ড. প্রণব কুমার পান্ডে ।।
এমনকি
পাঁচ মাস আগেও বাংলাদেশের জনগণ কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন কখন পাওয়া যাবে তা
শোনার জন্য উৎকণ্ঠার সাথে অপো করছিল এই ভেবে যে ভ্যাকসিন পেলে তাদের বন্দি
জীবনের অবসান ঘটবে এবং তারা নির্বিঘেœ চলাচল করতে সম করবে। কারণ বেশিরভাগ
দেশবাসী কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ থেকে নিজেদের রা করতে বাড়িতে অবস্থান করছে
প্রায় ১০ মাস। বাংলাদেশ সরকার ভ্যাকসিন ক্রয় করে সরবরাহ করতে সম হবে কিনা
তা নিয়েও সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক বিতর্ক ছিল।
আমরা সকলেই জানি যে
বিভিন্ন দেশে বেশ কয়েকটি সংস্থা ভ্যাকসিন তৈরির দৌড়ে নিরন্তর কাজ করে
চলেছে। সর্বাধিক আলোচিত ছিল অক্সফোর্ড এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন। এর
সাথে ছিল ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মর্ডানার ভ্যাকসিন। এমনকি, রুশ
ভ্যাকসিন-স্পুতনিক-৫ খুব অল্প সময়ের মধ্যে তৈরি হয়েছে মানুষকে সংক্রমিত
হওয়ার হাত থেকে রা করতে। অন্যদিকে, বেশ কয়েকটি ভারতীয় সংস্থা কোভিড -১৯ এর
ভ্যাকসিন তৈরির দৌড়ে রয়েছে।
রাশিয়ার ভ্যাকসিন প্রথমে রাশিয়ার
রাষ্ট্রপতির কন্যাসহ রাশিয়ার জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এগুলো রাশিয়ার
বাইরে রফতানি করা হয়নি। অন্যদিকে, মার্কিন ড্রাগ প্রশাসন দ্বারা অনুমোদিত
হয়ে ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মর্ডানার ভ্যাকসিনটি মার্কিন জনগণের মধ্যে বিতরণ
শুরু হয়। এই সংস্থাগুলো যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন রফতানি শুরু
করে। তবে ফাইজার-বায়োএনটেক ভ্যাকসিনের স্টোরেজ পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল কারণ
এটি মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখতে হয়। সুতরাং, এই ভ্যাকসিনের
ব্যবহারযোগ্যতা বাংলাদেশে প্রায় অসম্ভব কারণ এটি সংরণ করার মতো আমাদের কোনও
অবকাঠামো নেই।
বিভিন্ন ভ্যাকসিনের সুবিধা এবং দুর্বলতা বিবেচনা করে,
অক্সফোর্ড এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনকে বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে
সবচেয়ে কার্যকর হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর প্রথম ব্যাখ্যাটি হ'ল
বিপুলসংখ্যক মানুষ এই ভ্যাকসিনের কিনিকাল ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করেছে বিধায় এই
টিকা জনগণকে কোভিড -১৯ এর সংক্রমণ থেকে রা করতে সর্বাধিক কার্যকর হতে
পারে। দ্বিতীয় কারণটি হল অক্সফোর্ড এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন সংরণ
পদ্ধতি খুব জটিল নয়। তৃতীয় ব্যাখ্যাটি হল ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাকসিনের
তুলনায় এই ভ্যাকসিনের দাম তুলনামূলকভাবে কম। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল,
অক্সফোর্ড এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা এশিয়ার দেশগুলোর জন্য এই ভ্যাকসিন তৈরির
জন্য ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সাথে একটি চুক্তিবদ্ধ রয়েছে। ফলে এই
ভ্যাকসিন ক্রয় করাও সহজ কারণ ভারতের সাথে রয়েছে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ
সম্পর্ক।
তবে, জনগণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ভ্যাকসিন কেনার বাংলাদেশ
সরকারের সামর্থ্য নিয়ে অনেকের মধ্যেই আশঙ্কা ছিল। এমনকি তারা অনেকটা
