অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ ||
সম্প্রতি
৫০টি রাষ্ট্রের প্রায় ১২ লক্ষ মানুষের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের উপর
জাতিসংঘ একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। বিশ্বের জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক
জনসংখ্যা এসকল দেশে বসবাস করে। বিশেষ কতগুলি বিষয়ে পরীক্ষামূলক একটি স্টাডি
দেশসমূহের বৃদ্ধ, তরুণ, গরীব, ধনী সকল প্রকারের নাগরিকদের মতামত নেয়া
হয়েছে এ সমীক্ষায়। এ স্টাডিতে তথ্য সংগ্রহমূলক প্রক্রিয়ায় অক্সফোর্ড বিশ্ব
বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী স্টিফেন ফিজার সক্রিয় সহায়তা করেছেন। ফিজার
এএফপিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন জলবায়ু বিপর্যয়ের উদ্বেগের বিষয়সমূহ
আমরা আগে যা জানতাম, এখন তা অনেক সুদূরপ্রসারী।
জলবায়ু বিপর্যয়কে
স্বীকার করেছে এমন জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ এব্যাপারে ব্যাপক ও জরুরী পদক্ষেপ
নেয়ার প্রত্যাশা করছে। করোনা মহামারীর চেয়েও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টির
গুরুত্ব বেশি বলে স্বীকার করেছেন অধিকাংশ মানুষ। জলবায়ুর ঝুঁকি থেকে
বিশ্বকে রক্ষায় ২০১৯ সালে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া বৈশ্বিক জলবায়ু আন্দোলন এখনো
গুরুত্ববহন করছে বলে এ সমীক্ষায় বলা হয়েছে। স্টাডিতে অংশ নেয়া ১৮ বছর
বয়সিদের ৬৯ শতাংশ এবং ৩৫-৫৯ বয়সিদের ৬৬ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তনকে বিপর্যয়
হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।
মাত্র ১ ডিগ্রি উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য খরা,
দাবদাহ, ব্যাপক বৃষ্টিপাত, বন্যা, সমূদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়া ও প্রলয়ংকরী
ঝড় ভূপৃষ্ঠে আঘাত হানছে বলে সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতারা মনে করেন।
জার্মানী, ফ্রান্স, কানাডা ও দক্ষিণ আফ্রিকার এক চতুর্থাংশ উত্তরদাতা
জলবায়ু পরিবর্তনকে বিশ্বের হুমকি ও জরুরী অবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন।
রাশিয়া, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের মত আরও এক ডজন দেশের
উত্তরদাতাদের দুই-তৃতীয়াংশ অংশগ্রহণকারীরা জলবায়ু পরিবর্তনকে বৈশ্বিক
বিপর্যয় বলে মনে করেন। ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলির ৭৫ শতাংশ বসবাসকারী
জলবায়ু পরিবর্তনকে জরুরী অবস্থা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এসব বাসিন্দারা
জলবায়ু পরিবর্তনকে সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ার কারণ বলে মনে করেন এবং তাহারা
এজন্য নিজেদের আবাসস্থল ছাড়তেও বাধ্য হন। উচ্চ আয়ের দেশগুলোর জনগোষ্ঠীর ৭২
শতাংশ, মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জনগোষ্ঠীর ৬২ শতাংশ এবং স্বল্প উন্নত দেশগুলোর
৫৮ শতাংশ জনগণ জলবায়ু পরিবর্তনকে গোটা মানবজাতির জন্য মহাবিপর্যয় বলে
মন্তব্য করেন।
আশ্চর্য্যরে ব্যাপার, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ব্যাপারে কানাডা
ও যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। কানাডায় ১২ শতাংশ ও
যুক্তরাষ্ট্রের ১১ শতাংশ বেশি নারী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইউএনডিপি প্রধান
আচিম স্টেইনার বলেছেন জলবায়ু বিপর্যয় ঠেকাতে জরুরী পদক্ষেপ বিশ্বের সকল
শ্রেণীর মানুষকেই ব্যাপক সহায়তা করবে।
গত বছরের নভেম্বরে প্যারিস জলবায়ু
চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড
ট্রাম্প। ট্রাম্প বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে এ চুক্তি
তৈরি করা হয়েছিল। বর্তমানে হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে,
যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পুরোনো মিত্র দেশ হচ্ছে ফ্রান্স। জলবায়ু পরিবর্তন,
কোভিড’১৯ ও বৈশ্বিক অর্থনীতির বিষয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করতে
আগ্রহী বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর
সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চান জো-বাইডেন। দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট পরিবেশ
ইস্যু ও কোভিড’১৯ নিয়ে বিশ্বমঞ্চে আলোচনায় আগ্রহী। এএফপির খবরে বলা হয়েছে
২৪শে জানুয়ারি জো বাইডেন ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ জলবায়ু
পরিবর্তন ও করোনা মহামারী নিয়ে কৌশল নির্ধারণের জন্য দ্বিপক্ষীয় আলোচনা
করেছেন। এরই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে ইরানের পরমানু কর্মসূচি নিয়ে
একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে কথা বলেছেন মাখোঁ ও বাইডেন। প্যারিস জলবায়ু
চুক্তিতে ফেরার পূর্বেই বাইডেনের প্রশংসা করেছিলেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট
মাখোঁ।
ফ্রান্স ছাড়াও বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সঙ্গে টেলিফোনে
কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গত ২২শে জানুয়ারি জো বাইডেন
প্রথম টেলিফোন করেছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে। পরে তিনি
মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট মানুয়েল লোপেজকেও ফোন করেছিলেন। এদিকে জলবায়ু
পরিবর্তন বিষয়ক একটি উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছেন বাইডেনের
জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরি।
জলবায়ু অভিযোজন সংক্রান্ত এ সম্মেলন
অনলাইনে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা যায় ২৫শে জানুয়ারি। এতে চীনের উপ
প্রধানমন্ত্রী হান ঝেং, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মারকেল, ফরাসী
প্রেসিডেন্ট মাখোঁ, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং বিশ্বের
অন্যান্য নেতারাও এতে অংশ নেবেন। এ সম্মেলনের আয়োজক হচ্ছে নেদারল্যান্ডস।
উদ্দেশ্য হচ্ছে জলবায়ু বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যাসমূহের সমাধান
খুঁজে বের করা এবং সে মতে পরিকল্পনা ঠিক করা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায় এরই মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের জলবায়ু বিষয়ক
বিশেষ দূত জন কেরি জলবায়ু বিপর্যয়ের বৈশ্বিক ইস্যুতে
যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের সহযোগিতার ব্যাপারে আলোচনার স্বার্থে বাংলাদেশের
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.এ.কে. আবুল মোমেনকে ফোন করেছিলেন। আলাপকালে আব্দুল
মোমেন জলবায়ু চুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেরত আসার সিদ্ধান্তকে
স্বাগত জানান এবং এব্যাপারে জন কেরির পূর্বের গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে
শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
জনাব মোমেন এসময় জলবায়ুর ঝুঁকি হ্রাসকরণ,
অভিযোজন এবং উদ্ভুত পরিস্থিতি সামলে নেয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ
সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপসমূহ বর্ণনা করেন। এছাড়াও তিনি জলবায়ুর ঝুঁকি
সামলাতে বাংলাদেশের সভাপতিত্বে সিডিএফ (কাইমেট ভালনারেবল ফোরাম) ও জিএসএ
(গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন) ঢাকা অফিসের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
পদক্ষেপসমূহও তুলে ধরেন।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল