
৪
তবে সুফি রঙে রাঙা হলেও হালিম আবদুল্লাহ’র কবিতার মেজাজে নদীয়ার ভাব প্রকট। তিনি শেকড় ভুলে যান নি। বরং ভাবের খন্ডিত অঞ্চলকে জুড়েছেন প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের অখন্ড দর্শনে। এবং তিনি বাংলাদেশ নামক এই ছোট্ট ভূখন্ডস্থ ভাষা ও ভাবকে ‘পূবের হাওয়া’ নামে চিহ্নিত করতে চান। তাই তাঁর বর্ণনা যেন পূর্ণতাপ্রাপ্ত সুসমাচার- ‘পিরিতের রীতি শিখে নেব ধান থেকে/ গলাগলি করে একই জমিনে বসে/ সাম্যবাদের হাতেখড়ি হবে শুরু/ সুফি তরিকার ভালোবাসা বিশ্বাসে’ (জীবনকাল)। চিঠি, ডেকে নিও ও ডাক কাব্য তিনটিও একই বৃক্ষের ভিন্ন ভিন্ন ডালপালা। সুফি দর্শনের রুপক সুরা ও সাকীর বদলে হালিম আবদুল্লাহ’র কবিতায় এসেছে নদী ও মাঝি, যা নদীয়া অঞ্চলের অন্যান্য ভাব-সাধকদের মতো একই প্রবণতা বহন করে। চিঠি ও ডেকে নিও কবিতা দুটোয় প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরাণের গহীন ভিতর’-এর নির্যাস আছে বলে পাঠকের মনে হতে পারে। নদী সংক্রান্ত আরও অনুবৃত্তি চোখে পড়বে ‘নিমজ্জন’ কবিতায়। পরাবাস্তব স্বাদ পাওয়া যাবে উক্ত কবিতাটিতে।
তাঁর জ্ঞান-ভূগোল খন্ডিত নয়, অখন্ড। তাই তিনি খাদক বৃত্ত থেকে বেরিয়ে খাদ্য হতে পারার অভিজ্ঞতা টের পান, কিন্তু ভাষার সীমাবদ্ধতায় কথায় রুপান্তরিত করতে পারেন না। অবশ্য এ সংকট শুধু হালিম আবদুল্লাহ’র নয়, এ সংকট সার্বজনীন। ‘আত্মতত্ত্ব’ কবিতায় কবি নিজ পরিচয় দিয়েছেন ‘জাতে কৃষক ও ধর্মে বাউল’ বলে। কবিতার হালিম আবদুল্লাহ সত্যিই এক খ্যাপা বাউল। তথাকথিত রুচিবান শিক্ষিত সুশীল শিল্পমনা মানুষকে তিনি তাঁর কবিতায় বারবার কটাক্ষ করেছেন তাঁদের দ্বৈত আচরণ নিয়ে। মিথ্যে নয় এই রাষ্ট্রে অবৈধ উপার্জনকে বৈধতা দেবার আয়োজনে বিপুল বিনিয়োগ করে প্রকাশ্য লুটেরার দল। স্বার্থের প্রয়োজনে সেসব সুশীল শিল্পমনারা এসব লুটপাটের বৃত্তান্ত জানা সত্ত্বেও প্রায়শই চুপ থাকেন। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এরাই পান ব্যাপক আনুকূল্য। কবির ভাষায় এরা ‘গোপনে বেশ্যার বাড়ি গেলেও পর্দার ইহলৌকিক ও পরলৌকিক মরতবা নিয়ে লেখেন শরিয়তি পয়ার/ আপনারা সৎ নন কিন্তু বউ মেয়েদের সতিত্ব রক্ষায় বিনিয়োগ করেন অবৈধ উপার্জনের সোনা।’ কবির মতো যিনি জেনে গেছেন এইসব চাতুরির সংবাদ তাঁদের আর উদযাপন করবার মতো আনন্দ থাকে না। হয়তো যৌনতাই তখন একমাত্র আনন্দের উপকরণ হয়ে পড়ে। তাই কবি ‘যৌনসম্ভোগের মাঝেই আলেক সাঁইয়ের সন্ধান’ করেন। তাঁর কবিতায় ক্রোধের যৌক্তিক প্রয়োগ এতোটা সাবলীলভাবে এসেছে যা কোনভাবেই অগ্রাহ্য করা যায় না। বরং পাঠকের মনে বইয়ে দেয় ভারী চিন্তার জাহাজ। ‘আমি কোন উত্তরাধিকার রেখে যাব না/ আমি জেনে গেছি, দরিদ্রের জীবন বড় গ্লানিময়।/ জন্মনিরোধে বিশ্বাসী দীনহীন লালনকেই তাই আমার কেবলা করেছি/ অন্য সব খরুচে কেবলা আপনাদের দখলে থাক।’ ‘আত্মতত্ত্ব’ কবিতার মতো পাঠক হামেশা এমন মনো-সংকটের মুখোমুখি হবেন অন্যান্য কবিতায়ও।
কোনো কোনো কবিতায় মার্ক্সিয় তত্ত্বের প্রায়োগিক অভিলাষ দেখতে পাই দেশি সংস্করণে। কবি চান ফসলের মালিকানা একমাত্র তাঁর হোক। কৃষকের হোক। কিন্তু কৃষকের জিম্মায় থাকে কী ফসলের গোলা অবশেষে? কৃষি নির্ভর অর্থনীতি সত্ত্বেও অন্তিম হিসেবে কৃষক হয়ে পড়ে দাস। উৎপাদক হয়ে পড়ে শ্রমিক। তাই কবির দ্ব্যার্থ উচ্চারণ- ‘আমি উৎপাদক হলেও বিপণন রীতির কৌশলে আমিই শ্রমিক হয়ে যেতাম/ যেমন সুন্দরী বেশ্যা, যার রাতের কামাই খায় চতুর দালাল’ (মালিকানা)। কবির আছে কেবল ভাটিয়ালি গলা। তিনি চিৎকারে চিৎকারে রটিয়ে দেন সব চতুর নির্যাতনের খবর, দেখিয়ে দেন আদতে যা ভালো বলে প্রচারিত তা আসলে পুঁজিবাদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদনের কৌশলি খেলা। এসব কারনে কবির ভাটিয়ালি গলায় স্বাভাবিকভাবেই ছুরি পড়বার কথা। পড়েও। কিন্তু রক্তের ফিনকির মতো ছড়িয়ে পড়বে বিরোধ, তিনি পদশব্দ শুনতে পান। না জেনে পড়শির কথা, বংশধারা ইত্যাদি কবিতায়ও সর্বহারা জনতার এমন বৈষম্যবিরোধী সংগ্রামের স্বাপ্নিক বয়াণ এসেছে আশ্চর্য দক্ষতার প্রমাণ হিসেবে। তবে এসব সংগ্রামের তাত্ত্বিক রুপরেখার জন্য তিনি লেনিনের নিকট হাত পাতবেন না জানিয়েছেন ‘জীবনকাল’ কাব্যে। আত্মবিশ্বাসী কবি এক্ষেত্রে সচেতনভাবে প্রয়োগ করতে চান মহাত্মা লালনের মতো মহান দার্শনিকের ব্যবস্থাপত্র- ‘আমাদের পাঠ লেনিনের থেকে নয়/ লালনের মতো কে আছে সর্বহারা/ সব ছেড়ে দিলে পৃথিবীর মালিকানা/ তিনি বলেছেন, পাব খতিয়ান ছাড়া’।
পণ্যের আধুনিক বিপণন কৌশল, বাজারতন্ত্র ও মুদ্রার অদৃশ্য ব্যবহার পৃথিবীকে নিয়ে এসেছে ছোট্ট ডিভাইসের পর্দায়। মানুষ ভোক্তা নাকি পণ্য, নাকি উভয়ই, এই তর্কের আভাস এসেছে রুপকের অত্যন্ত দক্ষ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ‘পুঁজিবাদ’ কবিতায়- ‘ঝিনুক তোমার বুকের ভিতর বৃষ্টির জল/ মুক্তো হবে।/ ঝিনুক তোমার দাম বেড়েছে মৃত্যু হবে।’ পোস্টমর্টেম কাব্যের ‘টাকা না থাকাও পাপের মধ্যে পড়ে’ এবং ‘কে না জানে গরিবীয়ানাই পাপ’ ইত্যাদি পংক্তিগুলো যেন পুঁজিবাদ সৃষ্ট প্রচলিত নাগরিক বুলি। পাশাপাশি যোগ হয়েছে কবির জৈবনিক অভিজ্ঞতা, যাপনের বিচিত্র নিরীক্ষা ও মধ্যবিত্ত টানাপোড়েনের বাস্তব যোগসূত্র। কর্পোরেট সদগতি, মা, রাষ্ট্রগণিত ও ক্লীব হয়ে আছি কাব্যগুলোতেও পাই কবির পূর্বলব্ধ জ্ঞান মিশ্রিত পুঁজিবাদ বিরোধী মনোভাব এবং নতুন মানব সমাজ গড়বার প্রত্যয়। এমন অসাধারন সব দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বাক্য ও কাব্যের ভেতর ভ্রমণ করতে করতে অভিজ্ঞ পাঠক নিশ্চিত পৌঁছে যাবেন ইউটোপিয়ার সীমানাহীন পৃথিবীতে।
হালিম আবদুল্লাহ বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতাকে এনেছেন ‘তোমার পতাকা’ কবিতায়। সম্ভবত বাঙ্গালীর মুক্তির কান্ডারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে তিনি এই কবিতায় নাম না উচ্চারণ করেও ইশারায় চিত্রিত করেছেন দারুণ নৈপুণ্যে। আর রাষ্ট্রকে এবং রাষ্ট্রের চরিত্রকে কবি এতো বিশদভাবে জেনেছেন তাতে বিস্মিত হতে হয়। রাষ্ট্রের টিকে থাকার পেছনের কলাকৌশল এবং নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের বিবেচনাবোধ তিনি তাঁর অসংখ্য কবিতায় এনেছেন স্বাচ্ছন্দ্য চাতুর্যে। এমনকি ক্রসফায়ারের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে অপরাধ সংক্রান্ত চেতনার ঊর্ধ্বে গিয়ে হালিম আবদুল্লাহ রচেছেন একইসাথে আবেগময় ও যৌক্তিক ‘দুষ্কৃতকারী বলছি’ কবিতাটি।
চিত্রকল্পের পরিশীল ব্যবহার, আবহমান বাংলার প্রাণ-প্রকৃতি, মাঠ-ঘাট, জল, আকাশ, পাখি ইত্যাদি কাব্যানুষঙ্গ তাঁর বোধের ও চিন্তার মিশেলে পেয়েছে ভিন্ন ব্যঞ্জনা। তাঁর কাব্য যেন হ্যামিলনের বাঁশি এবং তিনি যেন বাঁশিওয়ালার বেশে পাঠককে নিয়ে যান মহাজীবনের দিকে। দর্শনবোধের এমন অনন্য উপলব্ধি পাই ‘ব্যবস্থাপত্র’ কাব্যে- ‘সমস্ত ক্লান্তির তলে চাপা পড়ে উজ্জীবনের ইতিহাস/ মৃত্যু ও জীবনের গাঁটছড়া বেঁধে হয় যাপনের নিয়ম/ কেবল ভালোবাসা টিকে যায় সব কিছু হয়ে গেলেও শেষ’।
অবশ্য তাঁর বেশিরভাগ কবিতাই দার্শনিক অভিজ্ঞানের নিপুণ ফসল। তিনি বাউল গানের সুরকে পরাণে ধরেছেন। মগজের কোষে দোআঁশ মাটির ঘ্রাণ নিয়ে তিনি মুরশিদ জ্ঞানে ভজেন মানুষের দেহ। ‘আত্মপরিচয়’ কবিতায় এসব দাবী নিয়ে তিনি কৈফিয়তের সুরে বলতেই পারেন- ‘কবিতা লিখি না যাপনের রীতি বলি’। মানবদেহের তাত্ত্বিক নিগুঢ় বিষয়াদির সঙ্গে ‘যদি পতিত হই’ কাব্যে তিনি রাষ্ট্রের দেহের জটিল মিথষ্ক্রিয়া ঘটিয়েছেন নিবিড় বৈদগ্ধ্যে। ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, ত্রিবেনী, ত্রিদলের মৃণাল কিংবা মানস সরোবর নামক দেহতাত্ত্বিক চিহ্নের এমন ব্যবহার বোদ্ধা পাঠককে বিস্মিত করবে নিশ্চিত। কোথাও কোথা তিনি মিথের সঠিক ও সংক্ষিপ্ত প্রয়োগ করেছেন দারুনভাবেই।
