টান
Published : Sunday, 24 January, 2021 at 12:00 AM
এষন আলির মুখের ত্বক কুচকে আছে। অসংখ্য চিকন কালচে রেখা চোখের নিচে। নিজের বাড়ি ছেড়েছে বিশ পঁচিশ বছর আগে। এখন ভাড়া থাকে। শুক্রবার মসজিদের সামনের মাঠে সভা চলছিল। এষন আলি কোনায় দাঁড়িয়ে মনযোগ দিয়ে কথা শুনে কাজে চলে যায়। সন্ধ্যায় ছেলেদের আড্ডা দেখে এষন আলি আবার দাঁড়ায়। দোকানদারকে বলে, ভাই পান দেন। কিন্তু তার কান পরে রইল ছেলেদের কথায়। দোকানদার লক্ষ্য করল এষন আলির আজ পানে মন নেই। ‘কি হইল এষু ভাই ?’ ‘কী আর হইবে, দেহেন না, এরা রাজনীতি করে! যেদিন তিনি কুমিল্লা হাউজিং কাঠের মঞ্চে উঠলেন সেদিন আমিও দেখতে গেছিলাম। দেখতে পারি নাই। ছোট ছিলাম। সেদিন লোকজন আমারে এমন পাড়ান পাড়াইছে, তারপর সাতদিন আমি বিছানায় পড়ে রইলাম। পা ফুলে ধুন্দুমার হয়ে ছিল। সেই থাইক্কা আমি তাঁর রাজনীতিতে ...।’
টান
খোঁজ নেয়ার কেউ নেই। অথচ আমিনার আট ভাই। কোন ভাই খুঁজ নেয় না। তাদের মোবাইলে তার নম্বর নেই। স্বামী তাকে এ নিয়ে কিছু বলে না। একটা খুঁটাও দেয় না। স্বশুড় বাড়ির কথা উঠলে স্বামী চুপ করে থাকে। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে আমিনা নিজেও কষ্ট পায়।‘... ঠিক আছে, স্ট্যাম্প আনেন, আমি লিখি দি যাম, আমার মৃত্যুর পর কোন ভাই যেন আমার জনাজাতে না আসে; আমার মুখ দেখাবেন না ভাইদেরকে।’
এই অসিয়তের খবর ভাইদের কানেও যায় তবু ভাইরা নির্বিকার। তারপর একদিন আমিনার বড় ভাই মারা যায়। সকলের কান্না ছাপিয়ে আমিনার কণ্ঠ শুনা যায়, ও ভাইরে...।
টান
ফুফু এবং ভাইজী বসে আছে। সঙ্গে ফুফুর পরিচিত মধ্যবয়সি ইয়াং মহিলা। পাঠক ইয়াং মহিলাকে মনে রাখতে পারেন। স্কুলে এলে তাঁদের পরস্পর দেখা হয়। তিনজন অপেক্ষা করছে, পরীক্ষা কখন সমাপ্ত হবে। মোট তিনদিন পরীক্ষা চলবে। ফুফুর ছোট ছেলে এবং ইয়াং মহিলার ছোট ছেলে দুজনে পরিক্ষার্থী। দুজনে একেই ক্লাসের।
ইয়াং মহিলা ফুফুকে বলে কিছুদিন আগে মোবাইলে কথা বলেছে যে নয়নতারা সে কথা তাদের মনে আছে কিনা। ফুফু ভাবে,মনে থাকার কী দরকার, আসল কথা বললে হল। নয়নতারা নামের এক গৃহবধু সেদিন ইয়াং মহিলার মোবাইল দ্বারা কথা বলেছিল। কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলেছিল ইয়াং মহিলা জানতো না। তারপর এক অপরিচিত পুরুষ তাকে বলে, সে নয়ন তারার বন্ধু। স্কুল জীবনে একসঙ্গে পড়তো। স্কুলে সন্তান নিয়ে আসা যাওয়ার মাঝে সে আবার নয়ন তারার সাক্ষাৎ পায়। আবার সেই ভালোবাসা বাসি শুরু হয়। কিন্তু নয়ন তারার স্বামী টের পেয়েছে। সেই থেকে নয়ন তারার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ।
ফুফু জানতে চায় এ প্রসঙ্গ হঠাৎ আবার কথা কেন?
ইয়াং মহিলা বলে, লোকটা কিছুক্ষণ পূর্বে ফোন করেছে। ... কেন করেছে? এবার ইয়াং মহিলা বলে, লোকটা প্রস্তাব দিচ্ছে, ‘আমি যেন তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করি।’
ফুফু কী বলবে ভেবে পায় না। ফুফু ভাইজী দুজন দুজনের মুখ দেখে। এবার ভাইজী বলে, আপনাকে ডিস্টার্ব করে?
ইয়াং মহিলা বলে, ‘হাঁ খুব ডিস্টার্ব করে।’ ...
‘আপনার মোবাইলটা এন্ড্রয়েট না?’
মহিলা বলে, ‘হাঁ এন্ড্রয়েট।’
ভাইজী আর কিছু বলে না। ইয়াং মহিলা বলে , ‘কেন মোবইল এন্ড্রয়েট কিনা জিজ্ঞেস করলে?’
ভাইজী প্রায় কড়া কণ্ঠে বলে, বিষয়টা আপনার ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে। আপনি তার নম্বরটা ব্লক দিচ্ছেন না কেন? অন্য কোন নম্বর থেকে যোগাযোগ করতে চাইলে থানায় ডাইরি করেন।
এবার ইয়াং মহিলা নিশ্চুপ। ফুফুও নিশ্চুপ।
পরদিন ইয়াং মহিলা লোকটির সঙ্গে কথা বলে, হাসতে হাসতে বলে, আপনার নামে থানায় মামলা করবো , হা হা হি হি।
ফুফু ভাইজী পরস্পর মুখ দেখে। আর ভাবে, আমারাই বোকা।
টান
চাচা ভাতিজা। আপন না। কিন্তু আপনের চেয়ে বেশি। সব কথা ভাতিজা চাচার নিকট বলে। চাচার কাছে না বললে অস্বস্তি লাগে। ... চাচা, নতুন হো-া নিলাম। চাচা বলে, ঠিক আছে। দেখে শুনে ড্রাইভ কইরো। ঢাকা শহরে প্রতিদিন ২৭৪ টা মোটরবাইক দুর্ঘটনায় পতিত হয়। ভাতিজা ভোঁ করে চলে যায়। চাচার চিন্তার দরজায় কয়েকটি খড়কুটো রেখে যায়। কয়েকদিন পরে ভাতিজা এসে বলে, চাচা, মৈষান বাড়ির একটা অংশ বায়না করেিেছ। রেজিষ্ট্রি বায়না। দাম কত জানতে চাইলেন না? চাচা বলে, কত। ভাতিজা বায়না মূল্য চাচার কানে কানে বলে, তারপর চাচার চোখে দৃষ্টি রেখে চাচাকে দেখে। চাচার চিন্তা রাজ্যের খড়কুটোগুলো আকার পরিবর্তন করে শুকনো লাকড়ি অথবা আগুনের উপযোগী হয়ে যায়। চাচা ক্রমশ ভাতিজার ব্যাংক ব্যালেন্স, ক্রয়কৃত বাড়ির সংখ্যা ইত্যাদি হাতে গুনে আর ভাবে ভাতিজাকে কোনদিন জিজ্ঞেস করা হয়নি, ভাতিজা, তোমার আয়ের উৎস কী। ততদিনে জ্বলানি সমূহ আরও পরিবর্তিত হয়। লাকড়ি থেকে কেরোসিন, কেরোসিন থেকে ইলেকট্রিক হিটার, ইলেকট্রিক হিটার থেকে গ্যাসবার্নার ইত্যাদি। তবু চাচা ভাতিজাকে কিছু বলে না। তারপর একদিন ভাতিজা আসে। চাচা চেয়ে দেখে ভাতিজা মনমরা। কি হয়েছে ভাতিজার। ভাতিজা চুপচাপ। চাচা অপেক্ষা করে। ভাতিজা বলবে নিশ্চয়। বলতে এসেছে । চাচার মনের দাহ্য পদার্থ নিম নিম জ্বলতে শুরু করেছে মাত্র। তখন ভাতিজা বলে, চাচা, ‘আমার মেয়েটা কোন কিছু মনে রাখতে পারে না। তার জেয়ান নাই। অনেক চেষ্টা করেছি, কোন ফল পাইলাম না।’
চাচার শরীর কেঁপে কেঁপে থেমে যায়। চাচা ভাবে এটাতো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তারপর আবার ভাবে তবুতো ঘটনা। প্রকৃতি আছে না।