টিকা থাকছে কোথায়, কারা কীভাবে পাবে?
Published : Sunday, 24 January, 2021 at 12:00 AM
নতুন
করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে দীর্ঘ প্রত্যাশার অবসান হচ্ছে। আগামী বুধবার
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একজন নার্সের শরীরে প্রয়োগের মাধ্যমে দেশে
শুরু হচ্ছে টিকাদান কর্মসূচি। ওইদিনই আরও ২৪ জনকে টিকা দেওয়া হবে, যাদের
মধ্যে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মী, বীর মুক্তিযোদ্ধা,
শিক, চিকিৎসক এবং সাংবাদিকরা থাকবেন।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল
মান্নান জানিয়েছেন, পরদিন ২৮ জানুয়ারি ঢাকার পাঁচটি হাসপাতাল- ঢাকা মেডিকেল
কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল,
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০০
থেকে ৫০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। আর সারাদেশে টিকা দেওয়া শুরু হতে পারে ৮
ফেব্রুয়ারি থেকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, জাতীয়ভাবে কোভিড-১৯ টিকা
বিতরণ ও প্রস্তুতি পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি করা খসড়া অনুযায়ী টিকার সংরণ,
বিতরণ হবে। তবে প্রয়োজনে এতে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে।
প্রথম মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তবে প্রয়োজনে এতে কিছু পরিবর্তন হতে পারে।
প্রথম
ধাপে ৭০ লাখ ডোজ হওয়ায় প্রথম মাসের পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে বলে
শনিবার জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম
খুরশীদ আলম।
তিনি বলেন, নতুন পরিকল্পনায় প্রথম মাসে ৬০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হবে।
“প্রথম
মাসে ৬০ লাখ ডোজ দেওযার পরের মাসে ৫০ লাখ ডোজ। পরের মাসে আবার ৬০ লাখ ডোজ,
দ্বিতীয় ডোজ মেলানোর জন্য এভাবে দেওয়া হবে। পরের মাস থেকে আবার ৫০ লাখ করে
দেওয়া হবে।”
যেভাবে সংরণ:
ভারত সরকারের উপহার হিসেবে গত বুধবার আসা
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২০ লাখ চার হাজার ডোজ টিকা রাখা হয়েছে
তেজগাঁওয়ের ইপিআই স্টোরে। এছাড়া বেক্সিমকো ফার্মার মাধ্যমে কয়েক ধাপে আসবে
মোট তিন কোটি ডোজ টিকা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বেক্সিমকোর মাধ্যমে
যে টিকা আসবে তা তাদের ওয়্যারহাউজে রাখা হবে। এসব টিকা ছয়টি ধাপে জেলা
পর্যায়ে পৌঁছে দেবে বেক্সিমকো।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের
ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, সারাদেশে টিকা
পাঠানোর জন্য সাতটি বিশেষায়িত ট্রাক কেনা হয়েছে। আরও ট্রাক কেনা হবে।
জেলা
থেকে উপজেলা পর্যায়ে টিকা যাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায়।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি জানিয়েছে, ঢাকা থেকে ৬৪টি জেলার ইপিআই স্টোরে
টিকা পাঠানো হবে।
সেখান থেকে টিকা যাবে ৪৮৩টি উপজেলা ইপিআই স্টোরে।
ইপিআই স্টোরের আইএলআরে (হিমায়িত বাক্সে টিকা রাখার ব্যবস্থা) এসব টিকা রাখা
হবে। সেখান থেকে কোল্ড বক্সে করে নেওয়া হবে টিকাদান কেন্দ্রে।
স্বাস্থ্য
অধিদপ্তরের এমএনসিএএইচের লাইন ডিরেক্টর ডা. শামছুল হক বলেন, “জেলা থেকে
উপজেলায় টিকা পাঠানোর জন্য কোনো বিশেষায়িত গাড়ির প্রয়োজন হবে না। সেখান
থেকে কোল্ড বক্সে করে পাঠানো হবে। আমাদের এরকম কয়েক হাজার বক্স আছে।”
প্রথমে পাবেন যারা:
সরকার দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জন মানুষকে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
জাতীয়ভাবে
কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিন ভাগে (ফেইজ) মোট
পাঁচ ধাপে এসব টিকা দেওয়া হবে। কোভিড-১৯ মহামারী প্রতিরোধে সামনের কাতারে
থাকা মানুষ প্রাধান্য পাবে।
প্রথম ফেইজের প্রথম ধাপে দেশের মোট
জনসংখ্যার তিন শতাংশ, অর্থাৎ ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ২৮২ জন টিকা পাবেন। দ্বিতীয়
ধাপে মোট জনসংখ্যার সাত শতাংশ, এক কোটি ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৭ জন টিকা পাবেন।
দ্বিতীয় ফেইজে পাবেন জনসংখ্যার ১১ থেকে ২০ শতাংশ; অর্থাৎ এক কোটি ৭২ লাখ
৮০ হাজার ৯৩৮ জন।
তৃতীয় ফেইজের প্রথম ধাপে জনসংখ্যার ২১ থেকে ৪০ শতাংশ
অর্থাৎ তিন কোটি ৪৫ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৭ জন টিকা এবং শেষ ধাপে জনসংখ্যার ৪১
থেকে ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ছয় কোটি ৯১ লাখ ২৩ হাজার ৭৫৪ জনকে টিকা দেওয়া হবে।
মূল পরিকল্পনার ওর ভিত্তি করে টিকার প্রাপ্যতা অনুযায়ী মাসভিত্তিক বিতরণ তালিকা তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিপ্তদর।
এই
পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথম ফেইজের প্রথম স্টেইজে মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৬৮
শতাংশ অর্থাৎ ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। প্রথম মাসে টিকা পাবেন
৫০ লাখ মানুষ।
তবে, বুধবার ভারত সরকারের উপহার হিসেবে ২০ লাখ ডোজ টিকা
আসার পর পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথম মাসে ৭০ লাখ টিকা
আসবে। তা থেকে ৬০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হবে। পরের মাসে দেওয়া হবে ৫০ লাখ ডোজ।
প্রথম
মাসে ৫০ লাখ টিকা বিতরণ তালিকা অনুযায়ী, টিকা পাওয়ার েেত্র সবার আগে আছে
কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সরাসরি নিয়োজিত সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা।
টিকা পাওয়ার পর প্রথম মাসে সবার আগে ৪ লাখ ৫২ হাজার ২৭ জন সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী টিকা পাবেন।
এছাড়া
কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য সেবা সরাসরি নিয়োজিত সব ধরনের অনুমোদিত বেসরকারি ও
প্রাইভেট মিলিয়ে ছয় লাখ স্বাস্থ্যকর্মী প্রথম ধাপেই টিকা পাবেন।
নভেল
করোনাভাইরাসের টিকা অগ্রাধিকার তালিকায় আছেন ২ লাখ ১০ হাজার বীর
মুক্তিযোদ্ধা,সামরিক ও বেসামরিক প্রতিরা বাহিনীর ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৫৭
জন,রাষ্ট্র পরিচালনায় অপরিহার্য কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ২৫
হাজার জন, সম্মুখসারির ২৫ হাজার জন গণমাধ্যমকর্মী, ৮৯ হাজার ১৪৯ জন
জনপ্রতিনিধি, সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভার ৭৫ হাজার জন কর্মচারী, মৃতদেহ
সৎকারে নিয়োজিত কর্মীদের মধ্যে ৩৭ হাজার ৫০০ জন প্রথম মাসে টিকা পাবেন।
এছাড়া
জরুরি পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পয়ঃনিষ্কাশন, ফায়ার সার্ভিস এবং বিমানবন্দরের
দুই লাখ কর্মী, স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরের ৭৫ হাজার জন, ৬০ হাজার প্রবাসী অদ
শ্রমিক, জেলা-উপজেলায় জরুরি জনসেবায় নিয়োজিত দুই লাখ সরকারি কর্মচারী এবং
ফুটবল, হকি, ক্রিকেট মিলিয়ে জাতীয় দলের ১০ হাজার ৯৩২ জন প্রথম মাসেই টিকা
পাবেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথম মাসে ৭০ হাজার ডোজ রাখা হয়েছে বাফার, ইমার্জেন্সি, আউটব্রেক মোকাবেলায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমএনসিএএইচ-এর লাইন ডিরেক্টর ডা. শামছুল হক জানান, ৭০ লাখ টিকা হাতে পাওয়ায় পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন হবে।
“আমরা
প্রতিটি শ্রেণি অনুযায়ী টিকার পরিমাণ কিছুটা বাড়িয়ে দেব। আগে ধরেছিলাম ৭৭
বছরের উর্ধ্বে, এখন বাড়তি টিকা পাওয়ায় এখন হয়তো ৭৫ বছর থেকে ধরব।”
করোনাভাইরাসের