দ্বিধাগ্রস্থ ছিল এই ভেবে যে সরকার বিনামুল্যে জনগণকে ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে
কিনা? তবে শেখ হাসিনার পরিপক্ব নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্নভাবে
ভ্যাকসিন কূটনীতির েেত্র তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। প্রথমটি হ'ল সরকার
অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট এর সাথে অক্সফোর্ড এবং
অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের ৩০ মিলিয়ন ডোজ ক্রয়ের একটি চুক্তি স্বার করতে
সম হয়েছিল। চুক্তির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিধান ছিল যে সেরাম ইনস্টিটিউট
ছয়টি চালানের মাধ্যমে ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে, যার প্রতিটিই পাঁচ মিলিয়ন ডোজ
বহন করবে।
চুক্তির আর একটি শর্ত ছিল সেরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশী ওষুধ
প্রশাসন কর্তৃক ভ্যাকসিনের অনুমোদনের ত্রিশ দিনের মধ্যে প্রথম চালানটি
প্রেরণ করবে। সরকারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সিদ্ধান্তটি হল প্রায় ১৪
কোটি জনগোষ্ঠীকে বিনা মূল্যে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা। আমরা সকলেই জানি যে ১৮
বছরের কম বয়সী শিশুদের ভ্যাকসিন প্রদান করা হবে না কারণ এই বিভাগে কোনও
কিনিকাল ট্রায়াল হয়নি।
তবে, কয়েক দিন আগে ঘরোয়া চাহিদা পূরণ না হওয়া
অবধি সিরাম ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিন রফতানিতে ভারত সরকারের দেওয়া স্থগিতাদেশ
বাংলাদেশে ভ্যাকসিন সরবরাহের বিষয়ে অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে তুলেছিল। এই ধরনের
সংবাদে গুজব ছড়ানো গোষ্ঠী এবং তাদের রাজনৈতিক গুরুরা বেশ আনন্দিত হয়েছিল এই
ভেবে যে ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে
পড়বে। তারা আরও প্রফুল্ল ছিল এই ভেবে যে এই জাতীয় হতাশাজনক সংবাদ মানুষকে
হতাশ করবে। তবে, ভারত সরকারের সাথে বাংলাদেশ সরকারের বন্ধুত্বপূর্ণ
কূটনীতিক সম্পর্ক থাকার কারণে তারা দীর্ঘদিন রোমাঞ্চিত থাকতে পারেনি। কারণ
ভারত সরকারের পররাষ্ট্র সচিব এবং সিরাম ইনস্টিটিউটের একজন নির্বাহী এক দিন
পরে বিবৃতির মাধ্যমে এটি স্পষ্ট করে দেয় যে এই স্থগিতাদেশ আরোপের ফলে
বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের রফতানিতে কোন প্রভাব পড়বে না।
এই সংবাদের সাথে,
গুজব ছড়ানো গোষ্ঠী বিপাকে পড়ে যায় কারণ তাদের কাছে ভ্যাকসিন সংক্রান্ত গুজব
এবং বানোয়াট সংবাদ পরিবেশনের মতো পর্যাপ্ত রশদ ছিল না। একটি উৎসাহব্যাঞ্জক
খবর হল যে সরকার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আরও বেশি ভ্যাকসিন কেনার জন্য বিভিন্ন
ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী সংস্থার সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশকে ২
মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন উপহার হিসেবে দেওয়ার ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত দেশের
বেশির ভাগ জনগণকে অবাক করেছে কারণ এই সিদ্ধান্তের কয়েক ঘন্টা আগেও কেউ এ
জাতীয় সিদ্ধান্তের পূর্বাভাস পায় নি। এটি দণি এশিয়ার দেশগুলোর জন্য ভারত
সরকারের কৌশলগত ভ্যাকসিন কূটনীতির অংশ । ভারত সরকারের "প্রতিবেশি প্রথম
নীতি" আওতায় নেওয়া দণি এশিয়ার অন্যান্য দেশেকে ভ্যাকসিন উপহার দেওয়ার মূল
ল্য ছিল এই অঞ্চলে চীনকে বিপাকে ফেলা।
ভারতের ভ্যাকসিনের প্রথম চালানের
আগমনের সাথে সাথে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীন ভাবে চলাফেরার স্বপ্ন দেখতে শুরু