৫
‘রঙওয়ালা’ কাব্যগ্রন্থটি কবি হালিম আবদুল্লাহ’র প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এবং এখন পর্যন্ত তাঁর একমাত্র রচিত গ্রন্থও বটে। বয়স যখন পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই তখনই ‘রঙওয়ালা’ এলো আমাদের হাতে। এতোকাল ধরে যেন তিনি অনুশীলন করেছেন, রঙওয়ালাকে অবলীলায় বাড়তে দিয়েছেন তাঁর মানসলোকে। স্বাধীন সত্তার মতো পরিণত করেছেন, সময়ে সময়ে ভাব জুড়েছেন রঙওয়ালার বর্ণীল অঙ্গে। এসব বিবরণের কাব্যিক বয়াণ পাওয়া যায় তাঁর ‘ঘুড়ি নয় পাখি হয়ে বাঁচি’ কবিতায়। তিনি পরের হাতে লাটাই ধরা ঘুড়ি নন। উজান বাতাসে পরিযায়ী পাখি হয়ে তিনি যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা। তাই রঙওয়ালার কবিতাগুলো বলা যায় কবি হালিম আবদুল্লাহ’র অভিজ্ঞাণে ভরপুর স্থানিক আলেখ্য, কিন্তু আবেদনে বৈশ্বিক। ফলে শুঁকলে ঠিকই কবিতায় পরিযায়ী ঘ্রাণ পাবে পাঠক। তাঁর ভাষা দুর্বোধ্য নয়, সাবলীল। জেনেশুনে কোন তত্ত্বজ্ঞাণ আরোপ করেন নি তিনি। ফলে কঠিন হৃদয়েও সহজে পৌঁছোয় কবিতার সমূহ সার। বলা যায় কবিতাসমূহ লৌকিক নয়, লোক-উত্তীর্ণ। কবির চেতনার গভীর থেকে উৎসারিত এইসব শব্দ ও বাক্যের মিশ্রণ যেন অধিজাগতিক কোন সুর, যা শ্রবণ মাত্র মেধাবি পাঠকের চেতনাও আন্দোলিত হবে নিশ্চিত। তুরীয় আনন্দের দিকে যেতে যেতে কখনো হয়তো পাঠক পুঁজি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিক বিরোধ নামক পাথরে হোঁচট খেতে পারেন, তবে আকস্মিক আঘাত সামলে উঠে পাঠক পুনরায় পেতে পারেন অবর্ণনীয় এক আফিম-আবেশ।
নজরুলের বিদ্রোহী’র মতো উচ্চ-ভাবধারার কবিতার নির্যাস পাওয়া যায় তাঁর কিছু কবিতায়। যেমন ‘নটরাজ হে’ কবিতায় তিনি সকল প্রশংসা নিজের জন্য বরাদ্দ করেছেন, কারণ তিনিই তাঁর আনন্দের নটরাজ। প্রকৃত কবির এই আত্মবিশ্বাস ও দুঃসাহস থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে তিনি নিজেকে তুচ্ছজ্ঞান করতেও ছাড়েন না। লোকে তাঁকে মিছে কবি বলে এবং নিজেকে একজন তস্কর বলে দাবী করেছেন ‘বাজিকর’ কবিতায়। এও বলেছেন ‘মানুষ’ কবিতায় যে তিনি মিছে বই লিখে নিজের উপর গুন আরোপ করেছেন। তবে এরুপ বিনয় তাঁকে বরং মহাত্মা লালনের প্রদর্শিত পথের যাত্রি বলেই প্রমান করে। সে যাই হোক, তাঁর বুকে আছে গুহা মানবের ক্ষুধা, আছে কবিতার প্রতি সীমাহীন দরদ। আমাদেরও আছে তাঁর উপর সীমাহীন আস্থা। হয়তো পরবর্তী গ্রন্থে কবি হালিম আবদুল্লাহ রঙওয়ালাকেও ছাড়িয়ে যাবেন।
৬
কাব্যগ্রন্থঃ রঙওয়ালা
প্রকাশকঃ জলধি
পৃষ্ঠাঃ ৬৪