এস এম আববাস ||
পরীার মাত্র ১৫ দিন বাকি। এমন সময় যদি পরীা না নেওয়া যায়, তাহলে তার দায় কি শিার্থীদের দেবেন? নিশ্চয়ই না। কারও দেওয়ার কথাও নয়। বিশেষ করে শিার্থীদের তি নিয়ে যারা উদ্বিগ্ন থাকেন তারা তো নয়ই। তাহলে ২০২০ সালের এইচএসসি পাস করা শিার্থীদের নিয়ে ‘ট্রল’ করছেন কেন, ‘ট্যাগ’ লাগাচ্ছেন কোন? কেন ফল প্রকাশের আগে থেকে শুরু করে ফল প্রকাশের পরও ‘অটোপাস’ বলছেন? আর কেনই বা বারবার ‘অটোপাস’ শব্দটি উল্লেখ করে ভবিষ্যৎ কলঙ্কিত হওয়ার আশঙ্কার বাণী শোনাচ্ছেন?
হয়তো অনেকেই বলবেন, কেউ ‘ট্রল’ করছেন না, ‘ট্যাগ’ লাগাতে চাইছেন না। ২০২০ সালের এই পরীা না নিয়ে উত্তীর্ণ হওয়া শিার্থীদের কলঙ্ক হয়ে গেলো, এটাই বলতে চাইছেন? এই কথাটাও এক ধরনের ‘ট্রল’ করা, ‘ট্যাগ’ লাগিয়ে দেওয়া। হয়তো অনেকে তা না বুঝেই করছেন। বলছেন— কলঙ্ক হয়ে রইলো। যারা এমনটি মনে করেন, আমি তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, কোনও কলঙ্ক হয়নি। আমাদের কোনও সন্তানের গায়ে কাদা লাগেনি। যারা পাস করেছেন তারা সবাই আমার সন্তান, আমাদের সন্তান। তাদের গায়ে কাদা লাগাবার চেষ্টা করবেন না।
কীভাবে আমরা ‘ট্রল’ করছি তা এখন তুলে ধরবো।
বিগত কয়েক বছরের রীতি অনুযায়ী বাংলাদেশে এইচএসসি ও সমমানের সার্টিফিকেট পরীা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে প্রতি বছর ১ এপ্রিল। জরুরি কারণে দু-একদিন হেরফের হলেও সময় প্রায় ঠিকই থাকে। বাংলাদেশে গত বছরের ৮ মার্চ করোনা রোগী শনাক্ত হলে ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব ধরনের শিা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কওমি মাদ্রাসা ছাড়া এখন পর্যন্ত কোনও শিা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
করোনার কারণে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীা নির্ধারিত সময়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি শিার্থীর নিরাপত্তা ও করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে। যখন পরীা নেওয়ার চেষ্টা একেবারেই বিফল হয়, সরকার তখন সিদ্ধান্ত নেয় অষ্টম শ্রেণির সার্টিফিকেট পরীা- জেএসসি ও জেডিসি এবং মাধ্যমিকের এসএসসি ও সমমানের সার্টিফিকেট পরীার ফলাফলের ভিত্তিতে এইচএসসি ও সমমানের শিার্থীদের ফল দেওয়া হবে। এই ঘোষণার পর শুরু হয়ে যায় ‘অটোপাস‘ শব্দের ব্যবহার।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘অটোপাস’ শব্দটি ঘুরপাক খেতে থাকে। শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই শব্দটি নিয়ে ‘ট্রল’ করার বিষয়টি সেভাবে আমার গায়ে লাগেনি। কারণ, ভুলভাল যা খুশি তা ফেসবুকে আজকাল অনেকেই লেখেন। ফেসবুকে যেসব বিষয় নিয়ে ‘ট্রল’ হয় তার মধ্যে শিল্পগুণ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এমন কিছু বিষয় ‘ট্রল’ হয়, যা যেকোনও সভ্য মানুষের পে মেনে নেওয়া কষ্টকর।
‘অটোপাস’ শব্দটি ব্যবহার করে যেভাবে শিার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ট্রল’ হয়েছে, সে কারণে আমার আজকের এ লেখা নয়। খোদ গণমাধ্যমে যখন শব্দগুলো ঘুরেফিরে বারবার উঠে আসে, তখন মনে হয় নিজের সন্তানের কলঙ্কিত ভবিষ্যদ্বাণী করার একচ্ছত্র অধিকার কাউকেই ছেড়ে দেওয়া যায় না। আমরা যারা নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি উদ্বিগ্নতা দেখাচ্ছি, সন্তানদের গায়ে ‘অটোপাস’ -এর ট্যাগ লাগাচ্ছি, তখন তো আর নির্লিপ্ত থাকা যায় না।
কেন আমরা নিজেদের সন্তানদের নিয়ে ‘ট্রল’ করতে পারি না তুলে ধরতে চাই।