করেছে। এদিকে, সরকার নির্দিষ্ট নির্দেশিকা অনুসরণ করে জনগণকে টিকা দেওয়ার
প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। যদিও সরকার তাদের ভ্যাকসিন কূটনীতিতে সফল হয়েছে,
তবে ভ্যাকসিন নিয়ে মানুশের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক রয়েছে।
এ জাতীয় আতঙ্কের
মূল কারণ হল মানবদেহের উপর ভ্যাকসিনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত
পর্যাপ্ত গবেষণা অভাব। আর এই বিষয়ে অধিক গবেষণা হয়নি কারণ ভ্যাকসিনগুলো অতি
স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বাজারে এসেছে। সাধারণত একটি ভ্যাকসিন তৈরি থেকে
বাজারজাতকরণ পর্যন্ত প্রায় ৫ বছর সময় লাগে। তবে, মহামারীর ভয়াবহতার কথা
বিবেচনায় নিয়ে এই ভ্যাকসিনগুলো এক বছরের মধ্যেই তৈরি করা হয়েছে। সুতরাং,
টিকা নেওয়ার বিষয়ে অনেকের মধ্যে দ্বিধা রয়েছে।
এ জাতীয় আতঙ্ক কাটিয়ে
উঠতে সহায়তা করার জন্য সরকারের ভ্যাকসিনের সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করা উচিত। কাদের টিকা গ্রহণ করা
উচিত এবং কাদের উচিত নয়- এই বিষয়গুলো জনগণকে সঠিক ভাবে জানানো উচিত? এই
জাতীয় তথ্য জনগণকে ভ্যাকসিন গ্রহণ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী করবে।
ভ্যাকসিন
কূটনীতিতে সাফল্যের জন্য সরকার প্রশংসার দাবিদার। এখন, টিকা প্রক্রিয়া
সফলভাবে শেষ করার সময় এসেছে। একটি ইতিবাচক দিক হ'ল আমাদের স্বাস্থ্য
কর্মীদের বিভিন্ন ধরণের ভ্যাকসিন প্রদানের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে।
সুতরাং,হুর নির্দেশিকা অনুসরণ করে জনগণকে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা কোনও কঠিন
কাজ হবে না।
সরকারকে অবশ্যই এটি নিশ্চিত করতে হবে যে ভ্যাকসিন
প্রক্রিয়ায় যেন কোন ধরনের অনিয়ম না হয়। যদি অনিয়মের ঘটনা ঘটে তবে এটি
সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে
হবে যে ভ্যাকসিন কূটনীতি এবং কোভিড -১৯ মহামারির স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক
নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় সরকার যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। সুতরাং, আমরা টিকা
দেওয়ার ব্যাপারেও সরকারের প্রতি আস্থা রাখতে পারি।
মহামারি চলাকালীন
সময়ে এই মারাত্মক ভাইরাসের বিপর্যয়মূলক প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরকারের
দেশীয় বা জাতীয় নীতির পাশাপাশি পররাষ্ট্রনীতির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
বাস্তবে, দেশীয় ও বৈদেশিক নীতি একই মুদ্রার দুটি দিক। যেমন, দেশীয় নীতিগুলো
পররাষ্ট্রনীতির দিকনির্দেশনা আলোকে প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা হয়। সুতরাং,
সরকারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীল্তা সরকারের সাফল্যে মূল্যায়নের
একমাত্র পরিমাপক নয়।
বরং, এই শতাব্দীর সবচেয়ে খারাপ সময়ে বিশ্ব
সম্প্রদায়ের সাথে যোগাযোগ রাখার সামর্থ্যের মাধ্যমে সরকারের যোগ্যতা পরিমাপ
করা হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এটি দাবি করা যেতে পারে যে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভ্যাকসিন কূটনীতি মোকাবেলা করার সময় তার যোগ্যতা
প্রদর্শন করেছেন। অতএব, দেশে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে
তিনি যা করেছেন তার জন্য তিনি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখেন।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।