টিকার নিবন্ধনের জন্য গুগল প্লে স্টোর বা অ্যাপল স্টোর থেকে সুরা অ্যাপস
ডাউনলোড করতে হবে। অথবা সুরাডটজিওভিডটবিডি এই ঠিকানায় গিয়ে কম্পিউটার,
ল্যাপটপ, মোবাইল থেকে নিবন্ধন করা যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে,
সুরা পোর্টাল বা অ্যাপসে গেলে একটি নিবন্ধন বাটন পাওয়া যাবে। নিবন্ধন বাটন
চেপে টিকা নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তি কোন শ্রেণিতে পড়েন তা নির্বাচন করবেন।
সেখানে
সেখানে তার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, সঠিক জন্ম তারিখ দিতে হবে। জাতীয়
পরিচয়পত্র এবং জন্মতারিখ দিয়ে ‘যাচাইকরণ’ বাটনে কিক করবেন।
নিবন্ধনের সময় আবেদনকারীকে একটি মোবাইল নম্বর দিতে হবে যেখানে টিকা সম্পর্কিত সব তথ্য পাঠানো হবে।
অ্যাপসে
একটি ঘর থাকবে যেখানে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, কিডনি রোগের
মতো দীর্ঘমেয়াদী কোনো রোগ আছে কিনা তা জানাতে হবে। কখনও কোভিড-১৯ আক্রান্ত
হয়েছেন কিনা সেটাও উল্লেখ করতে হবে।
আগ্রহী কোভিড-১৯ কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন তাও নির্বাচন করতে হবে একটি ঘরে।
ঠিকানার
ঘরে টিকা নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তির বর্তমান ঠিকানা দিতে হবে। আবেদনকারী যে
ঠিকানা নির্বাচন করবেন সেই অনুযায়ী তার টিকাদান কেন্দ্রের নাম আসবে।
সব তথ্য দেওয়ার পর একটি অঙ্গীকারনামায় টিকা নিয়ে ‘তথ্যগুলো সংরণ করুন’- এই বাটন চাপতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবিএম খুরশীদ আলম জানান, যারা অ্যাপসে নিবন্ধন করতে পারবেন না, তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা হবে।
“আগ্রহী
ব্যক্তি যদি টিকা দেওয়ার নির্ধারিত ক্যাটাগরিতে পড়েন তাহলে টিকা অবশ্যই
পাবেন। যাদের অ্যাপস থাকবে না তারা যদি টিকা নিতে হাসপাতালে যান, সেখানে
আমাদের লোকজন আছেন সাহায্য করার জন্য।”
সাড়ে ৬ হাজার কেন্দ্র:
জাতীয়ভাবে
কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি পরিকল্পনা অনুযায়ী, সারাদেশের ছয় হাজার
৫০০টি কেন্দ্রে নভেল করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী,
৪৬০০টি ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, ৬০০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ২০ ও
১০ শয্যার হাসপাতালে কেন্দ্র হবে। এছাড়া জেলা সদর হাসপাতাল/জেনারেল
হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ (সরকারি/বেসরকারি) সংক্রামক
ব্যাধি হাসপাতালে কেন্দ্র হবে ৪০০টি। সিটি করপোরেশন এলাকার বিশেষায়িত
হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, সংক্রমক ব্যাধি হাসপাতাল, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের
কার্যালয়, নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ৮০০টি টিকাদান কেন্দ্র
থাকবে।
সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল, সচিবালয়
স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং সংসদ সচিবালয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র মিলিয়ে টিকাদান
কেন্দ্র হবে ১০০টি।
শুরুতে শুধু বিভিন্ন হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য
কমপ্লেক্সের টিকাদান কেন্দ্রে টিকা দেওয়া হবে। টিকা দেওয়ার কাজটি করবেন
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ অন্য কর্মীরা। পরিকল্পনা
অনুযায়ী, ২০ হাজার ৮০০ জন স্বাস্থ্যকর্মী টিকা প্রয়োগে সরাসরি যুক্ত
থাকবেন। তাদের সঙ্গে দু’জন করে ৪১ হাজার ৬০০ জন স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন।
সারাদেশের জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন এলাকায় টিকা বহনে পাঁচ হাজার ৪৬৯ জন পোর্টার এবং আট হাজার ৮৬৯ জন সুপারভাইজার থাকবেন।