প্রাথমিক ও গণশিা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন আলাপকালে একদিন জানিয়েছিলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় এক বছর কোনও লেখাপড়া না করে পার হয়ে যায় তার। এক কাস উপরে তাকে উঠিয়ে দেন শিকরা। এ জন্য ভালো ছাত্র হয়েও পরবর্তী কাসে তাকে শিকের হাতে মারধর খেতে হয়েছে। আবার শিকদের সহায়তায় তিনি পরে ভালো ফলাফলও করেছিলেন। অটোপাস করা প্রাথমিকের সেই ছাত্র প্রশাসনের শীর্ষ পদে আসতে পেরেছেন। তাই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অটোপাস করা কাউকে নিয়ে আমরা ‘ট্রল’ করতে পারিনি। ট্যাগ লাগানোর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি।
শুধু প্রশাসনের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তাই নন, অনেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় অটোপাস পেয়ে পরবর্তী জীবনে লেখাপড়া করে প্রশাসনে, রাজনৈতিক জীবনে ও পেশাগত জীবনেও সাফল্য লাভ করেছেন। যারা দেশ স্বাধীন করেছেন, বিভিন্ন শ্রেণিতে ‘অটোপাস’ পেয়েছিলেন, তারা কেউ কলঙ্কিত হননি। বরং তারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন। পরবর্তী জীবনেও রাষ্ট্রের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেছেন অনেকেই। সাফল্যের সঙ্গে নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ও দিয়েছেন বিভিন্ন পেশা ও কর্মে।
২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের মূল্যায়নে যারা উত্তীর্ণ হয়েছেন তাদের কেন ‘অটোপাস’ বলতে পারি না তা আমি তুলে ধরছি।
শিামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, এটা অটোপাস নয়, শিার্থীরা সারা বছর লেখাপড়া করেছেন, পরীার প্রস্তুতিও ছিল তাদের। মূল্যায়নের মাধ্যমে এসব শিার্থীর ফল দেওয়া হবে। শিা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান নওফেল বলেছেন, অটোপাস নয়, মূল্যায়নের ভিত্তিতে ফলাফল দেওয়া হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিা বিভাগের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান বলেছেন, অটোপাস নয়, মূল্যায়নের মাধ্যমে অর্জিত ফলাফল নিয়ে পরবর্তী কাসে উত্তীর্ণ হবেন। শিাবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী মূল্যায়নের এই প্রক্রিয়াটিকে ‘অটোপাস’ বলায় আপত্তি জানিয়েছেন। তবে এই মূল্যায়ন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘টেস্ট পরীার মূল্যায়ন এই ফলাফলের সঙ্গে সমন্বয় ঘটাতে পারলে আরও ভালো হতো।’
অর্থাৎ, এই প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকতে পারে। ‘সাবজেক্ট ম্যাপিং’ আরও সূক্ষ্ম হলে ভালো হতো। শিার্থীরা আরও লাভবান হতেন। সে প্রত্যাশা আমারও ছিল। কিন্তু যা হয়েছে তা কি একেবারেই মানার মতো নয় বলবেন? যারা মানতে চান না, তাদের হাতে দায়িত্ব থাকলে কী করতেন? সে প্রশ্ন আমি রাখতেই পারি।
আর যদি মন্দ কিছু হয় তাহলে তার দায়ভার নিশ্চয় শিার্থীর নয়? তাহলে গণমাধ্যমে বারবার কেন ‘অটোপাস’ শব্দটি ব্যবহার করা হলো? যদিও সব গণমাধ্যম এ কাজটি করেনি। তবে এই সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়। গণমাধ্যমের যেসব কর্মী মাঠে কাজ করেন তারা না হয় শব্দটি ব্যবহারে সতর্ক হননি, কিন্তু গণমাধ্যমে যারা পলিসি লেভেলে রয়েছেন কিংবা যারা সংবাদ সম্পাদনা করেছেন, তারা কি বিষয়টি একবারও ভেবে দেখবেন না? এই েেত্র যদি উদাসীনতাই প্রধান কারণ হয় তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের উদাসীনতার খেসারত দেবে।
কর্তৃপরে কেউ যখন বলছেন না যে ‘অটোপাস’ দেওয়া হচ্ছে, তখন গণমাধ্যমে এমন প্রচার শিার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘ট্রল’ করা নয় কি? পাস করা এসব শিার্থীর গায়ে একটি ‘ট্যাগ’ লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা নয় কি? কেউ বলতে পারবেন এ বছর কেউ মেধাবী ছিলেন না?
আর যদি সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরতে ‘ট্রল’ করা হয়, মানে বারবার ‘অটোপাস’ শব্দটি গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়, তাহলে বলবো সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে আমার সন্তানের গায়ে কোনও ‘ট্যাগ’ দয়া করে লাগাবেন না। আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘ট্রল’ করবেন না।
আমরা দেখে আসছি ধর্ষণের দায় ভিকটিম নারীর ঘাড়ে চাপানোর মজ্জাগত স্বভাব সমাজে আসন গেড়ে বসেছে। প্রতিটি েেত্র যেন এমনটা না হয়। প্রকৃতপে কোনও েেত্রই এমনটি হওয়া উচিত নয়। তাই আমরা সন্তানদের ভবিষ্যৎটায় যেন ‘ট্যাগ’ না লাগাই।
‘‘অটোপাসে যারা পাস করতেন না তারাও সবাই পাস করেছেন”- এই সমালোচনা যারা করছেন তাদের বলবো— পাস করা এই শিার্থীরা দেশের জন্য অপোকৃত বেশি মঙ্গল বয়ে আনবেন।
কারণ, পরীার হলে সরাসরি পরীা দিয়ে যেসব শিার্থী অনুত্তীর্ণ হতেন তাদের অনেকেই মানোন্নয়ন পরীায় উত্তীর্ণ হতেন। তাতে তাদের আরও কিছু সময় নষ্ট হতো, যা হয়নি। আর যারা ঝরে যেতেন তারা ‘আর লেখাপড়া হবে না’ এমনটি মনে করতেন। এতে অনুত্তীর্ণ শিার্থীরা হতাশা নিয়ে কাটাতেন সারা জীবন। তাতে সমাজের কোনও উন্নতি হতো বলে আমার মনে হয় না। তাছাড়া শিার্থীকে উত্তীর্ণ করার দায়িত্ব শিকের। সব সময় পাশাপাশি থেকে সহযোগিতার দায়িত্ব অভিভাবকের। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সুন্দর শিা ব্যবস্থা তৈরি করা যাতে, কেউ অনুত্তীর্ণ না হন। এই প্রক্রিয়ায় সবার সহযোগিতা জরুরি।
কিন্তু এই পাস করা শিার্থীদের কেউ যদি উচ্চশিায় ভর্তি হয়ে ঝরেও পড়েন, তাতেও উচ্চশিা প্রতিষ্ঠানে সামান্য অধ্যয়নের কারণে কিছু অর্জন হবে তার। একজন মানুষের জীবনে সনদ যেমন প্রয়োজন, জ্ঞান অর্জন তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়।
আর যদি এই শিার্থীদের কেউ উচ্চশিায় আর ভর্তি না হন, তাহলে অন্তত একটা আনন্দ তাদের জীবনে স্থায়ী হয়ে থাকবে। শিার প্রতি তাদের হতাশা নয়, আনন্দ কাজ করবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আমাদের মনে রাখা দরকার, একজন মানুষের হতাশা যেমন তার পরবর্তী প্রজন্মের ওপর প্রভাব ফেলে, তেমনি আনন্দও তার পরবর্তী প্রজন্মের ওপর প্রভাব রাখে। আমরা কোনটা চাই তা সবার জানা।
তাই পরবর্তী প্রজন্মকে এগিয়ে নেওয়ার আনন্দময় পথ তৈরি করবো আমরা। দেশের গণমাধ্যম এবং সচেতন মানুষের কাছ থেকে এ প্রত্যাশা করতেই পারি। আবারও অনুরোধ জানাই, আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ ‘ট্রল করবেন না, আমার সন্তানের গায়ে কোনও ট্যাগ লাগাবেন না। সব শিার্থীই আমার সন্তান, আপনারও।
আর দেশের উচ্চশিা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অনুরোধ রাখতে চাই। দয়া করে জিপিএ-৫ ছাড়া ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন না কোনও শিার্থী, এই অপশন বন্ধ করুন। যেহেতু পরীা নিয়েই ভর্তি নিশ্চিত করবেন, তাহলে ন্যূনতম ফলাফল থাকলেই তাকে অন্তত আবেদন করার সুযোগ দিন।
আমার এই লেখা পড়ে মুখে না বললেও মনে মনে ভাবতে পারেন, আমি কি একজন সংবাদকর্মী হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? হয়তো পারিনি। আর তাই আপনাদের কাছে আমি কৈফিয়ত জানাতে এসেছি। আমার ব্যর্থতা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই।
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলা ট্রিবিউন।